28/04/2025
কেন ১৯৭৪ সালে এ দুর্ভিক্ষ ঘটেছিল? কেন এটি ১৯৭২ বা ১৯৭৩ সালে, যুদ্ধের পরপরই ঘটেনি? এর কারণ কী? এটি কি মতাদর্শগত সংঘাত, আদর্শগত পার্থক্য, নাকি কেবল দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার ফল?
নাওমি হোসাইন: আমরা যা বুঝতে পারি, তা হলো দুর্ভিক্ষ সবসময়ই একটি জটিল ঘটনা, যা বহু কারণের সমন্বয়ে গঠিত হয়। তবে যারা দুর্ভিক্ষ নিয়ে গবেষণা করেন, তারা একমত যে শেষ পর্যন্ত দুর্ভিক্ষ ঘটে তখনই যখন তা প্রতিরোধ করা হয় না—সরকার বা যে-ই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়। অনেক সময় দুর্ভিক্ষ এমন স্থানেও ঘটে, যেখানে কার্যকর কোনো সরকারই নেই। তবে যে ক্ষেত্রেই হোক না কেন, দায়িত্বশীলদের ব্যর্থতাই দুর্ভিক্ষের মূল কারণ।
কেন ১৯৭২ বা ১৯৭৩ সালে দুর্ভিক্ষ হয়নি? এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৭১-৭২ সালেও এক ধরনের দুর্ভিক্ষ ছিল, কিন্তু এটি ভারতের দিকে স্থানান্তরিত হয়েছিল, যেখানে যুদ্ধের ফলে এক কোটি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল। অর্থাৎ পরিস্থিতি দুর্ভিক্ষের মতোই ছিল। ১৯৭৪ সালের আগেও বাংলাদেশ বহু বছর ধরে দুর্ভিক্ষের কাছাকাছি অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছিল। যুদ্ধের পর ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে বিপুল পরিমাণে বিদেশী সাহায্য প্রবাহিত হয়েছিল, কিন্তু ১৯৭৪ সালের দিকে এটি হ্রাস পেতে শুরু করে এবং তা ত্রাণমূলক সহায়তা থেকে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের দিকে স্থানান্তরিত হয়।
১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের পেছনে বেশ কয়েকটি কার্যকারণ রয়েছে। প্রথমত, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বন্যা: ১৯৭৪ সালে ভয়াবহ বন্যা হয়, যেখানে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যমুনা নদী ছয়বার ভেঙে পড়ে। প্রচুর ফসল নষ্ট হয় এবং বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়, ফলে কৃষিকাজে নিয়োজিত দিনমজুররা কাজ হারান।
দ্বিতীয়ত, দুর্ভিক্ষ অর্থনীতি (Famine Economics): ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৪ সালের মধ্যে চালের দাম দ্বিগুণ হয়ে যায়, যা নিম্নবিত্তের জন্য খাদ্য দুষ্প্রাপ্য করে তোলে। চালের দাম বৃদ্ধির মূল কারণ পুরোপুরি নিশ্চিত নয়, তবে চোরাচালান ও মজুদদারির ভূমিকা ছিল বলে ধারণা করা হয়। অমর্ত্য সেনের ‘অধিকার তত্ত্ব’ (Entitlement Theory) অনুযায়ী, দুর্ভিক্ষ খাদ্যের অভাবে নয়, বরং মানুষের তা কেনার সামর্থ্যের অভাবে ঘটে।
তৃতীয়ত, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট ও আন্তর্জাতিক সাহায্যের অভাব: ১৯৭৩ সালের তেল সংকটের কারণে
খাদ্য ও জ্বালানির দাম দ্রুত বেড়ে যায়। বাংলাদেশ সরকার তখন আর্থিক সংকটে ছিল এবং পর্যাপ্ত খাদ্য আমদানি করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে খাদ্যসহায়তা দিতে অস্বীকৃতি জানায়, কারণ বাংলাদেশ কিউবার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রেখেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের Public Law 480 (পিএল ৪৮০) অনুসারে, এটি তাদের নীতির পরিপন্থী ছিল। খাদ্যসহায়তা এক বছর দেরিতে আসে, যখন দুর্ভিক্ষ এরই মধ্যে তার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ একাধিক কারণের সম্মিলিত ফল, যার মধ্যে রাজনৈতিক অব্যবস্থাপনা, বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছিল। যদিও মতাদর্শগত সংঘাত (যেমন, যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার সম্পর্কজনিত সমস্যা) কিছুটা ভূমিকা রেখেছিল, মূলত দুর্নীতি, বাজারে খাদ্যের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে না পারা এবং কার্যকর নীতি গ্রহণের ব্যর্থতার কারণেই এ দুর্ভিক্ষ সংঘটিত হয়। অর্থাৎ এ দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল, কিন্তু নীতিনির্ধারকদের ব্যর্থতার কারণেই এটি ঘটে। https://bonikbarta.com/editorial/IHckyDCJ6p5KFHZo