29/11/2025
হৃদরোগ ও হার্ট অ্যাটাক এর গল্প : ২০০ বছরের এক অভূতপূর্ব যাত্রা
মানব ইতিহাসে হৃদরোগ, বিশেষ করে করোনারি আর্টারি ডিজিজ (CAD) এবং মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন (MI), মৃত্যু–ঝুঁকির প্রধান কারণ। গত দুই শতাব্দীতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতি এই রোগকে প্রায় রহস্যঘেরা অবস্থা থেকে আধুনিক জিনগত বিজ্ঞান পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। এই যাত্রা শুধু জ্ঞান-বিস্তার নয়, বরং মানবতার বাঁচার লড়াইয়ের গল্প।
❤️ প্রাথমিক যুগ (১৭০০–১৯০০): রোগ শনাক্তকরণের শুরু
১৭৭২ সালে উইলিয়াম হেবারডেন প্রথমবারের মতো বুকে ব্যথার (অ্যাঞ্জাইনা) ক্লিনিকাল বর্ণনা দেন। পরে প্যাথোলজিস্টরা বুঝতে পারেন—এই ব্যথার মূল কারণ করোনারি ধমনীতে ক্যালসিফিকেশন ও থ্রম্বোসিস।
১৯১২ সালে জেমস হারিক প্রথম “মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন” ধারণা স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেন এবং বিশ্রাম-ভিত্তিক চিকিৎসা প্রচলন করেন। ১৯১৯ সালে ECG-এর আবির্ভাব MI নির্ণয়ে বিপ্লব আনে।
❤️ রোগতত্ববিদ্যা ও ঝুঁকি উপাদান (১৯৪০–১৯৬০) সনাক্ত
১৯৪৮ সালে শুরু হওয়া ফ্রেমিংহাম হার্ট স্টাডি প্রথম দেখায়
উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল, ধূমপান—এগুলোই CAD-এর মূল ঝুঁকি।
এসময় থেকেই বিশ্ব বুঝে যায়, CAD কোনো নিয়তি নয়, বরং প্রতিরোধযোগ্য।
❤️ করোনারি কেয়ার ইউনিটের বিপ্লব (১৯৬০ এর দশক)
১৯৬০-এর আগে হার্ট অ্যাটাকে হাসপাতালে মৃত্যুহার ছিল ৩০% পর্যন্ত।
১৯৬১ সালে ডেসমন্ড জুলিয়ান “Coronary Care Unit (CCU)” চালু করেন—যেখানে ECG মনিটরিং, CPR, এবং তাত্ক্ষণিক ডিফিব্রিলেশন একত্রে করা সম্ভব হয়।
এর ফলে মৃত্যুহার অর্ধেকেরও বেশি কমে যায়।
❤️ ইনভেসিভ কার্ডিওলজি ও ইন্টারভেনশন (১৯৫০–১৯৮০)
১৯২৯: ফোরসম্যান নিজের শরীরে প্রথম হৃদযন্ত্রে ক্যাথেটার ঢোকান।
১৯৫৮: সোনেস করোনারি আর্টেরিওগ্রাফি আবিষ্কার করেন।
১৯৬৯: ফাভালোরো CABG সার্জারি চালু করেন।
১৯৭৭: গ্রুনৎজিগ প্রথম অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করেন — যার উপর দাঁড়িয়ে PCI আজকের রূপ পেয়েছে।
কার্ডিওলজি তখন থেকে আর শুধু চিকিৎসা নয়—একটি বহুবিভাগীয় প্রযুক্তিগত বিজ্ঞান।
❤️ আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা (১৯৭০–২০০০)
GISSI ও ISIS-2 ট্রায়াল: ফাইব্রিনোলাইসিস + অ্যাসপিরিন মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্য কমায়।
PCI ও স্টেন্ট চিকিৎসাকে নতুন যুগে নেয়।
ACE inhibitor, β-blocker, statin, aldosterone blocker—রোগীর আয়ু বাড়িয়ে দেয়।
ICD, CRT, LVAD হৃৎপিণ্ডের ব্যর্থতা চিকিৎসায় বিপ্লব ঘটায়।
SERCA2a জিন থেরাপি ভবিষ্যৎ চিকিৎসার আভাস দেয়।
❤️ অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিসের জৈবিক ভিত্তি
অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস আর কেবল “চর্বি জমা” নয়—এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহজনিত রোগ।
প্ল্যাক রাপচার → থ্রম্বাস → MI: এটাই মূল যন্ত্রণা।
নাইট্রিক অক্সাইড আবিষ্কার (ফারচট, ইগ্নারো, মুরাদ) → রক্তনালী প্রসারিত করার ঔষধ এর সূচনা।
LDL রিসেপ্টর আবিষ্কার (ব্রাউন ও গোল্ডস্টেইন) → স্ট্যাটিন যুগের সূচনা।
এই গবেষণা মেডিসিনে নোবেল পর্যন্ত নিয়ে যায়।
❤️ জিনগত ও মলিকিউলার যুগ (২০০০–বর্তমান)
জিনোমিক্স ও ফার্মাকোজেনোমিক্স চিকিৎসা ব্যক্তিভেদে সাজানোর সুযোগ তৈরি করেছে।
CYP2C19 সম্পর্কিত ক্লোপিডোগ্রেল রেজিস্ট্যান্স, ওয়ারফারিন জিন-ভিত্তিক ডোজিং এখন বাস্তব।
CAD সংশ্লিষ্ট নতুন জিন প্রতিদিন আবিষ্কৃত হচ্ছে।
স্টেম সেল থেরাপি ও হৃদযন্ত্র পুনর্জন্ম এখনো প্রাথমিক স্তরে, কিন্তু আশাব্যঞ্জক।
❤️ বৈশ্বিক হৃদরোগের চিত্র
করোনারি রোগ এখনো বিশ্বের ১ নম্বর ঘাতক।
মূল কারণ—বার্ধক্য, ধূমপান, অস্বাস্থ্যকর খাদ্য, কম চলাফেরা।
সমাধান—প্রতিরোধ, শিক্ষা, সাশ্রয়ী চিকিৎসা ও বিশ্বব্যাপী সমন্বয়।
❤️ উপসংহার
গত ২০০ বছর আগে হার্ট অ্যাটাক চিকিৎসা হতো রক্তপাত থেরাপি দিয়ে যা এখন জিন থেরাপি পর্যন্ত পৌঁছেছে।
তবুও লড়াই শেষ হয়নি।
হৃদরোগ প্রতিরোধ, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং সামাজিক সমতা—এগুলোই ভবিষ্যতের মূল যুদ্ধক্ষেত্র।
মানবতার হৃদয়কে সুস্থ রাখতে এই যাত্রা চলবে আরও বহু দূর।
লিংক: https://www.nejm.org/doi/full/10.1056/NEJMra1112570