01/08/2022
#ব্যথামুক্ত_নরমাল_ডেলিভারি
( এটি একটি পেশাগত পোস্ট। এর আগে বেশ কিছু "পেশাগত পোস্টে" Tagged হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম, আজ নিজেই পোস্ট দিয়ে কয়েকজনকে ট্যাগ করে দিচ্ছি...😀😀
পোস্টটি যথেষ্ঠ দীর্ঘ, বিষয়টাও কাটখোট্টা, তবে সমবেদনার প্রেক্ষিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি!
দীর্ঘ এই পোস্ট যাদের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটাবে,তাদের কাছে আগেভাগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি...)
প্রকৃতিগতভাবে এমন কিছু অভিজ্ঞতা আছে যা কেবল নারীই উপভোগ করতে পারেন;যেমনঃ মাতৃত্ব!
অন্য কোন আনন্দ মাতৃত্বের আনন্দের সাথে তুলনীয় হতে পারে না !
আবার প্রকৃতিগতভাবেই এমন কিছু অভিজ্ঞতা আছে, যা শুধুমাত্র নারীকেই ভোগ করতে হয়; যেমনঃ গর্ভ যন্ত্রণা!
গবেষণায় দেখা গেছে, মানবদেহ ৪৫ ডেল(ইউনিট) পর্যন্ত ব্যথা সহ্য করতে পারে। অথচ সন্তান জন্মদানের আগ মুহূর্তের ব্যথার পরিমাণ ৫৭ ডেল, যা একসাথে ২০ টি হাড় ভেঙ্গে যাওয়ার ব্যথার সমান!
এই ব্যথা অসহ্য দাঁতব্যথা,ক্যান্সার পেইনের চাইতেও বেশি তীব্র!
কত মা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছেন, যাচ্ছেন বা যাবেন,তার কি কোন ইয়ত্তা আছে?
সুখের বিষয় হলো, বিশ্বব্যাপী চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সমন্বিত কার্যক্রমের ফলে মাতৃমৃত্যুর হার আগের চেয়ে অনেক কমেছে। প্রয়োজনে সিজারিয়ানের মাধ্যমে মা ও শিশুকে নিরাপদ রাখার চেষ্টা করা হয়।
এখনো বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর প্রায় বেশিরভাগ দেশের শিশুই স্বাভাবিক প্রসব প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই জন্মগ্রহণ করে থাকে। সেবার মানও দিনে দিনে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে সিজারিয়ানের হারও বিশ্ব ব্যাপী অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই হার ৩২.২%! ২০১৪ এর হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে এর হার ২৪% ; লক্ষ্য করার মতো ব্যাপার হচ্ছে, শহরাঞ্চলে সিজারিয়ানের হার(৩৬.৯%) গ্রামাঞ্চলের হারের(১৭.৯%) দ্বিগুণেরও বেশি!
বোধ করি,অনেক সামাজিক, পরিবেশগত,বানিজ্যিক কারণ বাদ দিলেও নরমাল ডেলিভারির ব্যথা সহ্য করতে না পারাও এর অন্যতম কারণ!
তবে...মানুষের কাছে এখন বিকল্প রয়েছে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার কারণে এখন ব্যথামুক্ত নরমাল ডেলিভারিও সম্ভব!
প্রসূতির হাটা-চলা,পেটের সংকোচন,নিম্নচাপ সব কিছুই স্বাভাবিক প্রসবের মতোই থাকবে, শুধু প্রসবের প্রচন্ড ব্যাথাটাই থাকবে না! এই পদ্ধতিকে এপিডুরাল লেবার এনালজেসিয়া বলা হয়।
#লেবার_এনালজেসিয়ার_সুবিধাসমূহঃ
১. #সবচাইতে বড় সুবিধা হচ্ছে মায়ের নরমাল ডেলিভারির কষ্ট থেকে মুক্তি পওয়া!
২. #ব্যথার কারণে মায়ের বিভিন্ন ধরনের স্ট্রেস হরমোন নিঃসৃত হয় যা মা ও নবজাতকের জন্য ক্ষতিকর
হতে পারে। তা থেকে মা ও শিশুকে মুক্তি দেয়।
৩. #উচ্চ রক্তচাপে ভোগা মায়েদের প্রসবকালীন রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।জ
৪. #ঝুঁকিযুক্ত মায়েদের ক্ষেত্রে মা ও নবজাতকের ঝুঁকি কমায়।
৫. #অসহ্য ব্যথার কারণে যারা অতিষ্ঠ হয়ে সিজারিয়ান অপারেশন করাতে চান। লেবার এনালজেসিয়া তা থেকে প্রসূতিকে মুক্তি দিতে সক্ষম।
ব্যথামুক্ত নরমাল ডেলিভারির এমন আরো অনেক সুবিধার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
এপিডুরাল লেবার এনালজেসিয়া অত্যন্ত কার্যকর পদ্ধতি হওয়ায় পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে তা বেশ দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ক্যানাডাতে প্রদেশ ভেদে ডেলিভারির সময় এপিডুরাল এনালজেসিয়া গ্রহণের হার ৩০% থেকে ৬৯%!
মার্কিন মুলুকে ১৯৮১ থেকে ২০০১ এর মধ্যে এপিডুরাল এনালজেসিয়ার হার তিন গুন বেড়ে ৬০% হয়েছে!
এক্ষেত্রে যথারীতি এশিয়া, আফ্রিকার দেশগুলো অনেক পিছিয়ে। এশিয়ার মধ্যে আবার উপমহাদেশের দেশগুলো আরো পিছিয়ে!
বাংলাদেশের মায়েদের ব্যথামুক্ত নরমাল ডেলিভারির হার প্রায় শূণ্যের কোঠায় বললেই চলে। সীমিত পর্যায়ে ঢাকার কয়েকটা "ফাইভস্টার হাসপাতাল" ও দু'একটা মেটারনিটি সেন্টার ছাড়া এই সেবা চালু নেই!অথচ দেশে প্রতি বছর প্রায় ২৯ লক্ষ প্রসূতির ডেলিভারি হচ্ছে!
পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে যে সেবা এখন অনেকটা অধিকারের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে,সেখানে আমরা এই সেবা সম্পর্কে অজ্ঞ!
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, প্রসব বেদনা শুধু নারীর জীবনের সমস্যা না হয়ে যদি পুরুষের জীবনের সমস্যা অথবা নারী-পুরুষ উভয়ের সমস্যা হতো,তাহলে ব্যথামুক্ত ডেলিভারি আমাদের এই অঞ্চলে আরো আগে এবং অনেক বেশি বিস্তার লাভ করতো!
আমাদের দেশে ব্যথামুক্ত ডেলিভারি প্রক্রিয়া জনপ্রিয় হওয়ার ক্ষেত্রে #কিছু_প্রতিবন্ধকতা রয়েছে; যেমনঃ
#এমন একটা পদ্ধতিও যে আছে, তা-ই বেশিরভাগ প্রসূতি জানেন না!
#আমাদের দেশে এখনো ব্যাপক সংখ্যক নরমাল ডেলিভারি বাড়িতেই হয়ে থাকে।
#রোগী এবং রোগীর স্বজনের ধারনা, ব্যথা না থাকলে নরমাল ডেলিভারি কোনভাবেই সম্ভব নয়!
#আমাদের প্রেক্ষাপটে পদ্ধতিটি নতুন হওয়ায় স্বাস্থ্যকর্মী থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পর্যন্ত অনেকেরই লেবার এনালজেসিয়া সম্পর্কে পরিষ্কার ধারনা হয় নি; কিছু ভুল ধারনাও অনেকে পোষণ করেন। যেমনঃ ব্যথা না থাকলে রোগী চাপ দেবে না, চাপ না দিলে নরমাল ডেলিভারি হবে না! অথচ সঠিক মাত্রায় ওষুধ প্রয়োগ করা গেলে ব্যথামুক্ত অবস্থায়ও রোগী চাপ দিয়ে থাকেন!
আমাদের খেয়াল রাখতে হবে,উপকার না থাকলে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর মতো সচেতন জনগোষ্ঠীতে এই ব্যথামুক্ত পদ্ধতি এত জনপ্রিয় হতো না!
#এক ধরনের ভয়-সংকোচও কাজ করে; যেমনঃ নরমাল ডেলিভারি করার চেষ্টা করা অনেক প্রসূতিকে-ই সিজারিয়ান অপারেশনের প্রয়োজন হয়। ব্যথামুক্ত ডেলিভারির জন্য এপিডুরাল এনালজেসিয়া প্রয়োগের পর যদি নরমাল ডেলিভারি না হয়ে অপারেশনে যেতে হয়, তখন প্রসূতির স্বজনরা ভাবতে পারেন যে ব্যথামুক্ত করার কারণেই প্রসূতির নরমাল ডেলিভারি হয় নি! তবে এই সংকোচ একেবারে অমূলক নয়; আমাদের দেশে চিকিৎসক ও রোগীর স্বজনদের মধ্যে আস্থার সংকট তো রয়েছেই!
#ব্যথামুক্ত নরমাল ডেলিভারি একটি সমন্বিত কার্যক্রম। এর জন্য প্রয়োজন অভিজ্ঞ এনেসথেসিওলজিস্ট স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক লেবার নার্সের সমন্বিত প্রয়াস। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এখনো আমাদের এই সমন্বয়ের অভাব রয়েছে।
তাই বলে কি এদেশের মায়েরা লেবার এনালজেসিয়ার সুফল পাবেন না?!
খেয়াল করে দেখুন, উপরের প্রত্যেকটি প্রতিবন্ধকতাই উত্তরণযোগ্য; শুধু আমাদের সদিচ্ছা এবং এই সম্পর্কিত জ্ঞান চর্চা ও আলোচনার প্রয়োজন।
যুগের সাথে সাথে সবদিক দিয়ে যখন দেশ এগিয়ে যাচ্ছে তখন আমরা এই ক্ষেত্রে কেন অকারণে পিছিয়ে থাকবো?
( পূণশ্চঃ আমি দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করে বিগত কিছুদিন ধরে Mother & Child Care Hospital,বড়পুল,চট্টগ্রামে নিয়মিত ভাবে লেবার এনালজেসিয়া দেয়া শুরু করেছি। ইতিমধ্যে ডা. Hafiza Marjan ও Naznin Sultana এর অধীনে থাকা বেশ কিছু প্রসূতির ব্যথামুক্ত নরমাল ডেলিভারি হয়েছে। হাসপাতালটির কর্তৃপক্ষ, অন্য এনেসথেসিওলজিস্ট ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ বৃন্দ এ ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহিত ও সহযোগিতা করেছেন।
লেবার এনালজেসিয়ার সময়টায় প্রসূতি হাটাহাটি করেছেন, বাচ্চার নড়াচড়া অনুভব করেছেন, নিম্নচাপ অনুভব করেছেন, প্রয়োজন অনুযায়ী চাপ দিতে পেরেছেন,শুধু ব্যথা পান নি এবং ক্লান্ত হয়ে যান নি!সবচাইতে বড় কথা, যেসব মায়েদের ব্যথামুক্ত নরমাল ডেলিভারির চেষ্টা করা হয়েছে,এখন পর্যন্ত সবারই নরমাল ডেলিভারিই হয়েছে,একজনেরও সিজারিয়ান সেকশনের প্রয়োজন হয় নি!
চট্টগ্রামের আরো একজন অভিজ্ঞ কার্ডিয়াক এনেসথেসিওলজিস্ট বন্ধুবর Minhazur Rahman Chowdhury একই সময়কালে এমন লেবার এনালজেসিয়া দিয়েছেন, তাঁর অভিজ্ঞতাও এমনি সুখকর।
দিনশেষে সুস্থ সবল নবজাতকের সাথে সুস্থ, ব্যথামুক্ত মায়ের হাসিমুখ দেখলে কার না ভালো লাগে, সে আপনি যত কম আবেগীই হন না কেন!
আশা করি,অদূর ভবিষ্যতে ব্যথামুক্ত নরমাল ডেলিভারি ভবিষ্যতে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর মতো আমাদের দেশেও একজন মায়ের অধিকার হিসেবে পরিগণিত হবে।কারণ এই পদ্ধতির ডেলিভারি শুধুমাত্র মা ও শিশুর কল্যাণই নিশ্চিত করে না,ব্যথাজনিত কারণে অহেতুক সিজারিয়ান অপারেশন থেকেও রোগীকে মুক্তি দেয়!
প্রসূতির এমন সুদিন শীঘ্রই আসুক...
সারাদেশের আনাচে কানাচে এই সেবা ছড়িয়ে পড়ুক...)
Copied from dr Subir Barua