02/06/2024
মায়ের বুকের দুধ কম হওয়ার কারণ ও বৃদ্ধির উপায়:
➡️বুকের দুধ কি আসলেই কম? বাচ্চা কি আসলেই দুধ কম পাচ্ছে?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নবজাতকের কান্নাকে শুধুমাত্র ক্ষুধার জন্য কান্না বলে ধরে নেয়া হয়। এটা কিন্তু সত্য না। নবজাতকের যেকোন অস্বস্তি, কষ্ট হলেই সে কান্না করে। পেটে ব্যথা, ভেজা কাপড়, ঠান্ডা লাগা ইত্যাদি যেকোন ক্ষেত্রেই কিন্তু নবজাতক কান্না করে। নবজাতকের চামড়া খুবই স্পর্শকাতর হওয়া কাপড়ের ঘষা লাগার কারণেও কান্না করতে পারে। এমনকি শুধুমাত্র কোলে উঠার জন্যও বাচ্চা কান্না করে। কাজেই, বাচ্চা কান্না করলে শুধু খাওয়ার বিষয় না অন্যদিকগুলো নিয়েও চিন্তা করতে হবে।
তবে, কিছু ক্ষেত্রে আসলেই বাচ্চা পর্যাপ্ত দুধ নাও পেতে পারে। সেগুলোকে চিনতে হবে। এবং কোন সমস্যা থাকলে সমাধান করতে হবে। নিচের লক্ষণগুলো আছে কিনা দেখুন-
১। বাচ্চা সারাদিন কমপক্ষে ৬-১২ বার প্রস্রাব করে কিনা। যদি না করে তাহলে বাচ্চা হয়ত পরিমান মত দুধ পাচ্ছে না। তবে, খেয়াল রাখতে হবে যে জন্মের পর প্রথম দুইদিন নবজাতক প্রস্রাব নাও করতে পারে। এটা স্বাভাবিক।
২। বাচ্চার ওজন বাড়ছে কিনা। জন্মের পর প্রথম ৭ দিন বাচ্চার ওজন কমতে থাকে। তবে, এর পর থেকে ক্রমাগত ওজন বাড়ার কথা। যদি না বাড়ে তাহলে হয়তো পর্যাপ্ত দুধ পাচ্ছে না।
৩। বাচ্চা বেশি কান্না করে। ঠিকঠাক দুধ খায় এবং শান্ত হয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার কান্না শুরু করে। অনেক ক্ষেত্রে মায়েরা একবার খাওয়ানোর সময় দুইস্তন থেকে অল্প অল্প করে দুধ খাওয়ান। এর ফলে বাচ্চার পাওয়া দুধের পরিমাণ ঠিক থাকলেও দুই স্তন থেকেই সামনের দিকের অপেক্ষাকৃত পাতলা দুধ (foremilk) পায়। এবং পিছনের দিকের ঘন দুধ (hindmilk) পায় না। ফলে, কিছুক্ষণ পরেই আবার বাচ্চার ক্ষুধা লেগে যায় এবং কান্নাকাটি শুরু করে।
এ লক্ষণগুলো থাকলে বাচ্চা দুধ পরিমাণমত পাচ্ছে না ধরে নেয়া যায়। প্রশ্ন আসে যে কেন বাচ্চা যথেষ্ট পরিমাণে বুকের দুধ পাচ্ছে না বা কেন মায়ের বুকে দুধ যথেষ্ট পরিমাণে তৈরি হচ্ছে না। এজন্য একটু ভিতরের কথা জানলে সুবিধা হবে।
➡️মায়ের বুকে দুধ কিভাবে তৈরি এবং নিঃসরিত হয়?
শিশু যখন মায়ের স্তনের বোটায় দুধ খাওয়ার সময় চুষে তখন মায়ের ব্রেইন থেকে দুইটি হরমোন (রক্তে থাকা একধরণের কেমিক্যাল) নিঃসরিত হয়। এর মধ্যে একটা প্রোল্যাকটিন (prolactin) এবং অন্যটি অক্সিটোসিন (oxytocin) ।
প্রোল্যাকটিন মায়ের স্তনে দুধ তৈরি করতে সহায়তা করে। অর্থাৎ যত বেশি প্রোল্যাকটিন নিঃসরিত হবে তত বেশি বুকের দুধ তৈরি হবে।
অন্যদিকে, অক্সিটোসিনের কাজ হলো দুধ স্তন থেকে বের করা। অর্থাৎ বাচ্চা যখন বুকে মুখ দেয় এবং চুষে তখন দুধ বের হবে। সোজা ভাষায় অক্সিটোসিন বেশি নিঃসরিত হলে স্তনে আগে থেকে তৈরি থাকা দুধ বেশি বেশি বের হয়ে আসবে।
👉প্রোল্যাকটিন (Prolactin)
প্রোল্যাকটিন অ্যালভিওলাই বা দুধ কোষের উপর কাজ করে দুধ তৈরি করে,
প্রোল্যাকটিনের জন্য মা আরাম বোধ করেন এবং তার ঘুম ভালো হয়,
প্রসবের পর প্রথম ২ ঘন্টা রক্তে প্রোল্যাকটিন সবচেয়ে বেশি থাকে ফলে এই সময় শিশু দুধ পান করলে দুধের তৈরি হওয়ার মাত্রা আরো বেড়ে যায়,
শিশু যখন মায়ের বুকের দুধ ঘন ঘন পান করে, প্রোল্যাকটিন নিঃসরণ বেড়ে যায় এবং বুকের দুধের পরিমান বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে, বুকের দুধ কম খাওয়ালে প্রোল্যাকটিন নিঃসরণ কমে যায় এবং দুধের পরিমাণও হ্রাস পায়।
👉অক্সিটোসিন (Oxytocin)
অক্সিটোসিন(oxytocin) দুধকোষ (alveoli)এর চারপাশে থাকা মাংসপেশি কোষ (myoepithelial cells)এর উপর কাজ করে। অক্সিটোসিন নিঃসরণের ফলে মাংসপেশি সংকুচিত হয় এবং দুধকোষ থেকে দুধ বের হয়ে আসে।
অক্সিটোসিন তৈরি হয়ে থাকা দুধ বের করে ফলে শিশু খেতে পারে। মা যখন শিশুকে খাওয়ানোর ইচ্ছা নিয়ে তার কাছে যায় তখন থেকেই অক্সিটোসিন নিঃসরণ বেড়ে যায়। শিশু চোষার সময় তা আরো বেড়ে যায় (let down reflex or milk ejection reflex)।
ধীরে ধীরে মায়ের শারীরিক ও মানসিক অনুভুতির সাথেও জড়িত হয়ে যায়। এমন কি শিশুকে স্পর্শ করা, শিশুর কান্না শোনা, এমনকি শিশুর কথা কল্পনা করলেও অক্সিটোসিন নিঃসরণ হয় এবং দুধ বের হয়ে আসা শুরু হয়।
➡️কি কি কারণে মায়ের বুকের দুধ কমে যায়?
👉দেরিতে বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করা।
বুকের দুধের আগেই শিশুকে অন্যকিছু খাওয়ানো। এতে বাচ্চার ক্ষুধা কমে যেতে পারে এবং বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করতে সমস্যা হতে পারে।
👉মায়ের মধ্যে সন্দেহ, দ্বিধাধন্দ থাকা। বিশেষ করে নতুন মায়েদের অনেক সময়ই মনে হয় যে সে বাচ্চাকে সঠিকভাবে দুধ খাওয়াতে পারবে না। ফলে, প্রোল্যাকটিন ও অক্সিটোসিন হরমোন সঠিকভাবে বা পরিমাণমত তৈরি নাও হতে পারে। এবং পর্যাপ্ত দুধ তৈরি ও নিঃসরণ নাও হতে পারে।
👉শারীরিক ব্যথা বেদনা বা মানসিক অস্থিরতা থাকলে মায়ের রক্তে অক্সিটোসিন নিঃসরণ কমে যায়। এ কারণে পর্যাপ্ত ব্যথানাশক সেবন করা ও মাকে মানসিক সমর্থণ দেয়া জরুরি।
➡️পজিশন ও এটাচমেন্ট সম্পর্কে জানতে এবং শিশুকে মায়ের দুধ কিভাবে খাওয়াবেন?
👉যতদ্রুত সম্ভব নবজাতককে বুকের দুধ দেয়া শুরু করা। কমপক্ষে ১ ঘন্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করতে হবে।
👉নবজাতক ও তার মাকে একই রুমে এবং সম্ভব হলে একই বিছানায় রাখতে হবে। এর ফলে মা নবজাতকের স্পর্শ পাবে, গন্ধ পাবে, শব্দ শুনতে পাবে এবং দুধ বেশি বেশি তৈরি হবে। এবং বেশি বেশি নিঃসরণও হবে।
রাতে প্রোল্যাকটিন নিঃসরণ বেশি হয়। এ কারণে শিশুকে রাতের বেলায় ঘন ঘন বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। দিনেরাতে যখনই বাচ্চাকে চাহিদা মোতাবেক খাওয়াতে হবে।
👉শিশুকে ঘন ঘন বুকের দুধ খাওয়াতে হবে এবং খাওয়ানো কখন বন্ধ করতে হবে সেটা আপনার শিশুর ওপর ছেড়ে দিতে হবে। শিশু যখন বুকের দুধ পান করে তখন আপনার শরীর থেকে হরমোন নিঃসৃত হয়। এই হরমোন দুধ উৎপাদনের ওপর প্রভাব ফেলে।তাই যত বেশি বুকের দুধ খাওয়াবেন তত বেশি বুকের দুধ তৈরি হবে। শিশুকে দিনে ১২থেকে ১৮ বার বুকের দুধ পান করান।
👉 নবজাতককে কোলে নিয়ে বসে বসে দুধ খাওয়াতে হবে। এ সময় মোবাইল /টেলিভিশন দেখা যাবে না।
👉দুটি স্তন থেকেই সমানভাবে শিশুকে দুধ পান করাতে হবে। প্রথম স্তন থেকে শিশুকে দুধ পান করান এবং সেই পর্যন্তই করান যতক্ষণ না পর্যন্তু শিশু পান করা বন্ধ করে দেয়। এরপর দ্বীতিয় স্তনে দুধ পান করান। শিশুকে একপাশের স্তন থেকে একবারে সম্পুর্ণ খাওয়াতে হবে। ফলে, স্তন (অর্থাৎ দুধকোষ বা alveoli) খালি হবে। দুধকোষ খালি হলে প্রোল্যাকটিন নিঃসরণ বাড়ে এবং বেশি বেশি দুধ তৈরি হয়।একই সঙ্গে উভয় স্তন থেকে দুধ পাম্প করলে, দুধের উৎপাদন বাড়ে এবং দুধে চর্বির পরিমাণও বেশি হওয়ার সম্ভবনা থাকে।
👉মায়ের পুষ্টি ঠিক থাকতে হবে। যদি মা অপুষ্টির শিকার হন তাহলে অনেক ক্ষেত্রে দুধের পরিমাণ কমে যেতে পারে। একারণে প্রয়োজন ক্ষেত্রে মাকে চিকিৎসা করাতে হবে। একই সাথে মাকে পুষ্টিকর খাবার (শর্করা, আমিষ, ভিটামিন, মিনারেলইত্যাদি সমৃদ্ধ) খেতে হবে। সাধারণভাবে বলা যায় গড়পড়তা মানুষের ৩ বেলার বিপরীতে দুগ্ধদায়ী মাকে ৪-৫ বেলা খেতে হবে ( প্রতিদিন ৫০০ ক্যালরি অতিরিক্ত খেতে হবে)।
দুধদানকারী মাকে ফলিক এসিড ও ক্যালসিয়াম খেতে হবে। প্রসবের ৪২ দিন পর ভিটামিন এ (২০০,০০০ ইউনিট) এবং ০৩ মাস পর থেকে আয়রণ ট্যাবলেট খেতে হবে।
👉বুকের দুধ বা ব্রেস্ট মিল্কের উৎপাদন বাড়াতে খাবারের তালিকায় টাটকা শাক-সবজি, লাউ, পিঁয়াজ, মুরগি, ডিম, দুধ, রসুন, মিট স্যুপ রাখুন। এছাড়াও মরশুমি ফল ও ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার যেমন স্যালমন, ফ্ল্যাক্সবীজ স্তন্যদানকারী নারীদের জন্য ভালো। এছাড়াও, বুকের দুধের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য মেথি, ওটমিল, কালোজিরা,মৌরি বেশ কার্যকরী।একই সাথে কিছু ঔষধও সহায়তা করতে পারে।
👉মায়ের দুধের প্রায় ৯০ শতাংশই পানি। তাই শিশুকে দুধ পান করার সময় শরীরকে হাইড্রেটেড রাখা খুব জরুরি। এই সময় প্রতিদিন ৮ থেকে ১২ গ্লাস পানি পান করুন। এছাড়াও, অন্যান্য তরল খাবার যেমন, দুধ, জুস, সুপ পান করতে পারেন। শিশুকে দুধ পান করানোর আগে এক গ্লাস পানি পান করুন।
Dr. Oli Ullah Fahad