01/11/2023
পিসিওএস এবং পিসিওডি
বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই আজকাল প্রায় প্রতিটা মেয়ের সমস্যাই পলিসিস্টিক ওভারি। অত্যাধিক ফাস্ট ফুড খাওয়া, সেডেন্টারি জীবন যাত্রাই এর প্রধান কারন। এছাড়া হরমোনাল কিছু অসামঞ্জস্যতা তো আছেই। অনেক সময় হয় কি কোনো প্রকার পরীক্ষা নীরিক্ষা না করানোর কারনে জানতেই পারা যায় না এরকম কোন সমস্যা শরীরে রয়েছে, যদিও এর বেশ কিছু উপসর্গ আছে যা দেখে প্রথম অবস্থাতেই জানা যেতে পারে।
পলিসিস্টিক ওভারি কি?
সিস্ট হলো ছোট পানি ভরা থলি, আর একাধিক সিস্টকে একসঙ্গে বলা হয় পলিসিস্ট। আর ওভারি যে ফিমেল রিপ্রোডাক্টিভ অরগ্যানগুলোর মধ্যে অন্যতম তা নিশ্চয়ই সবারই জানা। ছোট ছোট সিস্ট (১০-১২টি) পুঁতির মালার মতো দেখতে ওভারি বা ডিম্বাশয়কে ঘিরে থাকে। এই সিস্টের জন্য ওভারির স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়।
পলিসিস্টিক ওভারির ক্ষেত্রে প্রধানত দুটি সমস্যা হয়, একটি পিসিওডি এবং আরেকটি পিসিওএস। এই দুটির উপসর্গ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এক হলেও কারণ কিন্তু ভিন্ন।
পিসিওডি পলিসিস্টিক ওভারিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি দেখা যায়, যা প্রধানত হরমোনাল অসামঞ্জস্যতার জন্য হয়। এই অবস্থায় দুটি ওভারি থেকে প্রচুর অপরিণত এগ নিঃসৃত হয় যা কিছু সময় পর সিস্টে পরিণত হয়।
আরেকটি হলো পিসিওএস অর্থাৎ পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম। যা কিনা একটি এন্ডোক্রিন সিস্টেম ডিসঅর্ডার। এই অবস্থায় ওভারিতে প্রচুর এন্ডোজেন তৈরি হয় যা ডিম্বাণু তৈরি ও নিঃসরণে বাধা সৃষ্টি করে। এই ডিম্বাণুগুলির কয়েকটা তরল পূর্ণ সিস্টে পরিণত হয়ে ওভারিতে জমা হয় ও একে ফুলিয়ে দেয়।
পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোমের সম্ভাব্য কারণ :
পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোমের সঠিক কারণ এখনো পাওয়া যায়নি। কিন্তু ইনসুলিন প্রতিরোধ এবং হরমোন ভারসাম্যহীনতার পাশাপাশি জেনেটিক্সকে অবশ্যই একটি ফ্যাক্টর বলে মনে করা হয়। একজন নারীর পিসিওএস হওয়ার ঝুঁকি প্রায় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পায় যদি তার মা, বোন বা ফুফুর মতো পরিবারের কারো পিসিওএস থাকে।
প্রায় ৮০ শতাংশ নারী যাদের পিসিওএস নির্ণীত হয় তাদের ইনসুলিন প্রতিরোধ থাকে। এই ক্ষেত্রে শর্করা ভাঙার জন্য অতিরিক্ত ইনসুলিন তৈরির জন্য শরীরকে অতিরিক্ত সময় ধরে কাজ করতে হয়। এটি আবার, টেস্টোস্টেরনের অতিরিক্ত উৎপাদন করতে ডিম্বাশয়কে উদ্দীপিত করতে পারে, যা তারপর ফলিকলগুলোর স্বাভাবিক বিকাশে বাধা দেয়। এটি প্রায়ই ডিম্বস্ফোটনকে অনিয়মিত করে তোলে।
জেনেটিক কারণের সঙ্গে সঙ্গে লাইফস্টাইলের কারণগুলোও ইনসুলিন প্রতিরোধের একটি সাধারণ কারণ। ওজন বেশি হওয়া হচ্ছে ইনসুলিন প্রতিরোধের আরেকটি কারণ। হরমোন ভারসাম্যহীনতা যেমন টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বৃদ্ধি, লুইটিনিজিং হরমোন (এলএইচ) এর উচ্চ মাত্রা এবং প্রোল্যাক্টিনের হরমোনের উচ্চ মাত্রাও পিসিওএস ঘটাতে পারে।
লক্ষণ:
শরীরে আসবে কিছু পরিবর্তন, যা দেখেই বুঝতে হবে যে নাহ্ এবার ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন আছে।
তাহলে দেখে নেওয়া যাক সেগুলো কি কি-
প্রথমেই দেখা যাবে যে
১. মেন্সট্রুআল সাইকেল অনিয়মিত বা বন্ধ হয়ে গেলো হঠাৎ করে।
২. দেহের বিভিন্ন জায়গায় অবাঞ্ছিত চুলের বৃদ্ধি দেখা যাবে।
৩. মাথার চুল পাতলা হয়ে যাবে।
৪. একাধিক ফেসপ্যাক ব্যবহারের পরেও ব্রণ এর সমস্যা কিছুতেই কমবেনা।
৫. হঠাৎ করে ওজন বেড়ে গেলে।
৬. দেহে তৈরি হবে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স।
৭. সামান্য কারণেই স্ট্রেস বাড়তে থাকবে।
যে বয়সে হতে পারে :
যেকোনো বয়সের নারীরই মেনার্কি থেকে মেনোপজ পর্যন্ত হতে পারে। তবে একই পরিবারের নারীদের মধ্যে অনেকের হয় বলে জেনেটিক ফ্যাক্টরকে দায়ী করা হয়। রোগের প্রাথমিক অবস্থাতেই নারীরা ডাক্তারের কাছে আসছেন এবং ইদানীং রোগ নির্ণয়ের অনেক অত্যাধুনিক ব্যবস্থার কারণে রোগ নির্ণয় হচ্ছে বেশি। আগেকার দিনে এ ধরনের মেয়েলি সমস্যাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হতো না।
এতগুলো সমস্যার তাহলে সমাধান কি?
উপায় কিন্তু মাত্র দুটি, ওজন কমানো ও হরমোনাল সাইকেল ঠিক করা। সুষম খাদ্য ও যোগব্যায়াম এই দুই এর দ্বারাই এটা করা হল সবচেয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি।
সুষম খাদ্যের ক্ষেত্রে বলব স্ট্রিক্ট ডায়েটিং কিন্তু কখনোই রেকোমেনডেড নয়। একটা ব্যালান্সড উপায়ে ওজন কমানোটাই লক্ষ্য হওয়া উচিত, কয়েকটা ছোটো ছোটো জিনিস মাথায় রাখলেই চলবে-
১. কোনোভাবেই মিল স্কিপ করা চলবেনা, প্রধানত ব্রেকফাস্ট।ভকমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন গুড ফ্যাট ও মৌসুমি ফল যেন থাকে।
২. সারাদিনের ক্যালোরি কাউন্ট কমাতে হবে, প্রয়োজনীয় ক্যালোরির থেকে কম ক্যালোরি গ্রহণ করতে হবে, আবার প্রোটিনের চাহিদাও যেন মেটে সেটাও মাথায় রাখতে হবে।
৩. ভাজাভুজি যতটা সম্ভব কম খেতে হবে।
৪. সারাদিনে প্রচুর শাকসবজি খেতে হবে।
৫. আলমন্ড, আখরোট ইত্যাদি গুড ফ্যাট যুক্ত নাটস যোগ করতে হবে।
৬. চিনি , মিষ্টি গুড় ও মধু জাতীয় জিনিস খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে
৭. প্রতিদিন একটা-দুটো কিউব ডার্ক চকলেট হরমোনাল সামঞ্জস্যতা বজায় রাখতে কিন্তু বেশ সাহায্য করে কারণ এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ পলিফেনল।
৮. পিসিওডি থাকলে মেন্সট্রুয়াল সাইকেলের সময় হেভি ব্লিডিং হতে থাকে, যার ফলে আয়রন ডেফিসিয়েন্সি এনিমিয়া দেখা যায়, তাই আয়রন, ভিটামিন সি যুক্ত খাবার বেশি খেতে হবে
৯. ডায়েটে রাখতে হবে নাটস, শাকসবজি, হোল গ্রেন সিরিয়ালস কারণ এগুলোতে আছে প্রচুর ম্যাগনেসিয়াম যা হরমোনাল সামঞ্জস্য বজায় রাখে।
১০. দারচিনি ও হলুদের কারকিউমিন এর ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স এর ওপর বেশ প্রভাব দেখা যায়।
দুধ খাবো না খাবো না?
পিসিওডি এর ডায়েটে একটা তর্ক দেখা যায় দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার নিয়ে। দুধের শর্করা ল্যাকটোজ এন্ড্রোজেন এর ক্ষরণ বাড়িয়ে দেয়, ফলে অনেক ক্ষেত্রেই ব্রণ জাতীয় স্কিন ইনফেকশন বেশি দেখা যায়, এছাড়াও ল্যাকটোজ শর্করা IGF-1 নামক ইনসুলিন গ্রোথ ফ্যাক্টরকে উদ্দীপিত করে দেহে ইনসুলিনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ল্যাকটোজ শর্করার উপিস্থিতি কিছু ক্ষেত্রে ইনসুলিন সেনসিটিভিটি কমিয়ে দেয় তাই অনেকেই এই সময় দুধ এড়িয়ে চলেন। তবে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কিন্তু এখনো পাওয়া যায়নি সেভাবে। কিন্তু টক দই প্রতিদিন ডায়েটে রাখা উচিৎ, কারণ এতে রয়েছে প্রচুর প্রবায়োটিক।
PCOD এবং PCOS এর মধ্যে পার্থক্য কি?
PCOS হল একটি সিন্ড্রোম যেখানে অনেক সিস্ট (তরল পদার্থে ভরা থলি) মহিলাদের উভয় ডিম্বাশয়ে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। এগুলি বড় এবং প্রায়শই অপরিণত ডিমের পাশাপাশি অন্যান্য নিঃসরণ থেকে তৈরি হয়। এ কারণে নারীদের পিরিয়ডের সমস্যায় পরতে হয়। কখনও কখনও তাদের একেবারে নেই বা অন্যথায়, তারা অবিশ্বস্ত এবং বিলম্বিত হয়। সাধারণত, এটি কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে সনাক্ত করা হয়, বেশিরভাগই প্রথম পিরিয়ডের সময়।
অন্যদিকে, PCOD এর ডিম্বাশয়ের উপর একই রকম প্রভাব রয়েছে, তবে সেগুলি প্রকৃতিতে ছোট। ডিম্বাশয়ে ছোট সিস্ট তৈরি হয় যা তিন মাসের মধ্যে সরে যেতে পারে (জীবনযাত্রায় পরিবর্তন প্রয়োজন) এবং সংখ্যায়ও কম। PCOD-এ, পিরিয়ড স্বাভাবিক এবং কখনও কখনও বিলম্বিত হয়। পিসিওডি ধরা পড়ে যখন সন্তান জন্মদানের বয়সের একজন মহিলা গর্ভধারণ করতে সক্ষম হয় না।
PCOD PCOS-এর চেয়ে বেশি প্রচলিত। বিশ্বব্যাপী প্রায় 1/3 নারীর PCOD আছে। PCOS কেস PCOD থেকে কম।
PCOD বন্ধ্যাত্ব হওয়ার সম্ভাবনা কম। PCOD-এর প্রায় 80% ক্ষেত্রে, মহিলারা সামান্য চিকিৎসা সহায়তায় গর্ভবতী হতে পারেন। হরমোনের কর্মহীনতার কারণে PCOS গর্ভধারণকে কিছুটা কঠিন করে তোলে।