27/11/2025
আমাদের কানাডায় আসার গল্প
পর্ব ৪
জানুয়ারি -মার্চ ২০২৩
ব্রিটিশ কলাম্বিয়াতে আবেদনপত্র জমা দেয়ার পর আমি আসলে নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করছিলাম, কারন আমি কেন জানিনা একা যেতে চাইছিলাম না। আমার মাননীয় শ্রদ্ধেয় বর আমার জন্য খুবই দাম দিয়ে দুটো দারুন এপ্রন বানিয়ে দিলেন এবং আমাকে অনেক Motivate করতে লাগলেন। প্রয়োজনীয় টুকিটাকি কেনাকাটা করা এবং ফ্যামিলিতে সময় দেয়া -এভাবেই প্রস্তুতি পর্ব চলছিল।
২৫ জানুয়ারি রাতে আমরা সবাই প্রতিদিন এর মত রুটিনমাফিক ঘুমাতে যাই। রাত সাড়ে তিনটার দিকে আমার মাননীয় শ্রদ্ধেয় বর আমাকে খুব সাবধানে ঘুম থেকে তুললেন এবং আমাকে তিনি খুব ই সাধারণ ভাবে বললেন -তার হঠাৎ করে কাশি হচ্ছিল। বাথরুমে গিয়েছিলেন এবং তার মুখ থেকে কিছু ব্লিডিং হয়েছে- আমি একটু দেখতে।
আমি ওয়াশ রুমে গিয়ে যেটা দেখলাম সেটা আমি মোটেও বর্ননা করতে চাইনা। আমি রুমে গিয়ে আমার ফোন নিলাম এবং কয়েকটি ছবি তুললাম। আমার চোখ ফেটে যাচ্ছিল কিন্তু খুব কষ্ট করে নিজেকে আটকে রাখলাম। সকালবেলা আমার দুজন সাংগঠনিক বোনের বায়োডাটা (রুকনিয়াতের শপথের জন্য) লিখতে সাহায্য করার কথা ছিল। তাদের সেদিন ই জমা দেয়ার তারিখ ছিল। তাই আমি তাদের কে খুব ভোরে আমার বাসায় আসতে বললাম। তাদের বায়োডাটা লিখানো শেষ+ বাচ্চাদের স্কুল এ পাঠিয়ে সকাল ১০ টার দিকে আমরা কল্যাণপুর ইবনে সিনা হাসপাতালে ইমার্জেন্সিতে আসলাম।
ইতিমধ্যেই তার ব্লিডিং এর পরিমাণ অনেক বেড়ে গিয়েছিল, সে ইমার্জেন্সির বেসিনে দাড়িয়ে ছিল। বসতেই পারছিল না। ডাক্তার কে আমি আমার মোবাইলে তোলা ওয়াশ রুমের ছবিগুলো দেখালাম। সাথে সাথে তাকে ভর্তি করানো হলো এবং ডাক্তার প্রাথমিক ভাবে কিছুই বলতে পারলেন না। তিনি একবার সন্দেহ করছিলেন ব্লিডিং হচ্ছে ফুসফুস থেকে আবার বলছিলেন গলা থেকে।
আমি আমার বাচ্চাদের স্কুল এ বাচ্চাদের খুব পছন্দের শিক্ষিকা Fatima Sikder Sanjida কে ফোন দিয়ে জানালাম ওরা যেন তাদের মেঝ খালামনি Sabina Yeasmin র বাসা হয়ে বাসায় যায়। আমার বড় মেয়ে Syeda Subhana -র কাছে বাসার একটি অতিরিক্ত চাবি সবসময় দেয়া থাকতো। আমি আমার ছোট বোন Sanjida Akter কে ফোন দিয়ে বললাম আগামী কিছুদিন সে যেন রাতে এসে আমাদের বাসায় ঘুমায়।
আমার মাননীয় শ্রদ্ধেয় বরকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল এবং যত ট্রিটমেন্ট তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় ই IV-তে দেয়া হচ্ছিল। প্রথমে তাকে সাধারণ ওয়ার্ডে রাখা হলেও এক রাতের মধ্যেই আমাদের কে কেবিন দেওয়া হয়। বাবার মত মাথার উপরের ছাঁদ হয়ে আমাদের কে সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবেলায় সবথেকে বেশী সজাগ ভূমিকা পালন করেন প্রফেসর ডঃ মুহাম্মদ আব্দুর রব স্যার । ইবনে সিনা ট্রাস্ট এর চেয়ারম্যান প্রফেসর ডঃ চৌধুরী মাহমুদ হাসান স্যার ও সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রেখেছেন।
আসরের নামাজের পর খুব কঠিন সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রথমে Shoppers Drug Mart এ আমার Employer কে লিখলাম যে ব্যক্তিগত কারণে আমি জয়েন করতে পারবো না। (যদিও তারা আমাকে আরও একমাস সময় নিয়ে মার্চে জয়েন করার কথা বলেছিল, কিন্তু এবার আমি ডিটারমাইন্ড ছিলাম যে আমি আর একা একা কোনভাবেই আসবো না, আসলে সবাই একসাথেই আসবো।) ।
একই সাথে আমি ব্রিটিশ কলম্বিয়া ইমিগ্রেশন অফিসে আমার আবেদন প্রত্যাহার/Withdraw করতে ইমেইল পাঠালাম। British Columbia আমার Withdrawal Accept করে এবং যেটা আমি আশা করিনি, তারা আমার সম্পূর্ণ Application Fee রিফান্ড করে! (Screenshot Attached)
এই সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আমি আমার মাননীয় শ্রদ্ধেয় বরের সাথে পরামর্শ করার সুযোগ পাইনি এবং এই প্রথম আমি একা এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলাম। টানা পাঁচদিন তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হলো। এর মধ্যে অনেকেই দেখতে এসেছেন, কারও কারও সাথে দু চারটা কথা তিনি বলেছেন, কিন্তু আসলে তাকে দিনে তিনটি করে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে রাখা হচ্ছিল। এসময় বড় ভাইয়ের মত সহযোগিতা পেয়েছি আমার মাননীয় শ্রদ্ধেয় বরের বাল্যবন্ধু Aklas Chowdhury ভাইয়ার থেকে। তিনি প্রতিদিন হাসপাতালে আসতেন। সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতেন, কিছু লাগবে কিনা। এছাড়াও যাদের কথা উল্লেখ না করলেই নয়
Abul Kalam Azad , Hasan Bin Nazrul , Humayun Rashid
এর মধ্যে এমন কোন টেস্ট নেই যা করা হয়নি, কিন্তু তার ব্লিডিং এর উৎস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এই সময়ে আমি একটি বারের জন্যও কোথাও যাইনি। হাসপাতালে আসলে থাকার মত আর কেউ ছিল ও না।
এই কঠিন সময়ে আমি আমার সাংগঠনিক বোনদের সীমাহীন সাপোর্ট পেয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ। আমার বাচ্চাদের একদিন ও স্কুল মিস হয়নি। পালাক্রমে একেকদিন একেক বোন আমাদের বাসায় আসতেন, বাচ্চাদের গোসল-খাওয়া এই বিষয়গুলো দেখতেন। সন্ধ্যায় আমার ছোট বোন আসা পর্যন্ত বাচ্চাদের সময় দিতেন। এবং সার্বিক তত্ত্বাবধান করার জন্য Akter Happy আপু এবং Nasrin Jahan আপুর কাছে আমি অনেক ঋণী। আল্লাহ তাআলা আমার এ সাংগঠনিক বোনদের দুনিয়া ও আখেরাতের সকল বিপদ দূর করে দিন। তাদের সমস্ত ভালো কাজে আল্লাহ তাআলা বারাকাহ দিন। আমীন।
দীর্ঘ ১১ দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর ফেব্রুয়ারীর ৫ তারিখে তাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হয়। আমি Syeda Sharmin Adhora এবং আমার মাননীয় শ্রদ্ধেয় বর Syed Sorwar বাসায় আসলাম। আমার বাচ্চাদেরকে দীর্ঘ ১১ দিন পর দেখলাম। আল্লাহ তাআলার অশেষ রহমতে আমার বাচ্চাগুলোর কোন অভিযোগ অনুযোগ ছিল না।
সেই মহান সত্তা আল্লাহ তাআলার কাছে অশেষ শুকরিয়া, যিনি জীবন-মৃত্যুর মালিক, যিনি বিপদ দেন এবং সেখান থেকে তিনিই উদ্ধার করেন, যিনি দুআ কবুল করেন, যিনি বড়ই মেহেরবান, বড়ই দয়াময়।
আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ।
চলবে....
শারমিন
লন্ডন, অন্টারিও, কানাডা
আমাদের কানাডায় আসার গল্প (পর্ব ১)
https://www.facebook.com/share/p/1DbCA9z62N/
আমাদের কানাডায় আসার গল্প (পর্ব ২)
https://www.facebook.com/share/p/1Ci88imVyD/
আমাদের কানাডায় আসার গল্প (পর্ব ৩)
https://www.facebook.com/share/p/1AY8bPpFXT/