16/11/2023
আসসালামু আলাইকুম।
আমরা প্রায়ই অভিভাবকদের থেকে একটা কথা শুনতে পাই - বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন সন্তানের সাথে উনি কিভাবে কাজ করবেন, কি কাজ এবং কেনো নিয়মিত অনুশীলন করাতে হবে, অর্থাৎ বাসায় সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনা কি হবে এটা বুঝেন না জন্য ঠিক ভাবে পরিচর্যা করাতে পারেন না এবং দিনে দিনে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পারিবারিক অশান্তি শুরু হয়।
বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের জন্য প্রয়োজন বিশেষ যত্ন, নিবিড় পরিচর্যা ও প্রশিক্ষণ।
একজন মা যখন জানতে পারেন তার সন্তান সমবয়সী অন্য শিশুর চেয়ে বিকাশে পিছিয়ে আছে, মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যা রয়েছে তখন উনি মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন। নানান দুশ্চিন্তা ভর করে।
ডাক্তার প্রেসক্রাইব করেন স্কুলিং এবং থেরাপি সেবা নেওয়ার জন্য। থেরাপি সেবা নেওয়া শুরু করলেও বিপত্তি বাঁধে স্কুলিং নিয়ে। অভিভাবকগণ বুঝতে পারেন না যে কোথায় স্কুলিং করাবেন। বিভিন্ন স্কুলে ঘুরতে থাকেন ভর্তির জন্য। কোনো একটা স্কুলে ভর্তি করালেও নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের থেকে অভিযোগ আসা শুরু হয়। কারণ শিশুটি অন্যদের সাথে মিশতে পারে না /খেলতে পারে না / নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না / কখনো কখনো অন্যদের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে অস্থির হয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করে। সহপাঠীরা যদিও মেনে নেওয়ার চেষ্টা করে বন্ধু হতে চায় কিন্তু তাদের অভিভাবকগণের কড়া নিষেধ থাকে ওর সঙ্গে মেশা যাবে না, কথা বলা যাবে না, আরো অনেক ধরনের শব্দমালা ব্যবহার করে থাকে যা কম বেশি সব অভিভাবকের জানা।
আবার অনেক সময় সব কিছু ঠিক থাকলেও বিশেষ শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষকের কোনো প্রশিক্ষণ থাকেনা কিভাবে এই শিশুদের ম্যানেজমেন্ট দিতে হয়। ফলে শিশুর বিশেষ কোনো উন্নতি পরিলক্ষিত হয় না।
বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের বিকাশের জন্য বিশেষ শিক্ষা বা স্পেশাল এডুকেশন অনেক জরুরী। বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় বয়স একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শিশুকে যত দ্রুত বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থাপনার অন্তর্ভুক্ত করা যাবে ততই মঙ্গল।
আসুন তবে বিশেষ শিক্ষা সম্পর্কে জানি -
বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের জন্য অর্থাৎ যারা মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যা, শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধির দিক দিয়ে পিছিয়ে রয়েছে এমন শিশুদের শিক্ষা দানের জন্য যে বিশেষ ব্যবস্থায় শিক্ষাদেওয়া হয় তাকে বিশেষ শিক্ষা বলে। যেমন - বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা উপকরণ, ব্যক্তিভিত্তিক নির্দেশনা, শিক্ষা পরিকল্পনা, সহযোগিতার মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান করলে শিশু বিশেষ ভাবে উপকৃত হয় এবং শিখন তরান্বিত হয়।
সব ধরনের প্রতিবন্ধিতার সাথে বিশেষ শিক্ষা জড়িয়ে আছে। যেমন - অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিসওর্ডার, এডিএইচডি, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, শিক্ষণ প্রতিবন্ধী, ইন্দ্রিয়গত প্রতিবন্ধী, শারীরিক প্রতিবন্ধী ইত্যাদি। বিশেষ শিক্ষার ব্যাপ্তি অনেক বড়। বিশেষ শিক্ষায় শিক্ষার্থীর সমস্যা নির্ণয় করে তা থেকে বের হওয়ার জন্য ব্যক্তিভিত্তিক কর্ম পরিকল্পনা প্রনয়ণ করে যথাযথ ইন্টারভেনশন এর ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
বিশেষ শিক্ষার লক্ষ্য:
বিশেষ শিক্ষার লক্ষ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীর প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী যাতায়াতের ব্যবস্থা গ্রহণ, শ্রেণীকক্ষের পরিবেশ, প্রয়োজনীয় সহায়ক উপকরণ এর ব্যবস্থা করা যাতে শিক্ষার্থী বাঁধা অতিক্রম করে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। বিশেষ শিক্ষার সাথে বিশেষ শিক্ষাক্রম, সহায়ক উপকরণ যেমন - হুইল চেয়ার, বিশেষ ধরনের চেয়ার, বিশেষ ধরনের শিক্ষা উপকরণ, শ্রেণীকক্ষের পরিবেশ ইত্যাদি জড়িয়ে আছে। বিশেষ শিক্ষা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন পরিবেশে দেওয়া যায়। যেমন - সাধারণ শ্রেণী কক্ষে বিশেষ শিশুদের জন্য বিশেষ পরিবেশ সৃষ্টি এবং বিশেষ উপকরণের সাহায্যে, সাধারণ স্কুলে বিশেষ শ্রেণীকক্ষ তৈরি করে অথবা বিশেষায়িত স্কুল তৈরি করে।
বিশেষ শিক্ষার উদ্দেশ্য :
বিশেষ শিক্ষার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীর শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে সামাজিক ও আবেগীয় আচরণ শেখানো, যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধি করা, আত্মনির্ভরশীল হতে সহায়তা করা। অর্থাৎ বিশেষ চাহিদা অনুযায়ী সকল সুবিধা নিশ্চিত করা যেন শিশু শিক্ষা গ্রহণ করে সমাজের মূল স্রোতোধারায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রম সরকারি ভাবে প্রণীত আইন। যা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক শিক্ষা গ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করে। যেমন - যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু ও তার পরিবারের অধিকার ও সুরক্ষার জন্য সরকার প্রণীত আইন "The Individuals with Disabilities Education Act (IDEA) রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের শিক্ষা অধিকার ও সুরক্ষার জন্য আইন রয়েছে।
বাংলাদেশে সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কিত সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা রয়েছে। রয়েছে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন।
বিশেষ শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা:
#অন্তর্ভুক্তিকরণ: শিশুর শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা।যেন শিশু শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায়।
#সমস্যানির্ণয়বাসনাক্তকরা: সর্বপ্রথম শিক্ষার্থীর সমস্যা নির্ণয় করা হয় একটি মাল্টি ডিসিপ্লিনারি টিমের সাহায্যে। এই টিমে ডাক্তার, থেরাপিস্ট, স্পেশাল এডুকেটর, সাইকোলজিস্ট,পুষ্টিবিদ এর সমন্বয়ে গঠিত হয়ে থাকে। উক্ত টিম এসেসমেন্ট করে সমস্যা সনাক্ত করেন এবং পরবর্তী ব্যবস্থাপনা গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করেন।
#ব্যক্তিভিত্তিকপাঠপরিকল্পনা: শিক্ষার্থীর সার্বিক উন্নতির জন্য ব্যক্তিভিত্তিক পাঠ পরিকল্পনা প্রনয়ণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীর সামর্থ্য, দুর্বলতা, সম্ভাবনা, বিশেষ প্রয়োজনীয়তা, শিক্ষা উপকরণ, শ্রেণীকক্ষের পরিবেশ, সহায়ক উপকরণ, শিখন কৌশল, কাজের ক্ষেত্রসমূহ, স্বল্পমেয়াদী লক্ষ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি লক্ষ্য, অর্জন সব কিছুই পাঠ পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ পাঠ পরিকল্পনা এটা নিশ্চিত করে যে শিক্ষার্থীকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য সকল নির্দেশনা ও সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে।
#একীভূতশিক্ষা: বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় শিক্ষার্থীকে একীভূত শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে একই শ্রেণীকক্ষে বসে শিক্ষা গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করা হয়। সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও তাদের প্রতি সহমর্মিতা, সহপাঠী হিসাবে গ্রহণ করার মানসিকতা তৈরি করতে অনুপ্রাণিত করা হয়।
#শিক্ষাগ্রহণেসহায়তাপ্রদান :
বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের শিক্ষা গ্রহণে নানা ধরনের বাঁধা থাকে। যেমন - ইন্দ্রিয়গত, শারীরিক, আবেগীয়, বুদ্ধিমত্তা, আচরণিক ইত্যাদি। বিশেষ শিক্ষা একটি দলগত শিক্ষা ব্যবস্থাপনা। যেখানে পিতামাতা, স্পেশাল এডুকেটর, থেরাপিস্ট, সাইকোলজিস্ট,নিউরোলজিস্ট, পুষ্টিবিদ সবাই দলগত ভাবে কাজ করে থাকেন। শিশুর চাহিদা অনুযায়ী ইন্টারভেনশনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। উন্নতির জন্য সহায়ক উপকরণ, সহায়ক প্রযুক্তি, পরিবর্তিত শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করে শিক্ষা ক্ষেত্রের বাঁধা অতিক্রমের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
#নির্দেশনা :
শিক্ষার্থী ক্ষেত্রে নির্দেশনাতেও ভিন্নতা থাকবে। শিশুর স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের কৌশল বা পন্থা অবলম্বন করে পাঠদান করা হয়ে থাকে।
#পরিবর্তনমূলকপরিকল্পনা :
বিশেষ শিক্ষাক্রমে অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে পরিবর্তন মূলক পরিকল্পনা। একটি ধাপ অতিক্রম করে যখন অন্য ধাপে উত্তীর্ণ হওয়ার পরে পরিবর্তন সাধিত হয় তা শিক্ষার্থীরা অনেক সময় মেনে নিতে পারে না। ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করতে থাকে। প্রফেশনালগণ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করে থাকেন।
সন্তানের বিশেষ চাহিদা আছে জেনে হতাশ না হয়ে তাকে বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে সাবলম্বী করে গড়ে তুলতে হবে। বিশেষ শিক্ষায় বয়স একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এইজন্য সঠিক বয়সে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে শিশুকে বিকশিত হতে সহায়তা করতে হবে।
রাবেয়া সুলতানা
স্পেশাল এডুকেটর
ASD Mentors