09/07/2025
হোমিওপ্যাথি: শিল্প না বিজ্ঞান?
একটি কার্যকর প্রেসক্রিপশনের জন্য (শিল্প ও বিজ্ঞানের) আদর্শ “মিশ্রণ” কী হতে পারে?
প্রোফেসর জর্জ ভিথউল্কাস
(European Journal of Classical Homeopathy, 1995, Vol.1)
অনুবাদঃ ডাঃ ধীমান রায় (Ph.D.)
গত দুই দশকে আমরা যে হোমিওপ্যাথির পুনর্জীবন এবং পুনরুজ্জীবনের সাক্ষী হয়েছি, তা বর্তমানে একটি অবনতি, বিভ্রান্তি এবং অবশেষে বিস্মৃতির দিকে ধাবিত হওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি করছে। হোমিওপ্যাথির পতনের প্রধান কারণ হবে মূল জ্ঞানের মধ্যে প্রবেশকৃত একাধিক “শিল্পাত্মক বিকৃতি,” যা কিছু “হোমিওপ্যাথি শিক্ষকের” কল্পনা ও প্রক্ষেপণের ফল। অনেক শিক্ষার্থী এ ধরণের কল্পিত গল্প ও মিথের প্রতি গ্রহণশীল হওয়ার কারণে, বহু তথাকথিত শিক্ষক উঠে এসেছেন এই ফাঁক পূরণ করার জন্য।
এই প্রবন্ধের অনুপ্রেরণা এসেছে ডঃ আর. মরিসনের রজন শংকরনের “The Substance of Homeopathy” বই এবং তাঁর শিক্ষাদানের প্রতিরক্ষার প্রেক্ষাপট থেকে। আমি এই সমালোচনাটি বিস্ময় ও উদ্বেগের সাথে পড়েছি। ডঃ মরিসন “Simillimum” জার্নালের খণ্ড ৭, সংখ্যাঃ ৩-এ লিখেছেন: “সম্ভবত শংকরনের বইয়ের সবচেয়ে অনুপ্রাণিত অংশ হলো ওষুধের রাজ্যসমূহ—প্রাণী, উদ্ভিদ, এবং খনিজ। শংকরন দাবি করেন যে, অধিকাংশ রোগীকে এই রাজ্যগুলোর (অথবা একটি নোসোড) একটি অনুযায়ী শ্রেণীবদ্ধ করা যায় সহজেই স্বীকৃত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে। তিনি সিগনেচার তত্ত্ব (the doctrine of signatures)কে আগের সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে গেছেন। তিনি সাহসীভাবে বলছেন যে, ওষুধের ছাপ রোগীর মধ্যে সনাক্তযোগ্য। আমি শংকরনকে মুলত একটি শিল্পাত্মক চিন্তাবিদ এবং গভীরভাবে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে দেখেছি... শংকরন অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ বিজ্ঞানের একটি ক্ষেত্র প্রবেশ করেছেন!”
কিন্তু কিভাবে রোগীর উপসর্গকে স্বেচ্ছাচারী ও সম্পূর্ণ কাল্পনিক ভাবে একটি প্রাণী, উদ্ভিদ, খনিজ বা নোসোডের সাথে “সহজেই স্বীকৃত” মিল পাওয়া যায়, যা অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ বিজ্ঞান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, আমি তা বুঝতে পারি না! যে কোনো উপসর্গের ব্যাখ্যা অনেকরকম হতে পারে একজন চিকিৎসকের দ্বারা। উদাহরণস্বরূপ, যদি রোগী দেখতে শুকরের মতো হয়, তার ওষুধ অবশ্যই প্রাণী রাজ্যের হতে হবে, কিন্তু যেহেতু শুকরের থেকে প্রাপ্ত কোন ওষুধ নেই, আমরা নিকটতম অনুরূপ বেছে নিতে পারি যেমন ব্যাঙ (Bufo), যদিও রোগীর উপসর্গ Baryta carbonica নির্দেশ করতে পারে! আবার রোগী শীতল অনুভব করলে আর সাপ শীতল রক্তের, তাই সাপ বিষের ওষুধ বেছে নেওয়া উচিত? কিন্তু আমরা জানি, সাপ বিষের প্রুভিংয়ে রোগীরা উষ্ণ রক্তের, বিশেষ করে Lachesis, যারা শরীরে অতিরিক্ত তাপ অনুভব করেন।
তাই সহজেই বোঝা যায়, যখন চিকিৎসক তার রোগীকে প্রাণী, উদ্ভিদ বা নোসোড হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করার চেষ্টা করে তখন কতোটা বিভ্রান্তি এবং ভুল ব্যাখ্যার সম্ভাবনা থাকে। এমনকি যদি রোগীকে এই চার শ্রেণির একটি হিসেবে ভাগ করা হয়, তা কি তাকে তার সিমিলিমাম খুঁজে পেতে সাহায্য করবে? উদ্ভিদের ওষুধ বাতিল করবেন কেন যদি রোগীর মধ্যে কুকুরের কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে?
মানসিক পীড়ার (mental disturbance) ক্ষেত্রে, যখন রোগীর ডেলিরিয়ামে(delirium) কামড়ানোর ইচ্ছা দেখা যায়, তখন কি কুকুরের দুধ (Lac Caninum) যা প্রুভিংয়ে এই উপসর্গ নেই, না বরং Stramonium বা Belladonna যাদের প্রুভিংয়ে কামড়ানোর ইচ্ছা আছে, ব্যবহার করবেন? অথবা Hyoscyamus বেছে নেবেন না যিনি কাশি করলে কুকুরের মতো ভোঁকেন, যা তার প্রধান বৈশিষ্ট্য? কুকুর, নোসোড বা উদ্ভিদের সাথে মিল পাওয়া বা তার সদৃশতা খুঁজে পাওয়ার দাবি এতটাই বিষয়ভিত্তিক এবং বহু ব্যাখ্যার সুযোগ রাখে যে তা সম্পূর্ণ অবিশ্বাসযোগ্য।
আমাদের অনেক সময় হোমিওপ্যাথিকে বিজ্ঞান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। কিন্তু এসব অবাস্তব ধারণা আবার সেই যুক্তিকে শক্তিশালী করে যে, হোমিওপ্যাথি “অবিজ্ঞানিক।” এই ধরনের ভাবনা ও অন্যান্য বিষয়, যা আমরা পরবর্তী সংখ্যায় আলোচনা করব, আমাদের বিজ্ঞানের অবনতির লক্ষণ, যার ফল শীঘ্রই আমরা দেখব।
আমার মনে হয়, প্যারিসের এক সমকালীন শিল্প প্রদর্শনীতে আমি যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি তা এখানে বলাই প্রাসঙ্গিক। সেখানে আমরা একটি “শিল্পকর্ম” দেখেছিলাম—সাদা বড় প্যানেল যার উপরে একটি কালো রেখা, মাটিতে রেখার সামনে একটি ইট পড়ে আছে, এবং ইটের পাশে অর্ধ-জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরা। দলের একজন বললেন, সম্ভবত এটা আমাদের সময়ের অবনতির প্রতীক। আরেকজন, যিনি একজন চিত্রশিল্পী, বিদ্রুপ করে বললেন, এটা সম্ভবত শিল্পীর নগ্নতা প্রকাশ করছে! আরেকজন বললেন, এটা পুনর্জীবনের প্রতীক: ছাই ও ইট থেকে কালো, কঠিন রেখার মাধ্যমে স্বর্গের পথে। আমার স্ত্রী গোপনে বলেছিলেন, এটা শিল্পীর অলসতা এবং সেইসব মানুষের পাগলামি প্রতিফলিত করে যারা এমন “রচনাকে” প্রদর্শনীতে গ্রহণ করেছে।
যদি কিছু শিক্ষক হোমিওপ্যাথি বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা এই রকম করেন এবং অন্যরা তাদের ব্যাখ্যাকে প্রশ্ন না করেন, তবে আমরা শীঘ্রই দেখতে পাব এই বিজ্ঞান একটি “অ্যাবস্ট্রাক্ট হজপজ” (“abstract hodgepodge”) এ রূপান্তরিত হচ্ছে, যা কিছু কল্পনাশীলদের উচ্ছ্বাস দেবে কিন্তু বহুজনকে বিভ্রান্ত করবে এবং হোমিওপ্যাথির অনুসারীদের সংখ্যা কমিয়ে দেবে।
যখন ওষুধ নির্বাচনে এই ধরনের কল্পনা প্রধান ভূমিকা রাখে, তখন ব্যাখ্যা হয় অত্যন্ত বিষয়ভিত্তিক, বহুবিধ, এবং বৈজ্ঞানিকতার থেকে দূরে। আমি গবেষণা, অনুমান, শুদ্ধ কল্পনা বা মতবাদ নিয়ে বিপত্তি নেই, যতক্ষণ এগুলো গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের অন্তর্গত থেকে যায় এবং পেশার বাকি অংশে “সত্য” হিসেবে উপস্থাপিত হয় না। শংকরন তার পাবলিক সেমিনারে এভাবেই কাজ করেন এবং আমরা পরবর্তী সংখ্যায় তাঁর “সিগনেচার” নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব যেখানে আমরা সত্য ও মিথ্যা আলাদা করার চেষ্টা করব।
অবশ্যই, আমরা একটি উন্মত্ত বিভ্রান্তিমূলক বিশ্বে (crazy world) বাস করছি যেখানে বাস্তব জ্ঞানের মাঝে বিভ্রান্তি, প্রক্ষেপণ ও ভুল তথ্য মিশ্রিত। কিন্তু আমাদের কাজ হল হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক হিসাবে এই অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ ও যুক্তিসঙ্গত করে তোলা।
আমাদের বিজ্ঞান আজ “অনিশ্চয়তার একটি স্তর” গ্রহণ করে, যেখানে অনেক সময় “শিল্পাত্মক বা অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ ব্যাখ্যা” প্রবেশ করে যা প্রত্যেকে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পূরণ করতে পারে। কিন্তু রোগীর সংবেদন ও অনুভূতিকে তার বাস্তব অর্থের বাইরে ব্যাখ্যা করা হোমিওপ্যাথিদের জন্য বিপজ্জনক পথ। আমাদের অবশ্যই মানব কষ্টের বাস্তবতা উপলব্ধি করে ওষুধের প্রুভিং থেকে রোগনির্ণায়ক ছবি মেলানোর চেষ্টা করতে হবে। রোগীর স্বাস্থ্যের জন্য আমাদের ছোট তত্ত্ব বা কল্পনা আবিষ্কার করা উচিত নয়। অতিরিক্ত “শিল্প” বা “অন্তর্দৃষ্টি” হোমিওপ্যাথির পতনের কারণ হবে, কারণ চিকিৎসকগণ এই পরিস্থিতিতে বিজ্ঞান প্রয়োগ করতে গিয়ে ব্যর্থ ও হতাশ হবেন।
হোমিওপ্যাথি প্রয়োগে কঠিন হলেও, অনেকেই নতুন, সহজ, অলৌকিক ও ঝামেলামুক্ত পথ খুঁজে পেতে চান। কিন্তু এই শর্টকাটও তার নিজস্ব সীমাবদ্ধতা নিয়ে আসবে এবং হোমিওপ্যাথির অবসান ত্বরান্বিত করবে। শীঘ্রই সৎ উদ্দেশ্য ও উৎসাহে শিক্ষার্থীরা এই “শিল্পাত্মক ব্যাখ্যা” দ্বারা প্রলোভিত হয়ে হতাশ হবেন এবং হোমিওপ্যাথি ছেড়ে দেবেন। দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি অপরিবর্তনীয় হবে।
আমার কাছে বড় প্রশ্ন হলো, “হোমিওপ্যাথি বিজ্ঞানের সাথে ‘শিল্প’ বলতে আমরা কী বুঝি? এটা কতদূর নেওয়া উচিত? আমাদের এই ধরনের ব্যাখ্যা স্পষ্ট করতে হবে।”
রবার্টসের বই “The Art and Science of Homeopathy”-এ কোথাও আমরা “শিল্পকর্ম” বা প্রক্ষেপণ, কল্পনা বা মায়া পাই না। আমাদের বিজ্ঞানের এই “অনিশ্চয়তার নীতি” সবচেয়ে ভালোভাবে কিভাবে পূরণ করা যায়? কিছু নিয়ম থাকা উচিত নাকি কেউ তার নিজস্ব শিল্পাত্মক ইচ্ছেমত ব্যবস্থা করতে পারে? আসলে, আমাদের বিজ্ঞানে শিল্প কি সত্যিই বিদ্যমান? এই “শিল্প” কি শুধুমাত্র রোগীর কাছ থেকে তথ্য আহরণ করার একটি পদ্ধতি, যা সঠিক ওষুধ নির্ধারণে সাহায্য করে?
আমার মতে, এই “শিল্প” কবিতা বা সঙ্গীত নয়, বরং মানব প্রকৃতির দুঃখের বৈশিষ্ট্যগুলির প্রতি একটি গভীর অন্তর্দৃষ্টি। এই তথ্য কি অন্তর্দৃষ্টি থেকে আসে, না কি রোগীর কষ্ট বোঝার অভিজ্ঞতা ও গভীর উপলব্ধি থেকে?
এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পাঠকদের মতামত জানাতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।