28/09/2025
আমরা কিন্তু কথায় কথায় এই সাক্ষীর ব্যবহার করি! এই যেমন এমনকি আড্ডায় যদি কেই বলেন যে পরের মাসের স্যালারি পেয়ে তোদের ট্রিট দিব তখনও কিন্তু অন্যকে সাক্ষী রেখে আমরা বলি বন্ধু তুমি কিন্তু সাক্ষী থাকলা- ও খাওয়াবে আগামী মাসে! :p কিন্তু কথা হল এই সাক্ষী কিভাবে আমাদের দৈনন্দিন জীবন ব্যবস্থার সাথে আসলো সেটা কি কখনও ভেবে দেখেছি আমরা??
আসলে মানুষের মিথ্যা বলা কিংবা যা মানুষ বলে তার অন্যথা করার প্রবনতাকে ঠেকাতেই এই সাক্ষীর প্রয়োজনীয়তা এসেছে।
"সাক্ষী" (witness) বা সাক্ষ্যদান (testimony) মানব সমাজের বিচারব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত এক প্রাচীনতম ধারণা। এর ইতিহাস বহু পুরনো, আর তা ধর্মীয় বিধান, সামাজিক চুক্তি এবং আইনের বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত।
১. প্রাগৈতিহাসিক ও প্রাচীন সমাজ
আদিম সমাজে বিচার ছিল মূলত গোত্রপ্রধান বা প্রবীণদের হাতে।
অপরাধ বা বিবাদের সময় চোখে দেখা ঘটনা বা শোনা কথা জানানোর জন্য প্রত্যক্ষদর্শী মানুষকে ডাকা হতো।
এভাবেই "সাক্ষী" সমাজে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে।
২. ধর্মীয় গ্রন্থে সাক্ষীর ধারণা
হাম্মুরাবির আইন (Hammurabi’s Code, খ্রিস্টপূর্ব 1754 খ্রিঃ) – এখানে বলা হয়েছে, জমি-বিবাদ, দেনা-পাওনা বা অপরাধ প্রমাণে সাক্ষীর বক্তব্য আবশ্যক।
তৌরাত (ইহুদি ধর্মগ্রন্থ) – বলা আছে, “দুই বা তিনজন সাক্ষী ছাড়া কোনো বিষয় প্রমাণিত হবে না।” (Deuteronomy 19:15)।
কুরআন – ঋণ-লেনদেনের ক্ষেত্রে লিখিত দলিলের পাশাপাশি সাক্ষী রাখার নির্দেশ আছে (সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত 282)।
মনুস্মৃতি (হিন্দু শাস্ত্র) – বিচার ব্যবস্থায় সাক্ষীর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, এবং সাক্ষী মিথ্যা বললে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।
৩. গ্রিক ও রোমান যুগ
প্রাচীন গ্রিসে আদালতে যুক্তি-তর্ক চলত, আর সাক্ষীর ভূমিকা ছিল প্রধান।
রোমান আইন (Roman Law) সাক্ষ্যকে আইনি প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করে এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে কঠোর শাস্তি দিত। এখান থেকে ইউরোপের আধুনিক আইনের ভিত্তি তৈরি হয়।
৪. মধ্যযুগ ও ইসলামি শরীয়ত
ইসলামি খিলাফতের আদালতে সাক্ষ্য (شهادة – শাহাদাহ) ছিল অন্যতম মূল প্রমাণ।
ইসলামী ফিকহে সাক্ষীকে নির্দিষ্ট যোগ্যতার অধিকারী হতে হতো – যেমন সৎ, প্রাপ্তবয়স্ক, নিরপেক্ষ ব্যক্তি।
মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া ইসলাম ধর্মে অন্যতম বড় গুনাহ।
৫. আধুনিক আইনব্যবস্থা
ইংরেজ কমন ল’ (Common Law) আদালতে সাক্ষীর জবানবন্দি প্রমাণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
পরে প্রমাণ আইন (Evidence Act) তৈরি হয়, যেখানে সাক্ষীর বক্তব্য গ্রহণ ও মূল্যায়নের নিয়ম নির্ধারিত হয়।
আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে Evidence Act, 1872 সাক্ষ্যগ্রহণের বিধান দেয়, যা বাংলাদেশেও কার্যকর।
সংক্ষেপে বলা যায়:
সাক্ষীর ধারণা এসেছে মানুষের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বাভাবিক প্রয়োজন থেকে। প্রথমে এটি ছিল সামাজিক বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল, পরে ধর্মীয় গ্রন্থগুলো তা শক্ত ভিত্তি দেয়, এবং শেষে রাষ্ট্রীয় আইন সাক্ষ্যকে আইনি প্রমাণ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
বাংলাদেশে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া ফৌজদারি অপরাধ।
দণ্ডবিধি, ১৮৬০ (Penal Code, 1860)
ধারা ১৯৩ – আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে ৭ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং জরিমানা হতে পারে।
ধারা ১৯৪ – যদি মিথ্যা সাক্ষ্যের কারণে কারও মৃত্যুদণ্ড হয়, তবে সাক্ষীর আজীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে।
সুতরাং মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া থেকে আমরা বিরত থেকে একটি সুন্দর এবং সুশৃংখল সমাজ গড়তে চলুন একসাথে কাজ করি।