02/09/2025
ছোটবেলা থেকেই ওজন একটু বেশি হলেও খেলাধুলার প্রতি আমার তীব্র ঝোক ছিল। যেকোন মূল্যে ক্রিকেট, ফুটবল অন্যান্য খেলা করতাম। মেডিকেল কলেজে ৩য় বর্ষে '১৬ সালে ভলিভল খেলতে গিয়ে পা মচকে গিয়ে পড়ে যাই। সেখান থেকেই যে শুরু বুঝতে পারিনি। একটু ভালো হলে আবার খেলতে যাই ফলশ্রুতিতে হাটুর লিগামেন্ট এর যতটুকু ক্ষতি হওয়া বাকি ছিল সেটিও সম্পন্ন হয় (কৃতিত্বের!!) সাথে।
আমার কাছে অনেকেই আমার সেই জার্নি জানতে চান। আমি যদিও অর্থোপেডিক সার্জন না, তবুও নিজের অভিজ্ঞতার আলোকেই লিখেছিলাম আমার অপারেশন এর ৬ মাস পর। সকলের সুবিধার্থে সেই লেখাটা আমি শেয়ার করছি।
MRI করে নিয়ে প্রথম যখন হাসপাতালের এক স্যারকে দেখালাম, স্যার বললেন, "তুমি তো সেলিব্রিটি হয়ে গেছ"!!! প্রথমে না বুঝলেও পরবর্তীতে বুঝলাম এই ইঞ্জুরি সাধারণত সেলিব্রিটিদের হয়, এই যে মাশরাফি, কিছুদিন আগে নাসিরের ও হল, আর ফুটবলারদের জন্য তো আরো কমন। খেলোয়াড়দের সাধারণত যে ইঞ্জুরি হয় তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমন হল ACL ইঞ্জুরি। আমার সার্জারি করার পর অনেকেই বিভিন্ন সময়ে জানতে চেয়েছে এ ব্যাপার নিয়ে। আমার ন্যুনতম বিদ্যা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে নাতি দীর্ঘ বক্তব্য ঃ
★প্রসঙ্গ ঃ Anterior cruciate ligament (ACL) injury.
★উপসর্গঃ
লিগামেন্ট এর কাজ হল এক হাড়ের সাথে অন্য হাড়কে যুক্ত করে বিভিন্ন দিকে তার মুভমেন্ট নিয়ন্ত্রণ করা। হাটুকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এরকম চারটি লিগামেন্ট আছে Anterior & posterior crutiate ligament, medial & lateral collateral লিগামেন্ট। এই চারটি লিগামেন্ট মিলে হাটুকে নির্দিষ্ট রেঞ্জ এর মধ্যে ঘুরতে সাহায্য করে। Anterior crutiate লিগামেন্ট হাটুকে সামনের দিকে অতিরিক্ত প্রসারিত হওয়া থেকে এবং ভিতরের দিকে অতিরিক্ত ঘুরে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। আর ইঞ্জুরিগুলোর মধ্যে এই ACL ইঞ্জুরিটাই বেশি হয়।
একারনেই এ ধরনের ইঞ্জুরিতে হাটতে গেলে মাঝে মাঝেই হাটুটা হঠাত করে ভেতরের দিকে ঘুরে যায়, সমতলে হাটতে অতটা অসুবিধা না হলেও উচু নিচু স্থানে হাটাটা খুবই কঠিন, সিড়ি দিয়ে উঠানামা করার সময় অনেক সতর্ক থাকতে হয়। অনেক সময় লিগামেন্ট ইঞ্জুরির সাথে মেনিস্কাস ও কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেক্ষেত্রে ব্যাথার পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়, ফূটবলে কিক দেয়া বা পায়ের উপর কোন ওজন চাপানো অনেক কঠিন হয়ে যায়।
★কারণ ঃ যেকোনো খেলাধুলা করতে গিয়ে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ফুটবল খেলতে গিয়ে, অনেক সময় ভারী কিছু তুলতে গিয়ে পায়ে বেশি চাপ পড়ে গেলে, কোন গর্তের মধ্যে পা পড়ে ঘুরে গেলে লিগামেন্টের নিদৃষ্ট রেঞ্জ এর বেশি ঘুরে গেলেই লিগামেন্ট ছিড়ে যেতে পারে। লিগামেন্ট হল অসংখ্য ফাইবারে তৈরি রশির মত। অল্পসংখ্যক ফাইবার ছিড়ে গেলে বলে আংশিক টিয়ার ( Partial tear), সবগুলো ফাইবার ছিড়লে বলে Complete tear.
★যে ভুল গুলো আমরা সচরাচর করি ঃ লিগামেন্ট ইঞ্জুরিটা খুব খারাপ। যেকোনভাবে আঘাত পেলে আমরা সাধারণত একটা এক্সরে করি। কিন্তু এক্স রে তে লিগামেন্ট ইঞ্জুরি বুঝা যায় না। আমরা দু এক দিন ব্যাথানাশক ঔষধ খাবার পর ব্যাথা কমে কিছুটা স্বাভাবিক হলে আবার খেলাধুলা অথবা দৌড়ঝাপ করা শুরু করি। আগেরবার আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া লিগামেন্টটা এবার পুরো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ষোলকলা পূর্ন করে।
★🩺🩺চিকিৎসা ঃ Partial tear এর ক্ষেত্রে প্রথাগত ( Conservative) চিকিৎসা যদি সাথে instability না থাকে, এক্সারসাইজ এগুলো কিছুটা উপকারী হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডেফিনিটিভ সার্জারিই এর একমাত্র সল্যুশন,(partial tear with instability)। Complete tear হলে তো অবশ্যই।
যে উন্নত মানের সার্জারি এক্ষেত্রে করা হয় সেটা হল Arthoscopic repair of ACL. হাটুর মধ্যে ছিদ্র করে প্রথমে ক্যামেরা ঢুকানো হয় যা বড় পর্দায় দেখে ক্ষতিগ্রস্ত লিগামেন্ট কে অপসারণ করেন সার্জন। পরবর্তীতে শরীরের অন্য আরেকটা অংশ থেকে graft নিয়ে হাটুর উপরের হাড় ফিমার ও নীচের হাড় টিবিয়াতে দুটি ছিদ্র করে স্ক্রু দিয়ে লাগিয়ে দেয়া হয়। স্ক্রু টা বায়ো এবসরবএবল অর্থাৎ শরীরের মধ্যেই ধীরে ধীরে মিশে যাবে। গ্রাফট টা ধীরে ধীরে পূর্নতা পেয়ে লিগামেন্ট এ পরিনত হতে থাকে এবং হাটু তার ফাংশন ফিরে পেতে শুরু করে।
🔉জটিলতা ঃ সবচেয়ে বড় কষ্ট হল, এর চিকিৎসা সময়সাপেক্ষ এবং ধৈর্য সাপেক্ষ ব্যাপার। পুনর্বাসন প্রক্রিয়াটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং নিয়মিত ফলোআপ এর প্রয়োজন হয়। মানসিক ভাবে শক্ত থাকাটা তাই জরুরি। পুরোপুরি ভাবে ভাল হতে ৬ মাস থেকে ১ বছর সময় লাগে। কখনো কখনো সময়টা ২ বছর ও হতে পারে। মোটামুটি ২ মাস ক্রাচে ভর দিতে চলতে হয়, হাটুর উপর যেকোনো ধরনের চাপ দেয়া থেকে সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়।
চিকিৎসা কোথায় পাবেন ঃ অন্যতম কমন ইঞ্জুরি হলেও এটার চিকিৎসা খুব কম জায়গাতে দেয়া হয়। কিছুদিন আগেও এর কোন চিকিৎসা আমাদের দেশে ছিলনা। এখন আমাদের দেশেই এটার উন্নত চিকিৎসা শুরু হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান এর মধ্যে NITOR ( পঙ্গু হাসপাতাল নামে পরিচিত) এবং বেসরকারি ভাবে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এ শুরু হয়েছে। এই চিকিতসার জন্য তাই বিদেশ যাবার প্রয়োজন নেই। চিকিৎসা এবং সঠিক পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের দেশের সীমিত সংখ্যক আর্থোস্কপিক সার্জন এখন পর্যন্ত অনেককেই সুচিকিৎসা দিয়ে চলেছেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায় বাংলাদেশ যে অনেক এগিয়েছে আর্থোস্কপিক সার্জারির মত অতি আধুনিক সার্জারিই তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
🏅বিঃদ্রঃ সাধারণ মানুষ এমনকি স্বাস্থ্য সেবার সাথে জড়িত আমার মত অনেকেই আছে যারা এটা সম্পর্কে খুব কমই জানি তাদেরকে জানানোর জন্যই আমার এই অভিজ্ঞতা শেয়ার মাত্র। পুথিগত বিদ্যার চেয়ে অভিজ্ঞতার কথায় বেশি লিখেছি। লেখায় ভুল থাকলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার।
আহবান। শুধুমাত্র সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যেই লেখা।
★লেখাটি ৮ বছর আগের। এই ৮ বছরে চিকিৎসা বিদ্যা অনেক দূর এগিয়েছে। ACL সার্জারি এখন অনেক জেলা শহরেও হচ্ছে। এবং আমি সার্জারি করে ৮ বছর ধরে ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ। তবে সকল সার্জারীর কিছু কম্পলিকেশন রয়েছে। সেটি হয়তো সময় ও ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়।
পরিশেষে, এত দীর্ঘ সময় ধরে লেখাটা পড়ার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
নিজে জানুন, অন্যকে জানান, সচেতন হোন।
আল্লাহ হাফেজ।