16/04/2025
"জানতে হবে অভিভাবকদেরও" পর্ব ১
বর্তমান সময়ে সব অভিভাবক সন্তানের পড়াশোনা নিয়ে চিন্তিত। তারা চান তাদের সন্তানরা স্কুলে যেন প্রত্যেকটি বিষয়ে একশোর মধ্যে একশো অথবা গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ মার্ক নিয়ে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়। কিন্তু সেই সব অভিভাবকদের বলছি আদৌ কি আপনার সন্তান উত্তীর্ণ হয়েছে? একবার ভেবে দেখুন তো-
আমি যদি বিষয়গুলোকে এভাবে বিশ্লেষণ করি তাহলে কি দাঁড়ায় -
# লেখাপড়া: বাংলা, অংক , ইংরেজি প্রত্যেকটি বিষয়েই ১০০ তে পচানব্বই তাহলে আমি গড়ে ধরে নিলাম আপনার সন্তান জিপিএ ফাইভ পেয়েছে।
# মানবিকতা: আপনার সন্তানটি কতটুকু মানবিক হয়েছে সেটা কি কখনো আপনি খেয়াল করেছেন ? উদাহরণস্বরূপ, রাস্তায় কখনো ভিক্ষুককে দেখলে এগিয়ে গিয়ে কখনো কি আপনাকে বলেছে- মা কিছু টাকা অথবা খাবার দাও ভিক্ষুককে দিয়ে আসি। কিংবা আমার তো অনেকগুলো ড্রেস আছে পুরনো ড্রেসগুলো নিচের বস্তির গরিব বাচ্চাদের দিয়ে আসি। যদি উত্তর হয় হ্যাঁ তাহলে এখানেও সে জিপিএ ফাইভ আর যদি উত্তর হয় না তাহলে সে মানবিকতায় জিরো।
# নৈতিকতা: প্রত্যেকটি মানুষেরই নৈতিকতা একটা বিরাট গুণ এবং এটা আসে পরিবার থেকেই। আপনি কি কখনো খেয়াল করেছেন আপনার সন্তানটি সত্য কথা বলেছে কিনা। কিংবা কখনো অন্যকে ঠকানোর চেষ্টা করছে কিনা, মিথ্যা বলে আপনার কাছে নিজেকে বড় করছে কিনা। যদি উত্তর হয় না তাহলে এখানে সে গোল্ডেন ফাইভ । আর যদি উত্তর হয় হ্যাঁ তাহলে কিন্তু নৈতিকতায় জিরো।
# দায়িত্ববোধ: কখনো কি খেয়াল করেছেন! আপনার সন্তানকে যে দায়িত্বটা দিচ্ছেন সেটা সঠিকভাবে পালন করছে কিনা, ধরুন তার ছোট ভাই বোনের প্রতি সে কতটা দায়িত্ববান। অথবা সংসারের টুকি টাকি কাজের প্রতি সে কতটা দায়িত্ববান ।আপনি অসুস্থ থাকলে সে কি কখনো আপনাকে হেল্প করে কিনা কিংবা নিজের পড়াশোনাটাই কখনো দায়িত্ব নিয়ে শেষ করে কিনা, যদি উত্তর হয় হ্যাঁ তাহলে এখানে গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ আর যদি হয় না তাহলে জিরো অথবা এভারেজ।
# ধার্মিকতা: প্রত্যেকটি ধর্মেরই নিজস্ব কিছু নিয়ম কানুন আছে। কখনো কি দেখেছেন আপনার সন্তান ধর্মের প্রতি আগ্রহ আছে কিনা, সে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া, কোরআন পড়া, বাইরে যাওয়ার আগে হিজাব মেনটেন করা, সব সময় সত্য কথা বলা , বড়দের শ্রদ্ধা এবং ভক্তি করা এ সব ব্যাপারে সে পানচুয়াল। যদি উত্তর হয় হ্যাঁ তাহলে সে গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ আর যদি হয় না কিংবা মোটামুটি তাহলে সে এভারেজ।
# সামাজিকতা: পাশাপাশি একই সাথে ২-৩ জন ছেলেমেয়ে থাকলে যদি দেখেন আপনার সন্তান চকলেট গুলো তাদের সাথে ভাগাভাগি করে খাচ্ছে না। অথবা যেকোনো পরিবেশে গেলে মুরগির লেগ পিস খাওয়ার জন্য রাগারাগি বা মন কষাঘষি করা, তাহলে বুঝা যাবে তার সামাজিকতার অভাব। কারণ সে বুঝতে পারছে না কিছু কিছু পরিবেশ আছে যেখানে পরিবেশ পরিস্থিতি মেইনটেইন করতে হয়। যদি এমনটি না হয় তাহলে আপনার সন্তান জিপিএ ফাইভ আর যদি হয়ে যায় তাহলে জিরো।
# স্পর্শকাতরতা: কখনো কি খেয়াল করেছেন আপনার সন্তানটি অন্যের দুখে কাঁদে কিনা বা অন্যের সুখে হাসছে কিনা বিপদে পড়লে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে কিনা। অথবা যেকোনো সামাজিক কাজে নিজেকে আগ্রহী করে তুলছে কিনা , যদি উত্তর হা হয় তাহলে সে জিপিএ ফাইভ আর যদি না হয় তাহলে কিন্তু সে জিরো ।
এবার অংকটা হিসাব করে ভেবে দেখেন তো আপনার সন্তানের অবস্থানটা কোথায়? সে কি গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ, নাকি জিরো, নাকি এভারেজ।
এরকম অনেক বিষয় আছে যেগুলো হয়তো আমরা বাচ্চাদের বেলায় কখনো খেয়ালই করি না, ভাবি বড় হোক সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আপনার সন্তান আপনার কাছে কখনোই বড় হবে না। সে সব সময় ছোটই থেকে যাবে। সে বড় হবে অন্যের কাছে আর এর জন্য অন্যরা আপনার সন্তানের ভুল ত্রুটি গুলো ধরতে চেষ্টা করবে। কারণ আমাদের তো দরকার আমার সন্তান বড় হয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী এবং বড় ধরনের অফিসার হবে। কিন্তু আমরা কখনো এটা ভাবি না, আমার সন্তান আর যাই হোক ভালো একজন মানুষ হবে। নৈতিকতা, পারিপার্শ্বিকতায়, শিক্ষায়, আধুনিকতায় সব কিছু মিলে সে পরিপূর্ণ একটি মানুষ হবে।
যদি এটা ভাবেন আমার সন্তানের এত কিছু প্রয়োজন নেই সে শুধু স্কুলে ফার্স্ট হলেই হবে তাহলে হয়তো আপনার সন্তান ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা বড় কোন অফিসার হবে কিন্তু আপনার অবস্থান হবে বৃদ্ধাশ্রমে(সবার ক্ষেত্রে নয়) । কেননা তাকে আপনি নৈতিকতা, আদর্শতা, পারিবারিকতা, স্পর্শকাতরতা এগুলো সম্পর্কে কোন শিক্ষা তাকে দেননি। একবার ভেবে দেখুন তো বর্তমান সময়ে এত এত বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠেছে তার জন্য শুধুমাত্র কি সন্তানরা দায়ী? আপনি, আমি আমাদেরকি কোন দায়বদ্ধতা নেই? আমাদের কি কোন ভুল ত্রুটি ছিল না আমাদের সন্তানকে বড় করার পিছনে! জবাবটা আপনারাই দিবেন।
(চলবে...)
বিশেষ দ্রষ্টব্য: শুধুমাত্র অসচেতন অভিভাবকদের সচেতন করার জন্য আমার এই পোস্ট, কারো মনে আঘাত দেওয়ার জন্য নয়।
ডা. লাবনী আমিন
16.04.2025