12/04/2025
ভোরবেলা। বাহিরে পাখি কিচির মিচির চলছে সাথে হালকা রোদ। এই দেখে ভাবলাম সাইকেল নিয়ে বের হওয়া উচিত, সুন্দর পরিবেশটা একটু উপভোগ করা যাক। রোদ উঠলেও তেমন গরম নেই, মনে হচ্ছে শীতের সকাল। সাইকেল নিয়ে বের হওয়ার কোনো মূল উদ্দেশ্য নেই বললেই চলে, দু চোখ যেদিকে যায় সাইকেলও সেইদিকে ঘুরে।
ঘুরতে ঘুরতে অনেকক্ষণ ঘুরে নিজেকে আবিষ্কার করলাম এক অতি পরিচিত ও ঐতিহাসিক জায়গায়। মানুষের কাছে ওই জায়গাটা ঐতিহাসিক না হলেও আমার জন্য এখানে অনেক ইতিহাস আছে। অনেক স্মৃতি, খানিকটা দুঃখ, অধিক হাসির মুহূর্ত, মাঝে মাঝে যুদ্ধ সহ আরো অনেক কিছুই ঘটেছে এইখানে। বলছিলাম ঢাকায় পাশাপাশি অবস্থিত দুটো সরকারি কোয়ার্টারের কথা। জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় এখানে কাটিয়েছি, তবে এ কোয়ার্টারগুলোতে বসবাস করার সৌভাগ্য হয়নি আমার। আমার বাবা সরকারি চাকুরীজীবি নন, একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন প্রায় ২০ বছর ধরে। আমার বাবা থেকে শিখেছি যে কিভাবে এক জায়গাতে এত সময় অনুগত থাকা যায়। কেউ বলতে পারবেন না যে আমার বাবা ফাঁকি দিয়ে এতদিন চাকরি করেছেন, যার সাথেই কথা হয় সবাই আমার বাবার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
যদিও আমি এখানে থাকিনি, কোয়ার্টারের দেয়ালগুলো আমার অনেক চেনা। আমার জীবনের একখণ্ড ইতিহাসের একমাত্র সাক্ষী এরা। ভাবলাম এতদূর যেহেতু এসেছি, ঘুরে দেখি কেমন আছে আমার প্রিয় কোয়ার্টার। সাইকেল নিয়ে একটি কোয়ার্টারের ভেতরে ঢুকলাম। সকাল বেলা তো, দারোয়ান মামাকে ৫০ টাকা দিলাম যে কিছু চা নাস্তা করে নিতে। মানুষের আনাগোনা কম এই কোয়ার্টারে। রাস্তায় দেখি ফারহান মিয়া বের হলেন বাইক নিয়ে ভার্সিটি যাবেন হয়তো, রাজিয়া আণ্টি বের হচ্ছেন নিজের অফিসে যাবেন হয়তো। এরা আমাকে কেউই চিনে না, কিন্তু আমি কম বেশি সবাইকে চিনি। সাইকেল নিয়ে একটু কিছুক্ষণ ঘুরার পরে ছোট মাঠের কোনায় একটামাত্র বেঞ্চিতে বসলাম পানি পান করা দরকার। সাইকেল থাকে পানির বোতলটা বের করে এক ঢোক গেলার পর পানি রেখে দিলাম। পুরো কোয়ার্টার জুড়ে বিভিন্ন ধরনের গাছ লাগানো, সারাদিন ছায়ায় আচ্ছন্ন থাকে সকল বিল্ডিং। বেঞ্চিতে বসে বসে ভাবলাম যে হায় কি দিন কাটালাম, আরো কিছুদিন ওইরকম কাটাতে পারলে মন্দ হতো না। ভাবনায় ডুবে থাকতে থাকতে ভাবলাম পাশের কোয়ার্টারেও ঘুরে আসা দরকার। বের হলাম পাশে যাওয়ার জন্য, ওই একই দারোয়ান মামা আমাকে ঢুকতে দিলেন, টাকা দিতে হলোনা।
এই কোয়ার্টারটা আগেরটার মতোই কিন্তু একটু বড় ও সরব। কোয়ার্টারে ঢুকেই প্রতিটা গলি, প্রতিটা বিল্ডিং এর সামনে দিয়ে সাইকেল নিয়ে এক চক্কর ঘুরলাম। দেখলাম সবকিছু আগের মতোই আছে, নাসিমা আণ্টি রশি থেকে কাপড় নামাচ্ছেন, ফখরুল চাচা ও তার দল বেরিয়েছে কোয়ার্টারের মাঠে ব্যায়াম করবেন বলে, স্কুল ও কলেজপড়ুয়া ছাত্র ছাত্রীরা বের হয়েছে তাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যে। যদিও ভোরবেলা হওয়ায় তাদের সংখ্যা কম, বেশিরভাগই আরো পরে বের হবে। এক কালে আমিও এদের মতোই সকাল সকাল উঠে স্কুল কলেজে দৌড়াতাম, ইউনিভার্সিটি ছাড়া সবকিছু পাশ করার পর মনে হচ্ছে সেই পূর্বের দিনগুলোই সবচেয়ে গুছানো দিন ছিল। আবার দেখি এলাকার মুয়াজ্জিন সাহেব তাঁর বিবিকে নিয়ে বের হয়েছেন বাজারে যাবেন হয়তো, জায়েদ ভাইও দেখি তাসনিম আপুকে সাথে নিয়ে বের হয়েছেন অফিসে যাবেন বলে। যাদেরকে আমি রাস্তায় দেখলাম বা যাদের নাম জানি তারা আমাকে চেনেন না, তাদের সাথে আমার কখনো দেখা বা সামনা সামনি কথাও হয়নি। তবুও তাদের এক বিশেষ কারণে আমি চিনি।
কোয়ার্টারের এক পাশে শুধু ব্যক্তিগত গাড়ি রাখার গ্যারেজ, সেখানে এক খালি গ্যারেজের সামনে সাইকেল থামিয়ে দাঁড়ালাম। দাড়িয়ে থাকতে থাকতে ভাবছি মান্না দে'র "কফি হাউস" গানটার একটি লাইনের কথা: "কতজন এলো গেলো কতজনই আসবে কফি হাউসটাই শুধু থেকে যায়"। আসলেই চমৎকার বলেছেন তিনি; সময়ের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে মানুষ কোথায় না কোথায় চলে যায়, কেউ কোথাও বেশিদিন থেমে থাকে না। আমিও একটু কিছুক্ষণ স্মৃতিচারণ করে বেরুবো বাসার দিকে। বহুদিন পরে প্রিয় জায়গা ঘুরে আবার ফিরে যেতে হবে নীড়ে। ছাত্রছাত্রীরা এখন সকলে বেরুনো শুরু করেছে। আবার সাইকেলের প্যাডেলে চাপ পড়ল, মেইনগেটের কাছাকাছি যাবার এক শর্টকাট দিয়ে ঢুকলাম, জলদি যেন গিয়ে বেরিয়ে যেতে পারি, শর্টকাটের শেষ প্রান্তে দেখলাম এক সাদা স্কাউট পোশাক পরিহিত যুবতী মেয়ে এগিয়ে আসছে। দেখে চিনে ফেললাম, সেও আমার দিকে একপলক তাকালো তারপর চোখ ফিরিয়ে নিলো। আমি তাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলাম, কয়েক মুহূর্ত পরে মনে হলো যে এভাবে যাওয়া ঠিক হবে না, একটু কথা বলে আসি। সাইকেলটা একটু অন্যদিক দিয়ে ঘুরিয়ে আবার তার সামনে আসলাম।
আমার আসা দেখে তিনি আমাকে ছড়িয়ে একটু এগিয়ে গেছেন; এসে ব্রেক চেপে তাকে ডাক দিলাম "এইযে ম্যাডাম, শুনছেন?" তিনি শুনেও না শুনার ভান করলেন।
আমি আবার ডাক দিলাম "এইযে, এতদূর থেকে এসেছি, একটু তো কথা বললেই পারেন।"
এবার সে একটু থমকে দাড়ালো, আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো "আবার কেনো এসেছো এইখানে?"
আমি উত্তর দিলাম "এসেছিলাম এ জায়গাটাকে অনেক মনে পড়ছিল দেখে।"
সে পিছন ফিরে আমার দিকে তাকালো, তার চোখে জানার আগ্রহ "দেখা শেষ? এখন কি চলে যাবে তুমি আবার?"
আমি প্রতিউত্তর দিলাম "এখানে আমাকে ঠাঁই দেওয়ার মতো কোনো ছাদ নেই, এসেছি দেখে আবার ফিরে যেতেই হবে"
সে একটু নিরাশ হলো তারপরেই আবার বলে উঠলো "আমি কলেজে যাবার উদ্দেশ্যে বেড়িয়েছিলাম, তোমার দেখা পাবো কল্পনাও করিনি"
"আমিও আপনাকে বিরক্ত করার উদ্দেশ্যে আসিনি, আমি এসেছি শুধুমাত্র স্মৃতিচারণের লক্ষ্য নিয়ে"
"তা কেমন আছো?"
"আমি আছি বেশ, আপনার অবস্থা বলুন"
"আছি একরকম, সংসারের ঝামেলায়"
এবার আমি একটু ইতস্ততঃ হয়ে বললাম "ভাইয়া তোমাকে ভালো রেখেছে তো?"
সেও চোখে পানি নিয়েই বলল "অনেক ভালো আছি, তবে এখনো আগের মত মনে আনন্দ নেই।"
"আশা করি ওগুলো ঠিক হয়ে যাবে, চিন্তা করিয়ো না।"
এবার সে পুরো কাঁদো কাঁদো সুরে বলে উঠলো "কিন্তু কাব্য! আমিতো তোমার...."
আমি তাকে থামিয়ে দিলাম "এগুলো বলো না নীলা, এভাবে বলতে হয়না; এখনের পরিস্থিতি আর আগের মতো নেই, এগুলো বললে তোমার স্বামীর প্রতি অবিচার হবে।"
সেও আমার এই কথাটা মেনে নিলো। তার চেহারায় তাকিয়ে দেখলাম কি মায়াবী একটা চেহারা; এরূপ চেহারায় কান্না বা দুঃখ মানায় না।
আমি আমার সাইকেলের পকেট থেকে এক প্যাকেট টিস্যু বের করে তার দিকে এগিয়ে দিলাম "নাও, চোখ মুখ মুছে ফেলো, কান্না করাটা তোমাকে মানায় না। চোখ মুখ মুছে একটু পানি পান করো" সে সাবধানে আমার থেকে টিস্যুর প্যাকেট নিয়ে চেহারা মুছে ফেললো।
নিজ বোতল থেকে পানি পান করার পর আমি বললাম "আমি আসি তাহলে, তোমাকে আর বেকায়দায় ফেলতে চাচ্ছি না নীলা। এখন তোমার উপর অনেকের দায়িত্ব আছে, এর মাঝে আমি নিজেকে অপরাধী করতে চাচ্ছি না।"
সে পুনরায় চোখ ছলছল অবস্থায় আমার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো, আমিও এর ফাঁকে একটু তাকে দেখে নিলাম। সেই ছোট্ট নাক, শ্যামলা গায়ের বরণ, কাজল কালো চোখ, চুল সুন্দর করে আঁচড়ানো, ফুলের মতো সুন্দর গাল, উচ্চতা মানানসই, পরিপাটি চলাফেরা; সব আগের মতোই আছে তবে সবকিছুর মধ্যে একটু পরিপক্বতা ভাব এসেছে; দেখে মনে হচ্ছে অনেক বড় হয়ে গেছে আমার চিরপরিচিত নীলা। একটু মন খুশি হলো যে আমি এখনো নিজের পায়ে দাড়াতে না পারলেও, নীলা ঠিকই নিজেকে সামলে এক নতুন জীবন শুরুর দিকে এগিয়ে গিয়েছে। শেষে নীলা হয়তো কিছু একটা বলতে চেয়েছিল, আমি সে সুযোগ তাকে দেইনি, তাকে একটা হাতের ইশারায় বিদায় জানিয়ে পুনরায় প্যাডেলে চাপ দিলাম। আমি তার সামনে চোখের পানি ফেলিনি, মেয়েটা এমনিতে অনেক কষ্ট করেছে, আর কষ্ট বাড়াতে চাইনা তার। এখন আমার উদ্দেশ্য নিজ বাসা, যেখান থেকে উড়ে এসেছি সেই নীড়ে আবার ফিরে যাওয়ার পালা।
- admin