29/07/2025
ম্যালেরিয়া - মানব সভ্যতার শত্রু।
প্রায় পাঁচ দশক আগের কথা। ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলছে তখন। সৈন্যরা মরছে বুলেট ও বোমার আঘাতে। উত্তর ভিয়েতনাম চীনের সমর্থনপুষ্ট আর দক্ষিণ ভিয়েতনাম পাচ্ছিল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পরাশক্তি আমেরিকার সমর্থন। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পেশি শক্তির এই লড়াইয়ে হানা দেয় আরও এক বড় শত্রু/ঘাতক। সে মরণ ঘাতকের নাম ম্যালেরিয়া (Malaria)। প্রচলিত ওষুধে সে ম্যালেরিয়া দমন করা যাচ্ছিল না ঠিকভাবে সে সময়। আমেরিকা অতি দ্রুত উদ্ভাবন করেছে এক ওষুধ যার নাম ম্যাফলোকুইন। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকা সত্ত্বেও ম্যাফলোকুইন দিয়ে বাঁচানো যাচ্ছিল দক্ষিণ ভিয়েতনামের আমেরিকান যোদ্ধাদের। কিন্তু উত্তর ভিয়েতনামের সৈন্যদের কী হবে? যুদ্ধে তো কোনো মিত্রতা নেই। তাই ম্যাফলোকুইন যাচ্ছিল না চীন-সমর্থিত উত্তর ভিয়েতনামে যোদ্ধাদের ম্যালেরিয়া থেকে বাঁচতে।
ভিয়েতনামের যুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা হো চি মিন ও চীনের প্রধানমন্ত্রী মাও সে তুং একই রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই উত্তর ভিয়েতনামের সৈন্যদের বাঁচাতে তাঁরা একত্র হলেন। ম্যালেরিয়া থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন নতুন ওষুধ উদ্ভাবন করা। মাও সে তুং তাঁর দেশের বিজ্ঞানীদের নির্দেশ দিলেন সমাধান খুঁজে বের করার। সমগ্র চীনে প্রায় পাঁচশ বিজ্ঞানী নিয়ে গঠিত হলো এক প্রকল্প। যুদ্ধকালে সব প্রকল্প হতে হয় অতি গোপনীয়। সেটিও ব্যতিক্রম ছিল না। সে প্রকল্পের নাম দেওয়া হলো ‘প্রজেক্ট ৫২৩’। কারণ, কাজটা শুরু হয়েছিল ১৯৬৭ সালের মে মাসের ২৩ তারিখ।
রসায়নবিদেরা হাজারো রাসায়নিক যৌগ পরীক্ষা করছেন। খেটে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। তবে আশানুরূপ ফল মিলছে না। ঠিক সে সময় ৩৯ বছর বয়সের এক নারী ভাবলেন অন্য ভাবনা। প্রচলিত ভেষজ ওষুধ নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। ভেষজ ওষুধ বিক্রেতাদের কাছে গেলেন তিনি। তথ্য সংগ্রহ করলেন। সংগ্রহ করলেন নমুনা। গ্রন্থাগারে খুঁজতে খুঁজতে পেলেন প্রায় দুই হাজার বছরের পুরোনো এক বই। সে অঞ্চলের মানুষের মধ্যে জ্বর নিরাময়ের জন্য দীর্ঘদিন ধরে একটি গাছের নির্যাসের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। সে গাছের আঞ্চলিক নাম চিংহাও (Qinghao)। কিন্তু সে নির্যাস সেবনে রোগ নিরাময়ের হার খুবই কম। কারণ কেউ কখনো জানার চেষ্টা করেনি, সে গাছের নির্যাসে কী কী উপাদান আছে। অজানা এই উপাদান উদ্ঘাটন করতে তিনি গবেষণা শুরু করলেন। সেই দৃঢ় প্রত্যয়ী নারীর নাম টু ইউইউ (Tu Yu Yu)।
কোনো রোগ নিরাময়ের জন্য আমরা যে উদ্ভিদের নির্যাস সেবন করি, সেখানে শুধু একটি রাসায়নিক যৌগ থাকে না, অনেক রাসায়নিক যৌগের মিশ্রণ থাকে। কিন্তু সে রাসায়নিক যৌগগুলোর মধ্যে একটি যৌগই সাধারণত রোগ নিরাময়ে কার্যকর ভূমিকা রাখে। রসায়নে সেটাকে বলা হয় কার্যকরী উপাদান বা কার্যকরী যৌগ (Active ingredient)। অনেক যৌগের মিশ্রণ থেকে সেই কার্যকরী যৌগটি পৃথক করে শনাক্ত করা খুবই কষ্টসাধ্য কাজ। ইউইউ (Yu Yu) নিবিড়ভাবে ডুবে রইলেন সে কাজে। তিনি তৈরি করলেন কয়েক শ নমুনার মিশ্রণ। একটির পর একটি নমুনা পরীক্ষা করতে লাগলেন। সব পরীক্ষার সঠিক পর্যবেক্ষণ করা এবং তথ্য সংগ্রহ করা খুবই শ্রমসাধ্য ও ধৈর্যের কাজ। ইউইউ থামলেন না। তিনি থামতে জানেন না। রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টে কাজ করছেন তিনি। এখানে হাত গুটিয়ে থাকা যায় না, তাহলে অর্জনের সম্ভাবনা হাতছাড়া হয়ে যায়। অর্জনের পথটাই যে কণ্টকাকীর্ণ, সেটা তো ইউইউ ভালো করেই জানতেন। অক্লান্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নিজের উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে একসময় কাঙ্ক্ষিত যৌগ আলাদা (Isolation) করলেন। নিজের ভাষায় সে যৌগের নাম দিলেন চিংহাওসু (Qinghaosu), অর্থাৎ চিংহাও গাছ থেকে পাওয়া। ইংরেজিতে সে যৌগের প্রচলিত নাম হয়ে গেল আরটিমিসিনিন (Artemisinin)।
তাঁর গবেষণা ফলাফল প্রথম উপস্থাপন করলেন ১৯৭২ সালের ৮ মার্চ, নানজিং শহরে। ইঁদুর ও বানরের উপর সফলভাবে সে যৌগের প্রয়োগ হলো। এবার মানুষের ওপর পরীক্ষার পালা। কিন্তু কে হবে স্বেচ্ছাসেবী? ইউইউ কারও জন্য অপেক্ষা করলেন না। নিজেই প্রথম সে ওষুধ খেলেন। বুঝিয়ে দিলেন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়াও জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে মানুষের অসীম সাহস লাগে।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষ হয় ১৯৭৫ সালে। সৈন্যদের বাঁচাতে যে পরশ পাথরের খোঁজে শত শত বিজ্ঞানী কাজ শুরু করেছিলেন, সে পাথর পাওয়া গিয়েছিল যুদ্ধের শেষের দিকে এসে। কিন্তু তাতে কী! পৃথিবীতে যে আরও অসংখ্য ম্যালেরিয়া রোগী রয়ে গেছে। ম্যালেরিয়ার জীবাণু জাতীয়তাবাদ বোঝে না। চীনা কী জাপানি, ভারতীয় কী ফরাসি চেনে না। যোদ্ধা বা পথহারা-আলাদা করে জানে না। আরটিমিসিনিন আশীর্বাদ হয়ে রইল সমগ্র পৃথিবীর জন্য। সে আবিষ্কার খুলে দিল আরও নতুন নতুন ওষুধ আবিষ্কার এবং তৈরির পথ। একটি মানুষের জীবনে এর চেয়ে বড় আর কী পুরস্কার লাগে? ইউইউ নন্দিত হলেন পৃথিবীজুড়ে। অর্জন করলেন বহু সম্মাননা। ২০১৫ সালে পেলেন চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার। চীনের প্রথম নোবেল বিজয়ী নারী হিসেবে তাঁর নাম লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায়।
ম্যালেরিয়ার পাশাপাশি ভিয়েতনাম নাম যুদ্ধের সৈন্যদের মধ্যে কলেরার প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা দেয়।আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ বা ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডাইরিয়াল ডিজিজ রিসার্চ, বাংলাদেশ, সংক্ষেপে আইসিডিডিআর,বি বাংলাদেশে অবস্থিত একটি আন্তর্জাতিক চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে সে সময় কলেরা রোগের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছিল। মূলত এই প্রাণ সংহারক রোগকে মূলোৎপাটিত করার প্রত্যয়েই প্রথম এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি স্থাপিত হয়। এই রোগের বিরুদ্ধে প্রথম কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার কার্যকারণ সৃষ্টি হয়েছে ভিয়েতনাম যুদ্ধ সময়। সে সময় অর্থাৎ ১৯৫৬ সালে সমাজতন্ত্রের বিস্তার রোধকল্পে দক্ষিণ পূর্ব এশীয় চুক্তি সংস্থা (সিয়াটো) গঠিত হয় এবং এই সংস্থা এই এলাকায় যুদ্ধরত অ্যামেরিকান সৈন্যদের স্বাস্থগত নিরাপত্তার তাগিদে কলেরা গবেষণার একটি কাঠামো স্থাপনের জন্য সমর্থন জোগায়। এরই ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের ঢাকায় কলেরা গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। বাংলাদেশ যেহেতু তখন পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত ছিল তাই পাকিস্তান সরকার এবং সিয়াটোর যৌথ প্রকল্পের অধীনে ১৯৬০ সালে এই সংস্থার নাম রাখা হয় "পাকিস্তান কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরি"।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল একটি বৈশ্বিক সংঘাত। প্রায় ৭০ থেকে ৮৫ মিলিয়ন প্রাণের বিনিময়ের ফলে সমর কৌশল এবং সমর প্রযুক্তি খাতে অভাবনীয় অগ্রগতি সাধিত হলেও বিশ্বের ইতিহাসে এর চেয়ে করুন মানব সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয় খুব কমই আছে। যাহোক, এ কথা অনস্বীকার্য যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল বিশ্ব ব্যবস্থাকে আমূলে বদলে দিয়েছে। যুদ্ধের পর এশিয়া ও আফ্রিকায় ঔপনিবেশিকতার অবসান শুরু হয়, যার ফলে অনেক নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র জন্ম নেয় এবং একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে। আর ভিয়েতনাম যুদ্ধের ফলে মানব সভ্যতা পেয়েছে ম্যালেরিয়া ও কলেরার মতো ভয়ংকর মহামারী রোগ থেকে নিস্তার।
লেখক: গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া, যুক্তরাষ্ট্র। তবে কিছুটা পরিবর্তিত সংযোজিত ও পরিমার্জিত।