13/06/2022
থাইরয়েড হরমোন কথোপকথন
২য় ভাগঃ
থাইরয়েড হরমোন বেড়ে যাওয়া ও কমে যাওয়া ছাড়াও আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ রোগ হয়ে থাকে থাইরয়েড গ্রন্থিতে।
১. গয়েটার(Goitar) / গলগণ্ডঃ
থাইরয়েড গ্রন্থিটি যদি বড় হয়ে যায় সেক্ষেত্রে একে গয়েটার(Goiter) বা গলগন্ড বলা হয়ে থাকে। থাইরয়েড গ্রন্থির থাইরয়েড হরমোন তৈরির জন্য আয়োডিন এর প্রয়োজন পড়ে। আয়োডিনের অভাব হলে গ্রন্থিটি হরমোন তৈরি করতে পারেনা ঠিকভাবে। তবুও এটি চেষ্টা করে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় হরমোন তৈরি করতে। ফলস্বরূপ এটি নিজে বড় হয়ে যায় শরীরের হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে। এবং একটা সময় এটি আর পারেনা সেই স্বাভাবিক মাত্রায় হরমোন তৈরি করতে। ফলে হরমোন এর পরিমাণ কমে যায় প্রয়োজনের তুলনায়। এর ফলে আক্রান্ত
ব্যক্তি হাইপোথাইরয়ডিজম রোগে ভোগে।
এজন্য যেসব শিশু বা মানুষ আয়োডিন এর স্বল্পতায় ভুগে তাদের এই রোগ হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তবে বর্তমানে লবণের সাথে আয়োডিন গ্রহণের ফলে এই রোগের প্রাদুর্ভাব অনেকাংশেই কমে এসেছে।
২.থাইরয়েড নডিউল(Nodule) ঃ
থাইরয়েড গ্রন্থিতে টিউমার ও হতে পারে। যাকে নডিউল(Nodule) বলে। এক্ষেত্রে এই টিউমার সংখ্যায় এক বা একাধিক হতে পারে। এবং বিভিন্ন আকারের হতে পারে। তবে টিউমার হলেই সবক্ষেত্রে ক্যান্সার হয়না। অবস্থা বেশি খারাপ হলে এবং কোনো চিকিৎসা না নেয়া হলে এটি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। যাকে বলা হয় থাইরয়েড ক্যান্সার।
থাইরয়েড ক্যান্সারের কারনঃ
গবেষকদের মতে, থাইরয়েড ক্যান্সারের কোন সুস্পষ্ট কারণ চিহ্নিত করা যায়নি। থাইরয়েড ক্যান্সার হয় যখন আপনার থাইরয়েড গ্রন্থির কোষগুলি জেনেটিক পরিবর্তনের কারণে বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও, মিউটেশনের ফলে কোষের বৃদ্ধি এবং বিস্তার ঘটে। এই কোষগুলোও স্বাভাবিক কোষের মতো মরে যাওয়ার ক্ষমতা হারায়। অস্বাভাবিক থাইরয়েড কোষ জমে একটি টিউমার গঠন করে। অস্বাভাবিক কোষগুলি নিকটবর্তী টিস্যুতে আক্রমণ করতে পারে এবং শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে যেতে পারে (মেটাস্টেসিস)।
থাইরয়েড ক্যান্সার হতে পারে এমন ঝুঁকির কারণগুলি হল-
১.পুরুষদের তুলনায় মহিলারা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।
২.পঞ্চাশের বেশি বয়সের মানুষের থাইরয়েড ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে।
৩.বর্ধিত থাইরয়েড গ্রন্থি বা গলগণ্ড
৪.থাইরয়েড রোগ বা থাইরয়েড ক্যান্সারের পারিবারিক ইতিহাস
৫.ফুলে যাওয়া থাইরয়েড গ্রন্থি (থাইরয়েডাইটিস)
৬.একাধিক এন্ডোক্রাইন নিওপ্লাজিয়া টাইপ 2A (MEN2A), বা টাইপ 2B (MEN2B) সিন্ড্রোমযুক্ত ব্যক্তিদের থাইরয়েড ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
৭.কাউডেন সিনড্রোম, পারিবারিক অ্যাডিনোমাটাস পলিপোসিস এবং অন্যান্য জেনেটিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা।
৮.শরীরে আয়োডিন এর পরিমান কম,
স্থূলতা বা উচ্চ বিএমআই রোগীদের ঝুকি বেশি।
৯.যেসব রোগী অতীতে মাথা ও ঘাড়ের ক্যান্সারের জন্য রেডিয়েশন থেরাপি নিয়েছেন।
১০.যেসব মানুষ কাছাকাছি পাওয়ার প্ল্যান্ট দুর্ঘটনা বা তেজস্ক্রিয় পতনের কারণে বিকিরণ এক্সপোজার হয়েছেন।
১১. যারা রেডিয়েশন এক্সপোজার এর কাজের সাথে জড়িত।
গর্ভাবস্থায় থাইরয়েড হরমোনের গুরুত্বঃ
গর্ভাবস্থায় যেসব পরীক্ষাসমূহ অবশ্যই করতে হয় তারমধ্যে থাইরয়েড হরমোন পরীক্ষা একটি।গর্ভাবস্থায় থাইরয়েডের মাত্রা বৃদ্ধির পিছনে মূলত দুটি হরমোন -ইস্ট্রোজেন এবং হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রপিন(HCG) দায়ী। যখন আপনি গর্ভবতী হন, তখন থেকেই এই থাইরয়েড হরমোনগুলি আপনার স্বাস্থ্য এবং আপনার বাচ্চার মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশ-উভয় ক্ষেত্রেই মূখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। এই HCG, TSH( থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন) এর মতোএবং আরও কিছু হরমোন সৃষ্টি করার জন্য থাইরয়েড গ্রন্থিকে উদ্দীপ্ত করে। ফলে শরীরে ইস্ট্রোজেনের মাত্রা বেড়ে যায় ও তা থাইরয়েড বাইন্ডিং গ্লোবিউলিন উৎপন্ন করে, যেটি রক্তের মধ্যে থাইরয়েড হরমোনের গমনে সহায়তাকারী একটি প্রোটিন। প্রথম ট্রাইমেস্টারে, আপনার গর্ভস্থ শিশু থাইরয়েড হরমোনের চাহিদার কারণে সে আপনার উপর নির্ভর করে। আর এটি চলতে থাকে 12 সপ্তাহ না হওয়া পর্যন্ত, যার পর থেকে শিশুর থাইরয়েড গ্রন্থিটি নিজে থেকে কাজ করতে শুরু করে। আর মূলত এই কারণেই প্রেগন্যান্ট অবস্থায় থাইরয়েডের মাত্রা বেড়ে যায় শরীরে।
গর্ভাবস্থায় হাইপারথাইরয়েডিজমের (Hyperthyroidism) ও হাইপোথাইরয়ডিজমের (Hypothyroidism) ক্ষেত্রে যেসব প্রভাব পড়তে পারে তা নিচে উল্লেখ করা হলঃ
১.হাইপারথাইরয়েডিজমের সঠিক চিকিৎসা না হলে বা গর্ভাবস্থায় থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক না থাকলে, হঠাৎ করে গর্ভপাতের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
২.হাইপোথাইরয়ডিজমের কারণে গর্ভস্থ শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধা পায়।
৩.শিশুর IQ লেভেল কম হতে পারে।
৪.থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা অস্বাভাবিক হলে নির্দিষ্ট সময়ের আগে ডেলিভারি হতে পারে বা মৃত সন্তানও জন্ম নিতে পারে।
৫.বাচ্চা গর্ভে সঠিকভাবে বাড়তে পারে না।
৬.ভবিষ্যতে ওই বাচ্চাটির থাইরয়েডের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
এছাড়াও, গর্ভাবস্থায় আপনার থাইরয়েড পরীক্ষা প্রসবের আগ পর্যন্ত প্রতি ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ পর পর করা উচিত।
এছাড়াও থাইরয়েডের সমস্যার জন্য (স্বামী-স্ত্রী) উভয়ের প্রজনন শক্তি কমে যায় এবং গর্ভধারনে ও সমস্যা হতে পারে।
থাইরয়েড হরমোনের সমস্যা কি বংশগত রোগ?
উত্তর না। থাইরয়েড সাধারণত বংশগত রোগ নয়। এটি আসলে অটো ইমিউন ডিজিজ। শরীরে আয়োডিনের মাত্রা কম হলে থাইরয়েড-এ আক্রান্ত হয়।
থাইরয়েড রোগ সনাক্তকরনঃ
রক্ত পরীক্ষাঃ
রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে হরমোনের মাত্রা পরীক্ষা করা যায়। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে সাধারণত নিচের টেস্টগুলো কতা হয়ঃ
1.Thyroid stimulating hormone (TSH)
2.Thyroxine hormone(T4)
3.Tri-iodothyronine hormone(T3)
4.TSH receptor antibody(TSI)
5. Anti-thyroid antibody
এছাড়া আরো কিছু পরীক্ষা যেমন নিউক্লিয়ার থাইরয়েড স্ক্যান, থাইরয়েড আল্ট্রাসাউন্ড, কম্পিউটারাইজড এক্সিয়াল টোমোগ্রাফি স্ক্যান (Computerized axial tomography scan) এর মত কিছু পরীক্ষার সাহায্যে ও থাইরয়েড গ্রন্থির বিভিন্ন রোগ সনাক্ত করা যায়।
থাইরয়েড হরমোনের সমস্যায় কখন সার্জারি লাগে?
সার্জারিঃ
হাইপারথাইরয়ডিজম, গয়েটার এবং নডিউল কিংবা টিউমার হলে সেটির ক্ষেত্রে রোগের মাত্রা অনুযায়ী থাইরয়েড গ্রন্থির কিছু অংশ কিংবা পুরোটা কেটে ফেলতে হতে পারে অপারেশানের মাধ্যমে।
তবে ৭০ ভাগ ক্ষেত্রে এই গ্রন্থির অর্ধেক কেটে ফেললেও রোগী তার বাকি অর্ধেক দিয়ে স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে পারে। তবে যাদের পুরো গ্রন্থিটিই কেটে ফেলেতে হয় তাদের বাকি জীবন আলাদাভাবে বাহির থেকে প্রয়োজনীয় হরমোন গ্রহণ করতে হয়।
এছাড়া বিভিন্ন নিউক্লিয়ার মেডিসিন, তেজস্ক্রিয় আয়োডিন ব্যবহার করে আক্রান্ত হবার মাত্রা নির্ধারণ করে চিকিৎসকেরা পরবর্তী পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
সুতরাং কোনো লক্ষণ দেখলে সেটাকে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। আর সুস্থ থাকতে বছরে অন্তত একবার রক্ত পরীক্ষা করে থাইরয়েড গ্রন্থির অবস্থা চেক করতে পারেন। সঠিক চিকিৎসার জন্য যেকোন এম বি বি এস অথবা হরমোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এর পরামর্শ গ্রহণ করবেন।
ধন্যবাদ।
ডাঃ আফরোজা আক্তার
জেনারেল ফিজিশিয়ান
সুরক্ষা হেলথ্ কেয়ার।