03/06/2025
সম্প্রতি আফ্রিকার ছোট্ট দেশ বুরকিনা ফাসোর প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম ট্রাওরের একটি বক্তব্য বেশ ভাইরাল হয়েছে। যেখানে তিনি শুধু তার নিজের দেশ না, পুরো আফ্রিকার মুক্তির কথাই বলেছেন। তুলে ধরেছেন তাদের সম্পদ সম্ভবনাকে কিভাবে পশ্চিমারা লুটেপুটে নিয়েছে এবং তাদের দমন করে রেখেছে। সেই ব্যবস্থা তিনি ভেঙ্গে দিচ্ছেন এবং দেশের মালিকানা দেশের জনগণের হাতে ফিরিয়ে আনার কথা বলছেন।
কিন্তু কে এই ইব্রাহিম ট্রাওরে? সে কোন লিগেসি বহন করে এইরকম মুক্তিকামী দেশপ্রেমিক হয়ে উঠলো? এই বিষয়টা একটু জানা দরকার। কেন এক সেনা কর্মকর্তা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে এখন জাতীয় সম্পদ রক্ষা এবং বিদেশি দাসত্ব ভাঙ্গার লড়াই করছেন, তার এই রাজনৈতিক চেতনার উৎস্য কোথায় সেটা জানা দরকার।
২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর, মাত্র ৩৪ বছর বয়সে ক্যাপ্টেন ইব্রাহিম এক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বুরকিনা ফাসোর ক্ষমতা দখল করেন। এর ৩৯ বছর আগে ১৯৮৩ সালে আরেক ক্যাপ্টেন থমাস সানকারা ৩৩ বছর বয়সে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। তখন ফ্রান্সের ছায়া উপনেবিশক রাষ্ট্রটির নাম ছিলো ‘আপার ভোল্টা’। শোষন দূর্নীতি বৈষম্য আর ধনীদের লুটপাটের কলোনি ছিলো এই দেশটি। থমাস সানকারা এই সবকিছুই গোড়া থেকে উৎপাটন শুরু করেন। দেশের নাম বদলে রাখেন-বুরকিনা ফাসো। যার অর্থ ‘সৎ মানুষের দেশ’।
আইএমএফ,বিশ্বব্যাংকসহ বিদেশি ঋণ নির্ভর উন্নয়নকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে স্বনির্ভর দেশ গড়ার লড়াই শুরু করেন। মাত্র ৪ বছরে তিনি শিক্ষা চিকিৎসাসহ আমলাতন্ত্র, সেনাকাঠামো, সাসটেইনেবল ইকোসিস্টেম, জাতীয় সম্পদ রক্ষাসহ এমন সব পদক্ষেপ সফলতার সাথে নেন যা চারিদিকে হইচই ফেলে দিয়ে আলোচনায় নিয়ে আসে এই বিপ্লবী মার্কসবাদী থমাস সানকারাকে। তার আর্দশ লিডার ছিলো ফিদেল ক্যাস্ত্রো এবং চে গুয়েভারা। থমাস নিজে ফলো করতেন চে গুয়েভারার রননীতি। তাকে মনে প্রাণে নিজের কমান্ডার মানতেন। ফলে তাকেই ডাকা হতো ‘আফ্রিকান চে’। ফিদেল নিজেও থমাসকে সেই চোখেই দেখতেন। থমাস সানকারা জানতেন যে কোন সময় তাকে হত্যা করা হবে। তার আগেই মানুষের ভেতর স্বপ্ন আদর্শ এবং ‘ঘটনা যে ঘটানো’ সম্ভব সেই আত্মবিশ্বাস ও উদাহরন তৈরি করে যেতে হবে। তিনি সেটা পেরেছেনও।
থমাসের রাষ্ট্র নীতিতে ক্ষুদ্ধ ছিলেন ফ্রান্স-আমেরিকাসহ সাম্রাজ্যবাদীরা। ১৯৮৭ সালে তাকে হত্যা করা হয়। ( কমেন্টে থমাস সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য সম্বলিত পোষ্ট দেয়া হলো)
এরপর আবার বুরকিনা ফাসো সেই পুরানো পথে ফিরে গেলো। বিদেশি ঋণ নির্ভর উন্নয়ন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ-খনি সব বিদেশিদের হাতে তুলে দেয়া, দূর্নীতি, সিস্টেমিক লুটপাট শুরু হলো। আবারো ফ্রান্সের ছায়া উপনিবেশিক শাষন শুরু হলো।
থমাস সানকারা চে গুয়েভারার একটি কথা সব সময় বলতেন- ‘আপনি একজন বিপ্লবীকে হত্যা করতে পারবেন, কিন্তু তার আর্দশকে হত্যা করা যায় না’।
৩৯ বছর পর সেই আদর্শেরই পুনজন্ম হলো বুরকিনা ফাসোতে আজকের এই ইব্রাহিম ট্রাওরে। রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেই ইব্রাহিম বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ বুরকিনা ফাসোর বেশ কয়েকটি সোনার খনি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাত থেকে রাষ্ট্রীয় মালিকানার অধীনে নিয়ে আসেন। আরো অনেকগুলো খনি রাষ্ট্রের অধীনে আনার প্রক্রিয়াতে আছেন। বিদেশি ঋণ নির্ভর উন্নয়ননীতি বাতিল করেছেন। বুরকিনা ফাসোতে বামপন্থী অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন করেন। ফ্রান্সের সেনাদের দেশ থেকে বিতারিত করেন। শিক্ষা স্বাস্থ্যর উপর বিশেষ নজর দেন। প্যান-আফ্রিকান ঐক্য গড়ে তোলার উপর জোড় দেন। আরো অনেক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ইব্রাহিমের জনপ্রিয়তা তার নিজ দেশ ছাড়িয়ে আশেপাশেও ছড়িয়ে পরেছে।
ইব্রাহিম ট্রাওরে সাম্রাজ্যবাদীদের নীতি কৌশল সবকিছুই রীতিমত গুড়িয়ে দিচ্ছেন। তথাকথিত পপুলিস্ট রাজনীতির পথে না হেটে ইব্রাহিম ট্রাওরে তার রাজনৈতিক গুরু থমাসের পথে হেটেই জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। কিছুদিন আগে উদ্বোধন করলেন থমাস সানকারার ভাস্কর্য। এই ভাস্কর্য বিষয়ে একটি মজার আলাপ আছে। একবার থমাস সানকারাকে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলো আপনি এতো জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট অথচ কোথাও আপনার ভাস্কর্য নেই কেন? উত্তরে থমাস বলেছিলেন ‘এই দেশের ৮৭ লাখ মানুষই প্রেসিডেন্ট আমি তাদের প্রতিনিধি মাত্র’। এবার সেই থমাসের প্রতি কৃতজ্ঞতা থেকে তার ভাস্কর্য গড়লেন ইব্রাহিম। তিনি বলেন, ‘থমাস সানকারা শুধু নেতা নন তিনি একটি আদর্শ। আমরা তার আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখবো।’
গত মার্চে সৌদি-আরব ২০০ মসজিদ নির্মানের কথা বলেছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ বুরকিনা ফাসোতে। সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ইব্রাহিম ট্রাওরে বলেন, ‘বুরকিনা ফাসোতে ইতোমধ্যেই যথেষ্ট মসজিদ রয়েছে এবং অনেক মসজিদ পুরোপুরি ব্যবহার করা হয় না। তার চেয়ে বরং আমার দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে এই বিনিয়োগ করুন।’
এইসব কিছু মিলিয়েই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন ইব্রাহিম। প্রবীনরা তার ভেতর দেখছেন থমাস সানকারাকে। তাকে কেউ এই যুগের থমাস সানকারা বলেন। কেউ বা বলেন আফ্রিকান চে! বুরকিনা ফাসোর বাইরে তাকে সবাই আফ্রিকান চে নামেই চিনেন। থমাস সানকারা মতো তাকেও একাধিক বার হত্যার চেষ্টা হয়েছে। এখনও তিনি সেই হুমকির ভেতরই আছেন। তবে অসীম সাহসী ইব্রাহিমও সেই একই কথা শোনাচ্ছেন- ‘একজন বিপ্লবীকে হত্যা করতে পারবেন হয়তো, কিন্তু তার আর্দশকে হত্যা করা যায় না’। তবে তিনি এটাও বলেন আমরা শান্তি চাই, তবে কেউ যদি লড়াই করতে চায় আমরা প্রস্তুত। আমরা সর্বাত্মক লড়াইয়ের মাধ্যমে প্রতিহত করবো।
ইব্রাহিম ট্রাওরে বলেন, ‘ফ্রান্স আমাদের সম্পদ লুটেছে, কিন্তু আমাদের আত্মা লুটতে পারেনি। এখন সময় এসেছে আমাদের সম্পদ আমাদেরই নিয়ন্ত্রনে রাখার’।
থমাস সানকারা বলতেন- ‘যে তোমাকে খাওয়াবে, সেই তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করবে। তাই নিজের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিতে হলে নিজের শক্তিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার বিকল্প নেই’। একই নীতি অনুসরনের চেষ্টায় আছেন ইব্রাহিম ট্রাওরেও। যে কোন বিপ্লবী সরকার তার নিজের সম্পদ রক্ষা, পরর্নিভরশীলতা কময়ে আনা, টেকসই উন্নয়ন ব্যবস্থা গড়ে তোলার দিকেই মনযোগ দিবেন। আমরা পারিনা বলে নিজেদের বন্দর বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়া তার কাজ না। তার কাজ, কিভাবে আমরা পারবো সেই উদাহরন তৈরি করা।
এই সব কিছুই আসলে নির্ভর করে আপনার রাজনৈতিক কেবলা কোন দিকে থাকে তার উপর। রাজনীতিই নির্ধারন করে দেশের সম্পদ রক্ষার নীতি, উন্নয়ন নীতি, দূনীর্তি বৈষম্য ভাঙ্গার নীতি কি হবে।
এখন দেখা যাক কতদূর যেতে পারেন এই বিপ্লবী। একদিকে নীতিতে অটল থাকার লড়াই অন্যদিকে আছে হত্যার প্রচেস্টা থেকে নিজেরে বাঁচিয়ে রাখা।
লেখা: Abdullah Mahfuj Ove