26/04/2021
আপনি যখন অনেক বেশি রেগে যান তখন কি করেন ? এবং কিভাবে তা নিয়ন্ত্রন করেন ?
আজকের বিষয় : সামান্য বা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে অল্পতেই রেগে যাওয়া।
আমরা আজকে জানবো কেন মানুষ অল্পতেই রেগে যায়। আর এই রেগে যাওয়ার কারনে মানুষের কি কি ক্ষতি হতে পারে এবং কিভাবে তা নিয়ন্ত্রন করবে।
——রেগে গেলে আমার যে কী হয় ? মাথার কিছু ঠিক থাকে না।“ এমনটা বলতে শোনা যায় অনেককে। সামান্য বিষয়ে রেগে গিয়ে জিনিসপত্র ভাঙচুর, গালাগালি, চিৎকার - চেঁচামেচি, এমনকি নিজেকে বা অপরকে আঘাত করেন।অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় রাগ একটি স্বাভাবিক আবেগ হলেও এর প্রকাশ যদি অনিয়ন্ত্রিত বা অন্যের জন্য ক্ষতিকারক অথবা অপ্রীতিকর হয়, তখন এটি নিঃসন্দেহে অগ্রহণযোগ্য।
রেগে যাই কেন?
রাগ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের মানসিক অবস্থার একটি বহিঃপ্রকাশ।
সম্প্রতি কি আপনি কোনো ব্যাপার নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছেন? তবে এটা হতে পারে এই সমস্যার কারণ। দুশ্চিন্তার ফলে মনের মধ্যে এক ধরণের ভয় জাগে। না পাওয়ার ভয় কিংবা হারানোর ভয়। আর এই ভয় থেকে শুরু হয় অস্থিরতা আর খিটখিটে মেজাজের সুত্রপাত। এর ফলে মানুষ তার চারপাশের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এমন হয় যে, যে ব্যক্তি এই সমস্যায় ভুগছেন তিনি সহজে কাউকে জানাতে চান না এই ব্যাপারটা। ফলে মনের মধ্যে যে প্রচন্ড চাপ তৈরি হয় তা কমে যাওয়ার বা লাঘব হওয়ার কোনো সুযোগ পায় না। আর তখন মনের এই চাপ রাগের রূপে প্রকাশ পেয়ে যায়।
উদ্বিগ্ন বা বিষণ্নতা:
ব্যক্তি যদি কোনো বিষয়ে নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপে থাকে, সে ক্ষেত্রেও তার অতিরিক্ত উদ্বিগ্নতা রেগে যাওয়ার মাধ্যমে প্রকাশ পেতে পারে।
সামাজিক দক্ষতার অভাব:
সমস্যা সমাধান বা দৈনন্দিন জীবনের নানামুখী চাপ ভালোভাবে মোকাবিলা করতে না পারা, অন্যের কাছে সঠিকভাবে প্রকাশের অদক্ষতা ইত্যাদি ব্যর্থতার দায় ব্যক্তি অনেক সময় কাছের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়।
কাজ ও সময়ের চাপ
অনেক কাজ একসঙ্গে এসে গেলে অথবা অল্প সময়ের মধ্যে অনেক কাজ শেষ করতে গিয়ে সেসব যদি ঠাকমতো না হয়, তাহলে অনেকের মধ্যে টেনশন বা হতাশা জমতে জমতে রাগ তীব্র আকার ধারণ করতে পারে।
পারিবারিক পরিবেশ
ছোটবেলায় যদি কেউ এমন পরিবেশে বড় হয়, যেখানে মা-বাবা বা অভিভাবকেরা অল্পতেই রেগে যান, সেই পরিবারে শিশুরাও একই ধরনের আচরণ শেখে।
কিছু মানসিক সমস্যা:
বিভিন্ন মানসিক সমস্যা, যেমন ব্যক্তিত্বের ত্রুটি, বিষণ্নতা রোগ, সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার, উদ্বিগ্নতা রোগ, শুচিবায়িতা, মাদকাসক্তি, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা, কনডাক্ট ডিসঅর্ডার, ডিমেনশিয়া ইত্যাদির অন্যতম উপসর্গ রাগ।
এ ছাড়াও খুঁতখুঁতে স্বভাব, হীনম্মন্যতাবোধ, অতিরিক্ত কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাব, সবকিছুতে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ, ব্যর্থতা মেনে না নেওয়ার মনোভাব ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের মানুষের মধ্যে অল্পতেই রেগে যাওয়ার প্রবণতা থাকে।
রাগের কুফল:
রাগের কারণে সম্পর্কের বিচ্ছেদ, বড় ধরনের শারীরিক ক্ষতি, অঙ্গহানি বা এমনকি কারও মৃত্যুর খবরও উঠে আসে সংবাদমাধ্যমে। তবে রাগের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিন্তু ব্যক্তি নিজেই। দূরত্ব তৈরি হয় তার পারস্পরিক সম্পর্কে, কমে যায় এর গুণগত মান অথবা তার প্রতি অন্যদের সম্মানবোধ, আগ্রহ। বিষণ্নতা, হীনম্মন্যতা বা অপরাধবোধে আক্রান্ত হয় ব্যক্তি। শুধু তা-ই না, অতিরিক্ত রাগ কমিয়ে দিতে পারে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের স্বাভাবিক দক্ষতা অথবা উৎপাদনশীলতা। বিঘ্ন ঘটায় সার্বিক জীবনছন্দে। যারা একটুতেই বা ছোট-খাটো কথায় রেগে যায় তাদের স্ট্রোক, কিডনির রোগ এবং স্থূলত্বের ঝুঁকি বাড়ে। আচমকা রাগের ফলে আমাদের মস্তিষ্কের ওপর প্রচন্ড পরিমাণে চাপ পড়ে। ফলে মস্তিষ্কের রক্তনালিগুলো কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। তখন স্ট্রোক হতে পারে।
১। হঠাৎ করে রেগে গেলে আপনার মানসিকের পাশাপাশি শরীরের উপরও প্রভাব পড়ে। অতিরিক্ত ঘাম, আলসার এবং বদহজমের মতো সমস্যাও রাগের কারণে হতে পারে।
২। অতিরিক্ত রাগের কারণে হার্টের রক্ত পাম্প করার ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং এর কারণে হৃৎপিণ্ডের পেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘন ঘন রেগে গেলে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
৩। অতিরিক্ত রাগ মানুষকে ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয়। পাশাপাশি স্ট্রেস বাড়ে। কোনো কিছুতেই মন বসে না ও একাকীত্ব বাড়ে।
৪। ক্রমাগত রাগ করার ফলে ত্বকে র্যাশ, পিম্পল বা ব্রণর মতো নানান সমস্যা দেখা দিতে পারে।
রাগ সামলাবেন কীভাবে ?
সিদ্ধান্ত নিন:
রাগ যে আপনার একটি নেতিবাচক আবেগ, যার কারণে আপনার ও অন্যদের যে ক্ষতি হচ্ছে, সেটি আগে নির্দিষ্ট করুন, পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিন। তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখানো থেকে বিরত থাকুন: রেগে গেলে সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে নিজের কাছে কিছু সময় নিন। দেখবেন এই সময়ক্ষেপণের ফলে আপনার উত্তেজনা বা রাগের তীব্রতা কমে গেছে। ফলে রাগত অবস্থায় আপনি যেমন ধংসাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখাতেন, রাগ কমে যাওয়ার পরে আপনি অনেক সঠিকভাবে আপনার মনোভাব অন্যের কাছে পৌঁছাতে পারবেন।
পরিস্থিতি থেকে সরে আসুন:
যখন বুঝে যাচ্ছেন আপনি রেগে যাচ্ছেন, তখন একেবারে প্রাথমিক অবস্থাতেই সেই পরিস্থিতি বা জায়গা দ্রুত ত্যাগ করুন বা কারও সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে রাগ হতে থাকলে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে ফেলুন অথবা তার সঙ্গে সেই মুহূর্তে কথা বলা থেকে বিরত থাকুন। এ সময় কিছু ‘রিলাক্সেসন এক্সারসাইজ’, যেমন শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম, গুনগুন করে গান গাওয়া, মজার কিছু ভাবা, মনে মনে নিজেকে শান্ত হতে বলা ইত্যাদি আপনার অস্থিরতা কমাতে সাহায্য করবে।
রাগ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা বাড়ান:
নিয়মিত ব্যায়াম: নিয়ম করে দিনে অন্তত আধা ঘণ্টা জোরে ঘাম ঝরিয়ে হাঁটা বা যেকোনো ব্যায়াম, প্রতিদিন এক থেকে দুবার শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম আপনার আত্মনিয়ন্ত্রণ বাড়াবে। মানসিকভাবে আপনাকে ভালো রাখতে সাহায্য করবে।
গুণগত সময়:
আপনার জীবনের গুণগত মান অন্যের ওপরে না, আপনার ভালো থাকার ওপর নির্ভর করে। সুতরাং নিজেকে ভালোবাসুন, ভালো রাখুন, গান শুনুন, বই পড়ুন, পছন্দের কাজ করুন। বন্ধুবান্ধব ও সামাজিক মেলামেশা বাড়ান, নিয়ম করে মাঝেমধ্যে বেড়াতে যান। নিজের জন্য প্রতিদিনই কিছুটা গুণগত সময় রাখুন।
আপনার জীবনের মান আপনি নিয়ন্ত্রণ করবেন, আপনার রাগ নয়। কাজেই রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। কথায় তো আছেই—রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। রাগ প্রকাশ করে হেরে যাওয়ার তো কোনো মানে নেই।
অতিরিক্ত রাগ মেন্টাল ডিসঅর্ডারের কারণেও হতে পারে যেমন বাইপোলার ডিসঅর্ডার, সাইকোটিক ডিসঅর্ডার, এ ডি এইচ ডি ইত্যাদি। তাই কারো যদি খুব বেশি রাগ হয় এবং সেটা অনেক সময় ধরে থাকে,তাহলে তার অবশ্যই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত।
এই ক্ষেত্রে আশেপাশের মানুষদেরও কিছু দায়িত্ব থাকে। কাউকে এভাবে খুব রেগে যেতে দেখলে তার উপর বিরক্ত না হয়ে তার পাশে দাঁড়ান। জানার চেষ্টা করুন তার কিসে অসুবিধা। কোনো সমস্যা থাকলে একসাথে মিলে সে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে দেখুন। ফলে একদিকে আপনার আত্মবিশ্বাস যেমন বাড়বে তেমনি নিজের প্রতি সম্মানবোধও বাড়বে।