15/12/2024
তিনটি ঘটনা আমাকে সংসারবিমুখ করেছিল, স্থায়ীভাবে।
(কবি হেলাল হাফিজের জীবন থেকে.....)
এই দীর্ঘ জীবনের পেছনে ফিরে তাকালে তিনটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। তিনটি ঘটনাই আমার জীবনকে ওলটপালট করে দিয়েছে। আমি সফল নাকি ব্যর্থ, হিসাব কষতে বসলেও ওই তিনটি ঘটনা অবধারিতভাবে সামনে চলে আসে। আজ আমার যতটুকু সফলতা, সেই তিনটি ঘটনা তার পেছনে দায়ী। আবার আমার যতটা ব্যর্থতা, তার পেছনেও আছে ওই তিন ঘটনা।
প্রথম ঘটনা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) থাকি। ওই দিন সন্ধ্যায় নিউমার্কেটের দিকে আড্ডা দিয়ে রাতে হলে ফিরেছি। ক্যানটিন বন্ধ। খেতে গেলাম মেডিকেল গেটের কাছে পপুলার নামের একটা রেস্টুরেন্টে। খাওয়া শেষে মনে হলো, ফজলুল হক হলে বন্ধু হাবিবুল্লাহ থাকে, ওর সঙ্গে একটু দেখা করে আসি। গেলাম ফজলুল হক হলে। হাবিবুল্লাহর কক্ষে গিয়ে আমি আড্ডা শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পর, রাত তখন পৌনে ১০টা হবে, হঠাৎ গোলাগুলির বিকট আওয়াজ। আমরা হলের ছাদে উঠে দেখলাম, নীলক্ষেত, নিউমার্কেটের দিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে।
২৭ মার্চ সকালে ইকবাল হলে গিয়ে দেখি, মাঠের মাঝখানে, এখানে-ওখানে শুধু লাশ আর লাশ। নিজের কক্ষে গিয়ে স্যুটকেস গুছিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়লাম। এখান থেকে পালাতে হবে, না হলে বাঁচা সম্ভব নয়। হলের গেটে এসে দেখি নির্মলেন্দু গুণ দাঁড়িয়ে আছে। সে বলল, ‘আমি ভেবেছি তুমি মারা গেছো, তোমার লাশ নিতে এসেছি।’ বলেই সে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। আমিও সজোরে কাঁদতে লাগলাম। তারপর সেখান থেকে আমার বড় ভাইয়ের বাসায় গিয়ে উঠলাম।
এই ঘটনা আমার হৃদয়ে ব্যাপকভাবে ছাপ ফেলল। আমার তখন কেবলই মনে হতো, ওই রাতে যদি আমি ফজলুল হক হলে না গিয়ে নিজের হলে ফিরতাম, তাহলে তো বাঁচতাম না। একটা বোনাস জীবন পেয়েছি—এই উপলব্ধি আমার ভেতর বিরাট বৈরাগ্য এনে দিল। এক ধরনের সন্ন্যাস জীবনযাপন শুরু করলাম আমি।
এর পরের ঘটনা ’৭৩ সালের জুনের। ১৯ জুন আমার পিতার মৃত্যু হলো। তিন বছর বয়সে মা মারা যাওয়ার পর আব্বাই ছিলেন আমার সবকিছু। তাঁর মৃত্যু প্রবলভাবে ধাক্কা দিল আমাকে। মনে হলো, জগৎসংসার তুচ্ছ। সব অর্থহীন। আমার বৈরাগ্য আরও প্রগাঢ় হলো।
আব্বার মৃত্যুর মাসখানেক পরই ঘটল তৃতীয় ঘটনা। ঘটনা ঘটাল হেলেন, আমার প্রেমিকা। হেলেন হঠাৎ ডেকে বলল, ‘কবি, তোমার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।’ আমরা গিয়ে বসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে। সে বলল, ‘আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। বাবা-মা আমার বিয়ে ঠিক করেছে।’
ছোটবেলা থেকে আমি খুব সহনশীল ছিলাম। প্রচণ্ড সহ্যশক্তি আমার। তাই ভেতরের ঝড় বুঝতে দিলাম না হেলেনকে। ওখান থেকে উঠে রিকশা নিয়ে সোজা হলে চলে গেলাম। ওটাই হেলেনের সঙ্গে আমার শেষ দেখা ও শেষ কথা।
এই তিনটি ঘটনা আমাকে চিরস্থায়ীভাবে সংসারবিমুখ করে ফেলল। আমার আর ঘর হলো না, সংসার হলো না, অর্থকড়ি হলো না, প্রতিষ্ঠা হলো না।
----
তৃতীয় ঘটনার এক যুগেরও বেশি সময় পর, ১৯৮৬ সালে, তিনি লিখলেন এক কবিতার বই; নাম 'যে জলে আগুন জ্বলে'। কথিত আছে এই কবিতার বই হেলেনের স্বামী কিনে দিয়েছিলেন হেলেনকে। পুরা বই জুড়ে তাকে না পাওয়ার জন্য কবির হাহাকার দেখে হেলেন মানসিকভাবে প্রচন্ড আঘাত পান এবং এক পর্যায়ে পাগল হয়ে যান। স্বামী তাকে তালাক দেয়ার পর তিনি নেত্রকোনায় বাবার বাড়িতে চলে যান, সেখানে তাকে শিকল দিয়ে বেধে রাখতে হতো।
হেলেনকে না ভুলতে পেরে কবিও আর বিয়ে করেননি, সংসার করেননি, ঘর ছিলো না; থাকতেন হোটেলে হোটেলে।
(প্রথম দুটো তথ্য কবির মুখ থেকে শুনলেও শেষের তথ্যের রেফারেন্স জানা সম্ভব হয়নি- রবিউল আলম লুইপা)