22/06/2025
#চেম্বার_কথন
" মেয়েটা ছোটবেলায় আমাকে বুলি করত প্রচন্ড। একই কম্পাউন্ডে বাসা ছিল। বাবারা সহকর্মী ছিলেন। বিকালে খেলতে নামলেই আমার সাইকেলে ধাক্কা দিত। কখনো ডাল ঢুকিয়ে চাকা নষ্ট করে দিত। স্কুলে বরাবরই আমি চুপচাপ। শিক্ষকদের আদর পেয়েছি প্রচন্ড। কিন্তু এই মেয়েটাই বরাবর ক্লাস ক্যাপ্টেন থাকতো। শিশু শ্রেণী থেকে শুরু করে কলেজ পর্যন্ত একসাথে পড়লেও আমি আসলে দস্তুর মত ভয়ই পেয়ে গেছি ওকে। বড় বেলায়, আমাদের দুই পরিবার থেকে বিয়ের জন্য বলেছিল, কিন্তু আমি অনেকটা ভয় পেয়েই ও যে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হয় সেখানে চান্স পেলেও অন্য বিশ্ববিদ্যালয় চলে যাই। যদিও দুজনই একই সাবজেক্টে পড়ি। এরপর আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে পিএইচডি করলাম। এখন যেখানে জয়েন করলাম দেখি এই মেয়ে তার কিছুদিন পরেই ঠিক সেখানেই জয়েন করলো। আজব !! এরপর থেকে আবার প্রচন্ড ভয় লাগা শুরু হলো। সেই পুরনো ভয় যেন উথলে উঠলো। আক্ষরিক অর্থে প্যানিক অ্যাটাক। আমি জানিনা কিভাবে সামাল দেবো? আমার টিমে একে নাকি দেওয়া হবে। আমি আর নিতে পারছি না।" ভদ্রলোক দ্রুত বেগে পা নাড়তে নাড়তে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললেন।
"আপনি বিয়ে করেছেন? " আমি জানতে চাইলাম।
"না!"
"বয়স কত হলো? "
" ৪৩ বছর! "
"আপনার কোন শারীরিক সমস্যা আছে? "
"না।"
"সেই ভদ্রমহিলা বিয়ে করেছেন? "
"না"
"উনি কখনো আপনাকে ভালোবাসার প্রস্তাব দিয়েছিলেন? "
ভদ্রলোক চমকে উঠলেন তোতলাতে তোতলাতে বললেন,
" আ আ আপনি কিভাবে জানলেন? "
"সেটা অবান্তর, জানার জন্যই তো আমাকে পয়সা দেন, তাই না? প্রস্তাবটা কি স্কুলে ছিল? "
"প্রতিটা ক্লাসে, যখন থেকে মনে করতে পারি, একটা দিনও আমাকে শান্তি দেয়নি। "
"তা বেশ তো! বিয়ে করলেন না কেন এত দিন?"
"সময় করে উঠতে পারিনি বোধহয়! "
"বোধ হয়? আপনি নিশ্চিন্ত নন?"
"জানিনা! "
"কেমন মেয়ে আপনার পছন্দ? "
"সব সময় আমাকে দেখে রাখবে, সবকিছুতে খেয়াল রাখবে, আমার সবকিছু জানবে। "
"ঠিক এই মেয়েটি যেমন করে ছোটবেলা থেকে আপনার সবকিছু দেখে রাখতেন, খেয়াল করতেন, প্রত্যেকটা বিষয়ে আপনার সম্পর্কে নখ দর্পণে রাখতেন সেরকম? "
ভদ্রলোক চমকে উঠলেন।
"আপনি কি এই মেয়েটির ছায়া কারো মধ্যে দেখেননি বলে বিয়ে করেননি এতদিনও? ভদ্রমহিলা কেন বিয়ে করলেন না সেটা কি খোঁজ নেয়া যায়?"
দশ দিক স্তব্ধ হয়ে গেল।
দীর্ঘ স্তব্ধতা আড়মুড়ি দিয়ে ভাঙতে ভাঙতে, মৃদু গলায় প্রশ্ন করলাম, "ভয়টি কি এখনো আছে? "
"না।" ভদ্রলোকের চোখে উজ্জ্বল কমলালেবুর রোদ্দুর ঝিকমিক করছে।
অচেনা এই ভদ্রমহিলার কথা ভেবে শামসুর রহমানের একটি কবিতা মনে পড়ল
"এখন মাঝরাস্তায় আমি; শ্বাসরোধকারী নিঃসঙ্গতা
একটা মাকড়সার মতো হাঁটছে
আমার চোখে, গালে, কণ্ঠনালীতে,
বুকে, ঊরুতে আর
অন্ধকারের জোয়ার খলখলিয়ে উঠছে আমার চারপাশে।
অন্ধকার ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছে না। মনে হয়,
এখানে কোথাও তুমি আছো, ডাকলেই
সাড়া দেবে লহমায়। তলোয়ার মাছের মতো
তোমার কণ্ঠস্বর
ঝলসে উঠবে অন্ধকারে।
কণ্ঠে সমস্ত নির্ভরতা পুরে তোমাকে ডাকলাম,
শুধু ভেসে এলো আমার নিজের কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি।
অন্ধকারে পথ হাতড়ে চলেছি, যদি হঠাৎ
তোমার দেখা পেয়ে যাই।
ভেবেছি, আমার দিকে প্রসারিত হবে
অলৌকিক বৃক্ষশাখার মতো তোমার হাত।
কতকাল প্রতীক্ষাকাতর আমি
তোমার কণ্ঠস্বর শোনার জন্যে, কত পাথর আ কাঁটাময়
পথ পেরিয়েছি তোমাকে একটিবার
দেখবো বলে। অথচ আমার সকল প্রতীক্ষা আর
ব্যাকুলতাকে বারংবার উপহাস করেছে
তোমার নীরব অনুপস্থিতি।
অন্ধকারে আমি দু’হাতে আঁকড়ে রেখেছি
একটি আয়না যাতে দেখতে পাই
তোমার মুখের ছায়া। কিন্তু আয়নায় পড়ে না
কোনো ছায়া, লাগে না নিঃশ্বাসের দাগ।
এখানে কোথাও না কোথাও তুমি আছো,
এই বিশ্বাস কখনও-সখনও
আমাকে বাঁচায়
অক্টোপাশা-বিভ্রান্তি থেকে। কিন্তু সেই বিশ্বাস নিয়ে
আমি কী করবো যা সমর্থিত নয়
জ্ঞানের জ্যোতিশ্চক্রে?
জ্ঞান আমার উদ্ধার, তারই অন্বেষণে
উজিয়ে চলি
স্বৈরিণীর মতো অন্ধকার। এজন্যে যদি তোমাকে খোঁজার সাধ
মুছে যায় কোনো রাগী পাখার ঝাপটে,
আমি প্রতিবাদহীন পা চালিয়ে যাবো
জ্ঞানের বলয়ে আমার অজ্ঞতা নিয়ে।
(আমার অজ্ঞতা নিয়ে : শামসুর রাহমান)
মাঝে মাঝে নিজের অজ্ঞতা নিয়ে আয়নায় মুখ দেখলে ভীষণ চমকে যাই। অজ্ঞতাকে লুকিয়ে রাখি, ভারি ভারি বইয়ের মলাটের ভেতরে। কিন্তু গুটি বসন্ত যেমন লুকিয়ে রাখা যায় না, গুটি বের হবেই সেরকম অজ্ঞতাও ফুটে বের হতেই থাকে... হতেই থাকে... হতেই থাকে। আর প্রতিদিন আমার অজ্ঞতায় আমি ক্রমাগত বিস্মিত হতে থাকে।
(কথোপকথনের আলোচ্য অংশটুকু মনোসামাজিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ভদ্রলোকের অনুমতি সাপেক্ষে প্রকাশ করা হলো।)
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার,
ফিনিক্স ওয়েলনেস সেন্টার বাংলাদেশ