24/02/2022
%%%%%%%%%%%%%%%%%%%%%%%%
পল্লী ডাক্তার মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, গ্রাজুয়েট ডাক্তার রোগীকে সারিয়ে তোলে।
%%%%%%%%%%%%%%%%%%%%%%%%
রাত পৌনে তিনটা। মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠতেই ঘুম ঘুম চোখে রিসিভ করলেন মিস্টার পল্লী ডাক্তার। মোবাইলের অপর দিক থেকে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে একজন পৌঢ়া মহিলা বল্লেন, "আপনার মামায় কেমন জানি করতেছে। তাড়াতাড়ি একটু আমাদের বাসায় আসেন।"
পল্লী ডাক্তারদের রক্তের সম্পর্ক লাগেনা। গ্রামের সবাই তার আপন জন। মামা, চাচা, খালু, ফুপা, নানা, দাদা, ভাই, বোন, মামি, চাচি, খালা, ফুপু, নানি, দাদি, ভাবী এসব সম্পর্ক এমনি এমনিই গড়ে ওঠে।
গ্রামের দু চারশ পরিবারের হাজার খানেক মানুষের কার হাই প্রেসার, কার লো প্রেসার, কার হার্ডের সমস্যা, কার কিডনির সমস্যা, কার সুগার বেশি, কার কিসে এলার্জি এসব কমন বিষয়গুলো পল্লী ডাক্তারদের মুখস্ত থাকে।
মিস্টার পল্লী ডাক্তার বল্লেন, "মামাকে চিনি খাওয়ান, আমি আসতেছি।"
ইতিমধ্যে পরিবারের অন্য সদস্যদের চেঁচামেচি শুনে পাড়া প্রতিবেশিরা ভীড় জমিয়েছে। রোগীর মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। কেউ হাতে পায়ে তেল মালিশ করছে। কেউ মাথায় পানি দিতে বলছে। শীতের মধ্যে কেউ পানি না দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে।
পৌঢ়া মহিলা বল্লেন, "ডাক্তার চিনি খাওয়াইতে বলছেন।"
পল্লী ডাক্তারদের প্রতি গ্রামের মানুষেরও অগাধ বিশ্বাস থাকে। এক চামচ চিনি রোগীর মুখে ঢেলে দিলেন। একজন আবার এক চামচ পানি খাইয়ে দিলেন।
পনেরো মিনিটের মধ্যে মিস্টার পল্লী ডাক্তার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আর প্রাথমিক চিকিৎসার ঔষধপত্র সম্বলিত তার সেই চির চেনা ব্যাগ নিয়ে রোগীর বাসায় পৌঁছে গেলেন। ইতিমধ্যে রোগী কিছুটা সুস্থ। প্রথমেই তার সুগার মাপা হলো। গ্লুকো মিটারে 1.9 দেখা গেলো। মিস্টার পল্লী ডাক্তার সাহেব তাকে বেশি করে চিনি দিয়ে এক গ্লাস শরবত দিতে বল্লেন। শরবত খাওয়ার পনেরো মিনিট পর আবার সুগার টেস্ট করা হলো। এবার 3.2 দেখা গেলো।
রোগী উঠে বসেছেন। তিনি এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। উপস্থিত সবাই হতবাক। আধঘন্টা আগে কী দেখলাম আর এখন কী দেখছি! কোন ঔষধ পত্র কিছুই লাগেনি। শুধু একটু সমস্যাটা বুঝতে পারা আর একটু পরামর্শই অনেক সময় একটা মানুষের প্রাণ বাঁচাতে পারে।
রোগী মিস্টার পল্লী ডাক্তারকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই ফেল্লেন, "তুমি আমার জীবন বাঁচাইলা বাবা।"
ভদ্র লোকের বাড়ি বিক্রমপুরের আড়িয়াল বিল অঞ্চলে। তিন মেয়ে, বিয়ে দিয়ে ফেলেছেন। এক ছেলে চায়না থেকে ডাক্তারি পাস করে বর্তমানে কক্সবাজারে কোন একটা প্রাইভেট হাসপাতালে কর্মরত। বাড়িতে বুড়োবুড়ি দু জন, তাই একটা অসহায় পরিবারকে থাকতে দিয়েছেন আপদে বিপদে পাশে থাকার জন্য।
ডাক্তার সাহেব সারাদিন হাসপাতালে কাজ করে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে রাতে মোবাইল সাইলেন্ট করে আরামে ঘুমিয়ে থাকেন। সকালে ফ্রেস হয়ে চেম্বারে গিয়ে রোগী দেখেন। রোগীর নাম, ঠিকানা, বয়স, কী সমস্যা জিজ্ঞেস করতে করতে তিন চারটা টেস্ট লিখে ফেলেন। এবার রোগীর সমস্যার কথা শুনে প্রয়োজন মনেকরলে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। প্রয়োজন মনে না করলে আট দশটা ঔষধ আরো দু তিনটা টেস্ট লিখে রোগীর হাতে প্রেস্ক্রিপশন ধরিয়ে দেন। রোগীর ঔষধ কিনে খাওয়ার সামর্থ আছে কিনা এটা তার দেখার বিষয় নয়। "টেস্টগুলো করিয়ে রিপোর্ট নিয়ে তিনদিন পর দেখা করবেন" বলে ৫০০ টাকা ভিজিট রেখে বিদায় করে দেন।
গ্রাজুয়েট ডাক্তার সাহেবের মা জানেন তার ছেলে এখন ফোন রিসিভ করবে না। তাই বিদেশ থেকে পাশকরা ডাক্তারের চেয়ে মধ্যরাতে তাঁর ভরসা মানবতার ডাক্তার পল্লী ডাক্তারের ওপর। তাছাড়া গ্রাজুয়েট ডাক্তারগণ কখনো রোগীর কাছে যান না। রোগী না দেখে ফোনে কোন পরামর্শ দেন না। রোগীকে তারা চেম্বারে নিয়ে যেতে বলেন। পরীক্ষা নীরিক্ষা করে তারপর চিকিৎসা দেন। ততক্ষণে অনেক রোগী মারা যান।
পল্লী ডাক্তারদের মোবাইল কখনো সাইলেন্ট মুডে থাকে না। ব্যাগ সব সময় গুছানোই থাকে। তেমন কোন টেস্ট ফেস্ট দরকার হয় না। ভিজিটের আশায় হাত পেতে বসে থাকেন না। শুধু চিকিৎসা আর পরামর্শ নয়, রোগীর সামর্থ অনুযায়ী সঠিক ঔষধ নির্বাচন করে ঔষধও দিতে হয়। তড়িৎ সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে রোগীর প্রাণ বেঁচে যায়।
হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া, হার্ট এটাক হওয়া, স্ট্রোক করা, হঠাৎ জ্বর ওঠা, বমি করা, পাতলা পায়খানা করা, হঠাৎ পড়ে গিয়ে হাত পা কেটে যাওয়া, মাথা ফেটে যাওয়া, ইলেক্ট্রিক শক লাগা, প্রেসার বেড়ে বা কমে যাওয়া, সুগার ফল্ট করা, শ্বাস প্রশাস নিতে কষ্ট হওয়া বা দম আটকে আসা ইত্যাদি ইমার্জেন্সি মূহূর্তে রোগীরা প্রথমে পল্লী ডাক্তারের কাছেই ছুটে যায়। পল্লী ডাক্তার মশাই তাঁর সীমিত জ্ঞানের দ্বারা কখনো দু একটা ইমার্জেন্সি ঔষধ, কখনো সামান্য হাতের কাজ, কখনো শুধু পরামর্শ দিয়ে একজন রোগীকে বাঁচিয়ে রাখেন।
যদি প্রতিটি গ্রাম-গঞ্জে, পাড়ায়-মহল্লায় এসব পল্লী ডাক্তারগণ না থাকতেন তাহলে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতার কারণে আর হাসপাতালের পাশকরা বড় ডাক্তার সাহেবদের কাছে নিতে বিলম্ব হওয়ার কারণে ৫০% রোগী মারা যেতো।
হাসপাতালের ডাক্তার সাহেবদের ৯৮% আবার প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখেন। এক জন রোগীকে ১২ ঘন্টা পর পর ৭ দিনে ১৪ টা আই ভি ইঞ্জেকশন লিখে দেওয়া তার কাজ। ক জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি থেকে নার্সকে দিয়ে ইঞ্জেকশন পুশ করাবার সামর্থ রাখে? পল্লী ডাক্তার সাহেবেরাই সময়মতো বাড়ি বাড়ি গিয়ে এসব ইঞ্জেকশন পুশ করে দিয়ে আসে।
যদি পল্লী ডাক্তার না থাকতো তাহলে অনেক রোগী চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে গিয়ে না খেয়ে মারা যেতো। অনেক রোগী জার্নি করতে করতে রাস্তায় মারা যেত। অনেক রোগী বিনা চিকিৎসায় মারা যেতো।
তাই এ কথা বল্লে মোটেও বাড়িয়ে বলা হবে না যে, "পল্লী ডাক্তার মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, গ্রাজুয়েট ডাক্তার রোগীকে সারিয়ে তোলে।"
সরকার যতই হম্বি তম্বি করুক না কেন, বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে ১৮ কোটি মানুষের দোর গোড়ায় চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দেওয়া মোটেই সম্ভব নয়। তাই পল্লী ডাক্তারদের বাঁচিয়ে রাখা সরকার, সাধারণ জনগণ এবং পাশকরা ডাক্তারদেরও দায়িত্ব।
আজকে যে পাশকরা ডাক্তার মশাই BMDC'র রেজিস্ট্রেশন নিয়ে পল্লী ডাক্তারদের পেশগত পরিচয় মুছে দিতে চাইছেন; তারা একটু নিজের গ্রামের বাড়িতে খবর নিয়ে দেখেন মধ্যরাতে আপনার বাবাকে কে বাঁচিয়ে রাখছে। এমনও হতে পারে আপনার জন্মের সময় কোন এক পল্লী ডাক্তার চিকিৎসা না দিলে হয়তো জন্মের সময়ই আপনি মারা যেতেন। অথবা আপনার মায়ের বুকের দুধ খাওয়ার সৌভাগ্য আপনার নাও হতে পারতো।
এ দেশে অনেক পাশকরা ডাক্তার সাহেবের বাবা হয়তো পল্লী ডাক্তার ছিলেন বা আছেন। নিজের জীবনের স্বপ্নকে পূরণ করতে হয়তো আপনাকে ডাক্তার বানিয়েছেন। আর আপনি আপনার বাবার পেশাকেই অস্বীকার করছেন!
সমাজে সকল শ্রেণি পেশার মানুষের গুরুত্ব আছে। জটিল রোগীকে সারিয়ে তোলার জন্য যেমন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দরকার তেমনি গ্রামের হত দরিদ্র মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য পল্লী ডাক্তার দরকার। তাই আসুন হিংসা বিদ্বেষ ভূলে পল্লী ডাক্তারদের সম্মান করি। তাদের অধিকার ও পেশাগত স্বীকৃতি আদায়ে সহযোগীতা করি।
বি:দ্র: একটি লেখা তৈরি করতে অনেক মেধা, শ্রম ও সময় ব্যয় করতে হয়। তাই কারো লেখা পছন্দ হলে লেখকের নাম বা উৎসসহ কপি করে প্রচার করবেন। যারা অন্যের লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তারা হয়তো অন্যের বাবাকেই নিজের বাবা মনেকরে জীবন পার করে দিচ্ছেন।
লেখক,
দেওয়ান আবুল হাশেম
লেখক, শিক্ষক, সংগঠক ও পল্লী চিকিৎসক
যুগ্ম আহ্বয়ক