02/04/2025
তখন এফ সি পি এস করে সবে প্র্যাক্টিস শুরু করেছি, চিটাগং মেডিকেলে পোস্টিং, চেম্বারও মেডিকেলের কাছেই। সপ্তাহে তিনদিন বসি, টুকটাক রোগী আসে, মনোযোগ দিয়ে দেখি। এক সন্ধ্যায় একজন এলেন, বছর তিরিশের সুঠাম সুগৌর সুদর্শন চেহারার একজন, একটা কোম্পানিতে চাকুরী করেন। তিনদিনের জ্বর, গায়ে ব্যাথা। প্যারাসিটামল খেয়েছেন, একখানা এন্টিবায়োটিকও শুরু করে দিয়েছেন নিজ থেকেই। সকাল থেকে দাঁতের মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়ছে, তাই এসেছেন। দেখেশুনে মনে হলো ডেঙ্গু হতে পারে, দাঁতের মাড়ি দেখে কেমন যেন লাগলো। তাড়াতাড়ি রক্ত পরীক্ষা লিখে রিপোর্ট নিয়ে যোগাযোগ করতে বললাম। পরদিন তিনি এলেন রিপোর্ট নিয়ে, সাথে তাঁর ছোট ভাই। রিপোর্ট খুলে দেখে আমার বুকটা একেবারে ধ্বক করে উঠলো! খুবই খারাপ প্রকৃতির ব্লাড ক্যান্সার! রক্তের ভেতর ক্যান্সার কোষ একেবারে থিক থিক করছে। সাথে সাথেই তাঁকে মেডিকেলে পাঠিয়ে দিয়ে সেদিন খুব মন খারাপ করেই বাসায় ফিরেছি।
পরদিন সকাল সকাল মেডিকেলে গিয়েই চলে গিয়েছি ইউনিট টু তে। ছাত্রদের পরীক্ষা আছে। তো পরীক্ষার জন্য রোগী বাছাই করছি, হঠাৎ দেখি গতকালের রোগীর ভাই, বারান্দার দরোজার কাছে দাঁড়িয়ে। তাকে দেখেই কাছে গিয়ে তাঁর ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করাতে তিনি হাত বাড়িয়ে দেখালেন পাশের স্ট্রেচারের দিকে। আমি হতভম্ব হয়ে এগিয়ে মাথার চাদর সরিয়ে দেখলাম মানুষটি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। কিছুক্ষণ আগেই। কপালে হাত রাখলাম, এখনো গরম! আহা! কাল রাতেও বাহ্যিক ভাবে একেবারে সুস্থ মানুষটির কি অদ্ভুত বিদায়! জীবন এতো অনিশ্চিত!!
কাল বিকেলে ফেসবুক ঘাটাঘাটি করছি। একজন চিকিৎসক, তাঁর নামটি খুব সুন্দর এবং খানিকটা অপ্রচলিত, তাই বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর কমেন্ট আমার চোখে পড়ে। আমার অনেক ছোট। ঢাকার বাইরের একটা মেডিকেল কলেজে লেকচারার হিসেবে আছেন, একটা ছোট্ট মিষ্টি মেয়ের মা। একেবারে সুস্থ একজন মানুষ, কদিন আগেই এক সপ্তাহের একটা ট্রেইনিং করেছেন। হুট করেই, একেবারে আকস্মিকভাবেই তাঁর ফুসফুসের ক্যান্সার ধরা পড়লো, যা ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে গেছে তাঁর যকৃৎ , মস্তিষ্ক আর হাড়ে! অর্থাৎ স্টেজ ফোর ক্যান্সার! এতোটুকু জানান না দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সব জায়গায়।
অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করেন কিভাবে সচেতন থাকতে পারি, আগে থেকে বুঝতে পারি। অনেক ক্ষেত্রেই লক্ষ্মণ দেখে বোঝা যায়, কিন্তু কখনো কখনো মৃত্যু হানা দেয় একেবারে অতর্কিতে, নিঃশব্দ পায়ে। কি অনিশ্চিত এই জীবন। এক সেকেন্ডের ভরসা নাই! অথচ এই জীবন নিয়ে কতো আয়োজন, কতো পরিকল্পনা, কতো চিন্তা ভাবনা! ক্ষমতার লড়াই, অর্থবিত্তের বড়াই! অথচ আপনি বিশাল কেষ্ট বিষ্টু হতে পারেন, হতে পারেন অর্ধ পৃথিবীর অধিশ্বর কিংবা বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী, কিন্তু আসলে কি জেতা যায়? শুধু মৃত্যুর কাছেই আপনি ঢাল নেই তলোয়ার নেই, এক নিধিরাম সর্দার হয়ে থাকবেন, জীবন আসলেই বড়ো অনিশ্চিত!!
-Dr.Shahnoor Sarmin