16/02/2023
                                            লিভার সিরোসিসজনিত পেটে পানি জমা**
লিভারের বিভিন্ন রোগে পেটে পানি (Ascites) জমতে পারে। এটি লিভারের রোগের গুরুতর অবনতির লক্ষণ নির্দেশ করে। লিভার রোগে পেটে পানি জমলেই চিকিৎসকরা শঙ্কিত হয়ে উঠেন। তবে লিভার রোগের অ্যাসাইটিসের বেশির ভাগ কারণেই সিরোসিস। অনেক সময় রোগীর অজান্তে বাড়তে থাকে লিভার রোগ। রোগী জানতেই পারে না তার রোগের খবর। পেটে পানি আসলেই প্রথম টের পান তার রোগ সম্পর্কে কিন্তু ততদিনে রোগ গড়িয়ে যায় অনেক দূর।
কারণ:
কি কারণে লিভার সিরোসিসে পেটে পানি জমে তা এক জটিল বিষয়। সাধারণত : ১. পোর্টাল হাইপারটেনশন, ২. কিডনীর অতিরিক্ত সোডিয়াম ধারণ, ৩. উদরস্থ রক্তনালী মোটা হয়ে যাওয়া, ৪. রক্তে এলবুমিন কমে যাওয়া ইত্যাদি কারণে পেটে পানি জমে থাকে। লিভার রোগে কিডনীতে এক ধরণের ভুল সিগনাল যায়। তখন শরীর পানির পরিমাণ কমে গেছে বলে মনে করে। আর তখনই কিডনি প্রচুর পরিমাণে সোডিয়াম এবং পানি ধারণ করে রাখে। এ ধারণকৃত পানিগুলোই পেটে জমা হয়।
রোগের লক্ষণ:
সিরোসিসে পেটে পানি হঠাৎ করেও হতে পারে। আবার ধীরে ধীরেও হতে পারে। পানি জমার সাথে পেট ফুলে যায় ও পেট ফাঁপা বোধ হতে পারে। সাধারণত এ সময় সিরোসিসেররোগীদের স্বাস্থ্যহানি ঘটে। শরীরে ঘাম কমে যায়। হাত ও পায়ের মাংসগুলো শুকিয়ে যায় এবং পেটটা অনেক ফুলে যায়। অনেক পানি জমলে শ্বাসকষ্ট বোধ হতে পারে। পেটের উপর চাপ বেড়ে যাওয়ায় হার্নিয়া দেখা দিতে পারে। পেটের চামড়ার উপরস্থ শিরাগুলো মোটা হয়ে যেতে পারে। পেটের পানি বুকে অর্থাৎ ফুসফুসেও জমা হতে পারে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা:-
সিরোসিসজনিত Ascites এ প্রচুর পরীক্ষা- নিরীক্ষা করতে হয়। কোন কোনটি বারবার করতে হয়। কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট, রক্তে বিলিরুবিন, এস.জি.পি.টি (SGPT) এস.সি.ও.টি (SCOT) এলবুমিন, এলকালাইন ফসফেটেজ, প্রোথ্রোম্বিন টাইম, ইলেট্রোলাইট, ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন, বিভিন্ন ভাইরাল মার্কার, বুকের এক্সরে, পেটের আলট্রাসনোগ্রাম, এন্ডোস্কোপী করতে হয়। প্রস্রাবের সাধারণ রুটিন পরীক্ষার সাথে সোডিয়ামও দেখতে হয়। পেটের পানি বের করেও বিভিন্ন পরীক্ষা করার প্রয়োজন হয়। তাছাড়া রোগীর প্রতিদিন প্রস্রাবের পরিমাণ ও   ওজন নিতে হয
চিকিৎসা:-সিরোসিসে পেটে পানি জমে গেলে বিভিন্নভাবে চিকিৎসা দেয়া হয়। প্রাথমিকভাবে অবস্থার উন্নতি হলেও এক পর্যায়ে এমন অবস্থা হয় যে আর কোনো চিকিৎসায়ই কাজ করে না। তখনএটাকে রিফ্র্যাকটরী অ্যাসাইটিস(Refractory Ascites) বলে। আবার অতিউৎসাহ চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে রোগীকে নিয়মিত মনিটর করতে হয়। প্রতিদিন রোগীর ওজন ও প্রস্রাবের পরিমাণ নির্ণয় করতে হয়। নিয়মিত রক্তের ইলেকট্রোলাইট ও প্রস্রাবে সোডিয়ামের পরিমান নির্ণয় করা লাগতে পারে। নিম্নলিখিতভাবে চিকিৎসা করা যেতে পারে। করে।
পূর্ণ বিশ্রাম:-
সিরোসিসে পেটে পানি জমলে রোগী আর বেশী পরিশ্রম করতে পারে না, প্রয়োজন বিশ্রামের।
লবন কম খাওয়া:-
আমরা যে লবন খাই তাতে রয়েছে সোডিয়াম। অন্যদিকে সিরোসিস রোগে শরীরে সোডিয়ামের পরিমাণ বেড়ে যায় বলেই পানি জমে যায়। এজন্য রোগীরদের ভাতের সাথে লবণ খেতে নিষেধ করা হয়। অনেকে মনে করেন লবন একটু ভেজে খেলে কোনো অসুবিধা নেই। বস্তুত: কাঁচা, ভাজা ও রান্না লবনের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। অতএব লবন কম খেতে হবে। অন্যান্য স্বাভাবিক খাবার আগের মতই খেতে হবে। সাধারণভাবে মাছ, মাংস, ডিম খাওয়া যাবে।মূত্রবর্ধক ওষুধ (Diuretics) সিরোসিসে পেটে পানি জমলে ২ ধরণের মূত্রবর্ধক ব্যবহার করা হয়। একটি হলো ফ্রুসেমাইড অপরটি স্পাইরোনোল্যাকটোন। এ দুটি একত্রে বা আলাদা আলাদা ব্যবহার করা যায়। মাত্রাটি ধীরে ধীরে বাড়াতে হয়। প্রয়োজনের অতিরিক্ত চিকিৎসা বিভিন্ন জটিলতা তৈরী করে। এজন্যপ্রতি ৪ দিন অন্তর প্রয়োজন হলে মাত্রা বাড়াতে হয়। এর সর্বোচ্চ মাত্রা হচ্ছে ফ্রুসামাইড ১৬০ মিলিগ্রাম ও স্পাইরোনোল্যাকটোন ৪০০ মিলিগ্রাম তার সাথে এলবুমিন ইনজেকশন
দিলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
পেটের পানি ফেলে দেয়া- (Paracentesis):- পেটে পানির পরিমান বেশী হলে কিংবা চিকিৎসায় কাজ না হলে অনেক ক্ষেত্রে পেটের পানি বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে বের করে দিতে হয়। বেশী পরিমাণ পানি ফেলতে হলে এর সাথে এলবুমিন ইনজেকশন দিতে হয়। এটা বার বার করা লাগতে পারে।
সার্জারী:-
উপরোক্ত চিকিৎসায় কাজ না হলে বিভিন্ন সার্জারী করা হয়। এগুলো সান্ট সার্জারী বলা হয়। এগুলো অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সে হিসাবে বলে উপকারীতা প্রশ্নাতীত নয়।
পরিণতি:-
সিরোসিসে পেটে পানি আসা একটি মারাত্মক লক্ষণ। একবার পেটে পানি আসলে শতকরা মাত্র ৪০ ভাগ রোগী ২ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। যাদের হঠাৎ করে পানি আসে তাদের পরিণতি অবশ্য তুলনামূলকভাবে ভালো ।
জটিলতা:-
পেটে পানি আসা লিভার সিরোসিসের একটা জটিলতা। আবার পানি আসার কারণও কিছু জটিলতা দেখা দেয়। এ জটিলতাগুলো অত্যন্ত মারাত্মক। যেমন- পেটের পানির দ্বারা শরীরে ইনফেকশন হতে পারে। এটাকে (SBP Spontanious Bacterial Peritonitis)বলে। লিভারজনিত কারণে কিডনী নষ্ট হতে পারে। এটাকে হেপাটোরেনাল সিনড্রোম (Hepatorenal Syndrome) বলে। তাছাড়া রক্তে পানির পরিমাণ বেড়ে যাবার কারণে সোডিয়াম কমে যেতে পারে এবং রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।
উপসংহার:-
লিভার সিরোসিসে পেটে পানি জমলে নিয়মিত তত্ত্বাবধান ও প্রতিদিন রোগীর সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে চিকিৎসা করতে হয়। এটি একটি প্রাণ সংহারক ও অত্যন্ত ব্যয়বহুল রোগ। লিভার প্রতিস্থাপনই এ পর্যন্ত আবিস্কৃত প্রকৃত চিকিৎসা। কেবলমাত্র স্বাস্থ্য সচেতনতার মাধ্যমে এর প্রতিরোধই আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য একমাত্র উপায়।