
12/09/2025
শৈশবের স্মৃতিঃ
সেই বিংশ শতকের শেষ দিকের কথা।
মাত্র ৩ টাকার ইকোনো বলপেন—শিশু-কিশোরদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সঙ্গী, আবার সবচেয়ে অবিশ্বস্তও। হঠাৎ করেই কলমের পেছন দিক দিয়ে কালি ফেটে বেরিয়ে আসত। ফলে শার্ট বা প্যান্টের পকেটের নিচে ঘন কালির দাগ নিয়ে স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা ঘুরে বেড়াত। আশ্চর্যজনকভাবে, তাতে কারও বিশেষ ভ্রুক্ষেপ ছিল না। কারণ, সবাই জানত—৩ টাকার ইকোনো মানেই এরকমই দুর্ঘটনা। আর এই দুর্ঘটনার নামই তখন ছিল—“কলম হেগে দিয়েছে”! এক অদ্ভুত শব্দ, কিন্তু সেই এক শব্দেই পুরো ঘটনা ব্যাখ্যা হয়ে যেত।
তারপর এলো নতুন যুগ—সাড়ে ৩ টাকার ইকোনো ডিএক্স। কালো, লাল, নীল—তিন রঙেই পাওয়া যেত। কিন্তু যেখানে কালো কলম কেনার বাড়তি পঞ্চাশ পয়সাতেই মায়ের কঠোর নিষেধাজ্ঞা, সেখানে লাল-নীল কেনা তো স্বপ্নই বলা চলে। অথচ আমার ভীষণ ইচ্ছে হতো—একটা নীল দিয়ে আকাশ রাঙাই, একটা লাল দিয়ে বইয়ের ছবির বউয়ের কপালে টুক করে টিপ এঁকে দিই। কিন্তু সব ইচ্ছে কি ডানা মেলে উড়তে পারে? বেশিরভাগই ডানা ভাঙা পাখি হয়ে ঝরে পড়ে কঠিন মাটিতে।
লিখতে লিখতে যখন কালি ফুরিয়ে যেত, আম্মার কাছে যেতাম—
“৩ টাকা দেন, নতুন কলম লাগবে।”
আম্মা কড়া চোখে কলমের দিকে তাকাতেন। নিবের ভেতরে জমে থাকা কালির দিকে ইশারা করতেন। তারপর মোমবাতির আগুনে গলিয়ে সেই জমাট কালি আবার ব্যবহারযোগ্য করে দিতেন। নতুন কলম আর জুটত না। গলে যাওয়া কালি দিয়ে আবার দু-চার দিন চলত।
তবু আমরা দমে যাইনি। ওই ৩ টাকার ইকোনো দিয়েই স্বপ্ন বুনেছি। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা কিংবা কারও ফুরিয়ে যাওয়া কলম জমিয়ে রেখেছি। সেগুলোর সামনের দিক-পেছনের দিক গলিয়ে জোড়া লাগিয়েছি। তাতে তৈরি হয়েছে হ্যাঙ্গার, খেলনা বন্দুক, এমনকি কারও কারও হাতে তৈরি হয়েছে আস্ত আলনা! স্কুলে চলত “কলম-কলম খেলা”। কলমের মুখ গলিয়ে ফুঁ দিলে বের হতো স্বচ্ছ বুদবুদের মতো গোলাকার বল—আহা! সে আনন্দের তুলনা নেই। তবে মাঝে মাঝে কলমের নিবের গুঁতোয় গাল বা কপাল ফোঁটার ভয়ংকর গল্পও শোনা যেত।
আজ অনেক বছর পর হঠাৎ লিখতে বসে দেখি—কলম নেই। খুঁজতে খুঁজতে ১০ মিনিট কেটে গেল, কিন্তু একটি কলমও মিলল না। ঘরজুড়ে কেবল ল্যাপটপ, তার কিবোর্ড, আর ক্ষয়ে যাওয়া অক্ষরগুলো। আমার আঙুলের মাথা প্রতিদিনই ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে, কিবোর্ডের উপর বয়ে যাচ্ছে অক্ষরের নদী। অথচ কলম—সে তো অনেক আগেই হারিয়ে গেছে।
কলমের সঙ্গে যেন হারিয়ে গেছে আমার শৈশব, আমার গল্প, আমার অনুভূতি। হঠাৎ প্রবল ইচ্ছে হলো—একটা ইকোনো কলম হাতে নিতে। তার ক্লিপ খুলে নাকে ধরে শুঁকতে। যদি পাই সেই ঘ্রাণ—কালির ঘ্রাণ, দাগের ঘ্রাণ, গল্পের ঘ্রাণ, শৈশবের ঘ্রাণ, এমনকি জীবনের সঙ্গে মিশে থাকা যন্ত্রণারও ঘ্রাণ...