16/12/2021
সেই সুপারি আর নারকেল ঘেরা খয়েরি রং এর দোতলা বাড়িটি আজ কোলাহল হীন।
শুধু মাঝ রাতে হুতোম পেঁচার ডাক আর তার সাথে বাড়ির গিন্নিমার ঘুমোট কান্নার গোঙানি তে এক অদ্ভুত পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সারা রাত এক জোড়া চোখ প্রচন্ড অভীমানে নিদ্রাহীনতায় রাত পার করে। শেষ রাতের দিকে বাড়ির পুকুর ঘাটে কেউ হঠাং টুপটাপ শব্দে জলে ঢেউ তোলে।
তারপর রাতের নিস্তব্ধতা পেরিয়ে ভেসে আসে মিহি কন্ঠে কোরআনের সুর। আকুল আবেদনে ভরিয়ে ধরেন মোনাজাত। মেয়েটি চুপটি করে অনেক দূর থেকেই শুনে যায় তার জননীর বেকুল কান্না।
বাড়ির সবথেকে ছোট্ট মেয়ে সে। এই তো সেদিনই স্কুল থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ি
ফিরে-রাস্তার মাথা থেকেই 'মা' 'মা' শব্দে পুরো বাড়ি কাঁপিয়ে তুলতো সে। বাবা তখন দরজা খুলে মিষ্টি হেসে বলতো "কই গো, 'কাঞ্চন' মনারে ভাত দেও"। 'মা' টি তখন ভয়ে ভয়ে ভাত বেড়ে দিতেন। কী জানি আজ আবার কী কান্ড করে তার দস্যি মেয়ে! পছন্দের তরকারি না ফেলেই প্লেট ছুড়ে ফেলার খারাপ বদঅভ্যাস আছে মেয়েটার। দোষটুকু পুরোটাই তার বাবার।
সারাজীবন বাকি ৬ সন্তানকে বাবাই শাসনের উপর রাখতেন।কিন্তু এই ছোট্ট মেয়েটিকে কোন ভাবেই শাসন করতে রাজি নয় তিনি। তাই মায়ের হয়েছে এক জ্বালা।মেয়ে আদর পেয়ে পেয়ে বাঁদর হচ্ছে দেখে মা ই শাসনের ভার হাতে নিয়েছিলেন। ভাত নিয়ে বাহানা করায় দিয়েছিলেন শলা দিয়ে মাইর, তারপরের ২ দিন তো মেয়ে দিব্যি উপোস কাটিয়ে দিলো। স্কুলে যাচ্ছে, পড়া রেডি করছে, সব স্বাভাবিক, শুধু না খেয়ে খেয়ে মুখ টি করেছে এইটুকুন। এদিকে মেয়ের বাড়ন্ত বয়েস, স্কুলে ফার্স্ট সে, সামনে ক্লাস নাইনের ফাইনাল পরীক্ষা।সব মিলিয়ে মাকেই তার রাগ ভাঙ্গানোর দায়িত্ব নিতে হলো। কোন দিন কারো সাথে রাগ হলে আগে কথা না বলা পাটোয়ারির মেয়ে, আজ মোল্লার ছোট্ট মেয়েটির কাছে হেরে গিয়ে নিজেই ভাতের প্লেট হাতে হাজির হলেন মেয়েটির ঘরে।
বাবা মা এর মাত্রাতিরিক্ত আদর আর পড়াশোনা। এই দুটি নিয়েই ছিলো মেয়েটির জীবন। সকালে পরোটা আর রাতে দুধে-ভাতে থাকা মেয়েটি হঠাৎ এভাবেই স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে উঠার পর পরই জীবন নামের বাস্তবতার সম্মুখীন হয়। হোস্টেলে এসে সকালে ভর্তা-ভাত এবং রাতে টিকটিকি পড়া ডাল আর আলুর দমে তার নিজের দমটাই পুরিয়ে আসে। কিন্তু সপ্তাহ শেষে কলেজ ফোনে আসা বাবার একটা কল তাকে স্বপ্ন দেখায়,নতুন উদ্যোমে বাঁচতে শেখায়। বাবা যে তাকে শর্ত দিয়েছে ডাক্তার হবার।
হুম মেয়েটার স্বপ্ন পূরণ হয়। আল্লাহ্ এর অশেষ রহমতে এখন সে ডাক্তার। নামের আগে ডাক্তার শব্দটা যোগ করতে না করতেই তার ডাক আসে দায়ীত্ব নেবার। মেয়েটিও ডাক্তার শব্দটির ভারীত্ব অনুভব করে, তাই তো দূরত্ব বজায়ের প্রাক্কালে ও যোগদান করে এক মহান সেবায়। যেই সেবায় সে শপথ নেয় " I solemnly pledge myself to consecrate my life to the service of humanity. "
এক প্রতিকূল পরিবেশে সে ডাক্তারী করতে থাকে। সকাল ৬ টায় রান্না করে, ফ্ল্যাট পরিষ্কার করে অফিস আওয়ারে হাসপাতালে ছোটা, গ্লাভস দিতে অস্বিকার করা নার্সদের সাথে তর্কে না গিয়ে গ্লাভস বিহীন রোগী দেখা, এভাবেই ইভিনিং কিংবা নাইট করে আসার পর ঘরে ফিরে মাঝে মাঝে বাজার না থাকলে, দিব্যি উপোস কাটিয়ে দিতে হয় তাকে।কিন্তু তাতে তার কিছু যায় আসে না। তার জীবন এখন তো যার তার জীবন নয়। ডাক্তারের জীবন।
এইতো সেদিন, "রাহুল" নামের ছেলেটা অপারেশান শেষে সুস্ত হয়ে বাড়ি ফিরছিল।সিঁড়ির গোড়ায় মেয়েটির দিকে তাকিয়ে যেই কৃতজ্ঞতার হাসি দিয়েছিলো-পিচ্চি ছেলেটা। এই হাসিটার জন্যই মেয়েটা নিজেকে কোরবান করে দিতে পারে।
ছোট একটা ফরেন বডি বের করে দেয়ার পর কৃষক চাচা যখন পুরোনো মলিন একশ টাকার নোট টা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলো "এটা আমার আশির্বাদ তোমার জন্য মা"। ঐ মলিন নোট টা ওকে গুটিয়ে এইটুকুন করে দেয়। মিষ্টি হেসে চাচার কাছে মুখের আশির্বাদ চেয়ে ফিরে যায় সে।
কোরবানির ঈদ সন্নিকটে। মেয়েটি জানে হয়তো এই ঈদটি ও তার বাবা মায়ের সাথে করা হবে না। গত কয়েকদিন থেকে হালকা জ্বরে ভুগছিলো সে।
তার মায়ের বারবার করা বায়না সে হেসে ফিরিয়ে দেয়। মা ভাবে "মেয়েটা কী বদলে গেছে। বাবা- মা কে ভুলে বসেছে?"
মায়ের অভীমান হয়।প্রচন্ড অভিমান।
মেয়েটা বুঝে তার মায়ের অভীমানের যতটা না ক্ষমতা আছে, 'করোনা' নামক ভাইরাস টা কে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তার থেকে অনেক অনেক কম।
যেদিন মায়ের FNAC রিপোর্ট টা হাতে এসেছিলো সেদিন ই তো শপথ নিয়েছিল মেয়েটা, মাকে সবকিছুর বিনিময়ে আগলে রাখার শপথ।
ঈদ আসছে। নিজের প্রিয় কিছু কোরবানি করার ঈদ।
জ্বর বাড়ছে। মেয়েটা আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করছে "I solemnly pledge myself to consecrate my life to the service of humanity. "
কোরবানি
By Jannat Eity
(প্রিয় একটা লেখা, রিপোস্ট,, নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার প্রেরণা পাই নিজের লেখায়)