21/08/2025
বিগত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে, আমার ছোটবেলা কেটেছিল মানিকগঞ্জের ইছামতীর তীরে এক নিবিড় গ্রামে, গ্রামের নাম খেরুপাড়া।
যেখানে সকলেই কৃষিকাজ করতো। সেখানে আমি দেখেছিলাম জৈব চাষ, দেখেছিলাম নির্মল প্রকৃতি। এর মধ্যেই পড়ালেখার কারনে আমাকে গ্রাম ছাড়তে হয়, চলে আসতে হয় ঢাকায়।
সব কিছু ছেড়ে ঢাকায় চলে এলেও মন পড়ে থাকতো গ্রামে। যেখানে ছিল আমার শৈশবের বন্ধুরা, আমার ঘুড়ি উড়ানোর দিগন্তজোড়া মাঠ, আমার ইছামতী নদী আর আমার দাদাদাদী।
প্রায় সারাক্ষণই মাথায় এক শ্যামল গ্রাম বয়ে বেড়ানোর কারনে আমি কখনোই শহুরে জীবনে অভ্যস্ত হতে পারতাম না, দিন গুনতাম কবে আবার ফিরবো গ্রামে।
গ্রামে ফিরেই চলে যেতাম ফসলের মাঠে, গ্রামের বন্ধুরা মাঠে কাজ করতো, আমিও কাঁধ মেলাতাম। ওই থেকে কৃষির প্রতি ভালোবাসা দৃঢ় হয়।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সবকিছু বদলে যেতে থাকে। আমার গ্রাম একটু একটু করে পরিবর্তিত হতে থাকে, দূষণে আক্রান্ত হতে থাকে।
বিশেষ করে জমিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার, কীটনাশকের ব্যবহারে কৃষি জমি নষ্ট হতে থাকে।
এছাড়াও সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকে চারপাশ ভরে যেতে থাকে। যে পথ ধরে আমি আমার গ্রাম আর শহরে যেতাম, তার নাম ঢাকা আরিচা মহাসড়ক।
খোলা ফসলের মাঠের ভেতর দিয়ে পাটুরিয়া ঘাট থেকে ঢাকার গাবতলীতে মিশেছে এই সড়ক। ছোটবেলার এই সড়কের দুপাশের সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করতো।
শীতে আদিগন্ত হলুদ সরিষার ক্ষেত, বর্ষায় কুল ছাপানো বানের জলে ছোট ছোট ডিঙি নৌকা আর জল ভেজা বাতাস। স্বর্গ যেনো এখানেই।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে দৃশ্যপট দ্রুত বদলে যেতে থাকে। ফসলের মাঠগুলো দখল করে নেয় কারখানা আর নদীগুলো নীল হয় কারখানা নির্গত বিষাক্ত পানিতে। ইটভাটার কালো ধোঁয়া গ্রাস করতে থাকে, আকাশ এবং বায়ুকে।
প্রকৃতির নির্মলতা চিরদিনের জন্য হারিয়ে যেতে দেখি চোখের সামনে। দূষণের চূড়ান্ত রূপ বহিঃপ্রকাশ হতে থাকে একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে, আমিও ততদিনে স্কুল পেরিয়ে কলেজে উঠে গেছি।
২০০৬ এ পরিবেশ, দূষণ ইত্যাদি নিয়ে পড়তে টুকটাক পড়তে থাকি মূলত পত্রিকায়, বিস্তারিত বোঝার চেষ্টা চলতে থাকে। দেখে ফেলি আল গোরের গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে তৈরি ডকুমেন্টারি "দ্যা ইনকনভিনিয়েন্ট ট্রুথ"।
এটা দেখার পর গ্লোবাল ওয়ার্মিং মাথার মধ্যে পোকার মত ঘুরতে থাকে।
এরপর দেখে ফেলি লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিওর "the eleventh hour". এটাও চিন্তা জগতে বিরাট প্রভাব ফেলে।
এরপর একের পর এক পরিবেশ সংক্রান্ত ডকুমেন্টারি দেখতে থাকি। এগুলো থেকে নানা গবেষক ও লেখকের সন্ধান পাই। তাদের বই পড়তে থাকি, যেমন Elizabeth Kolbertএর The Sixth Extinction: An Unnatural History।
ইন্টারনেটের কল্যানে আন্তর্জাতিক পত্র পত্রিকার পরিবেশ সংক্রান্ত খবরগুলো জানার সুযোগ হয়। the guardian পত্রিকার the guardian environment বা NY times এর পরিবেশ সংক্রান্ত কলামগুলো।
সব মিলিয়ে আমি বিপন্ন বোধ করতে থাকি এবং ভাবতে থাকি পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষায় কি করা যায় জলবায়ু পরিবর্তন যদি ধীরে ধীরে চূড়ান্ত রূপ নেবে তখন কিভাবে কৃষক টিকে থাকতে পারবে।
যেহেতু ছোটবেলা থেকেই কৃষি নিয়ে আগ্রহ ছিল। তাই ভাবলাম এমন কৃষি করবো, যেটায় পরিবেশ নিয়ে কাজ করা হবে।
আমরা এমন এক দেশে থাকি, যেখানে পড়াশোনা শেষ করে গ্রামে ফিরে যাওয়া মেনে নিতে চায় না সমাজ।
মানুষ যেখানে শহরমুখী, আমি ফিরতে চাইছি গ্রামে। পরিবার, সমাজ কেউ মেনে নিচ্ছিল না।
২০১১ তে যুব উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে দেড় মাসের আবাসিক কৃষি কোর্স করি। এরপর টুকটাক কৃষি করতে থাকলেও খুব এগুচ্ছিল না।
এরপর ২০১৫তে oisca নামের একটা জাপানীজ এন জি ও তে জৈব কৃষির ওপর ছয় মাসের নিবিড় আবাসিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। এটা খুব কাজে দেয়।
এরপর পরিকল্পনা করি এমন একটা খামারের যেখানে জৈব চাষ করা হবে। দেশীয় বীজ ব্যবহার করা হবে এবং দেশীয় আদি জৈব প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন করা হবে। দেশীয় বীজের ব্যবহার করা হবে। কারন দেশীয় বীজ তুলনামূলকভাবে বেশী বৈরীতা সহ্য করে টিকে থাকতে পারে।
ঝড় বৃষ্টি বন্যা খরায় টিকে থাকার শক্তি এই ফসলগুলোর থাকে। শুরু করি দেশি বীজ সংগ্রহের কাজ,
নানা ধরনের ধানের বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ শুরু করি। আমাদের দেশে এক সময় হাজার হাজার জাতের আমন ধান ছিল। কোনটা খরা সহিষ্ণু, কোনটা গভীর পানি বা বন্যায় টিকে থাকতে পারতো। কোনটা ভাতের জন্য ভালো তো আবার কোনটা পিঠে বানানোর জন্য ভালো।
আমার এলাকায় অনিয়মিত বন্যা ও ফ্লাশ ফ্লাডে আমনের ফলন নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কৃষক আমন চাষে অনাগ্রহী হয়ে পড়ে।
আমি টাঙ্গাইল থেকে চামারা নামের এক জাতের আমন কৃষকদের এনে দেই এবং নিজেও কিছুটা চাষ করি। যেটা ফ্লাস ফ্লাড ওভারকাম করে টিকে থাকে। ফলে কৃষক আবার আমনে আগ্রহী হয় এবং পুনরায় চাষ করতে থাকে।
এছাড়াও আমরা দেশি জাতের শাক সবজি উৎপাদন করে সফল হই। এগুলো একটু কম ফলনশীল হলেও কম যত্নে করা যাচ্ছে ফলে কৃষকের সময় বেচে যাচ্ছে।
কৃষকদের আপনি নতুন কোনো কাজে খুব সহজেই জড়াতে পারবেন না। কারন ফসল না ফললে তাদের আহার হবে না, আয় হবে না। ফলে কৃষকদের আগ্রহী করতে কৌশলী হতে হয়।
এ ক্ষেত্রে আমার কৌশল ছিল কৃষাণীকে তার উঠোন ফসলে দেশী বীজ ব্যবহার করানো এবং তাতে নিজের তৈরি জৈব সার ও কীটনাশক ব্যবহার করানো।
কৃষাণী যখন দেখলো খুব সহজেই বাড়ির আঙিনায় বিনা খরচে শাক সবজি করে পরিবারের চাহিদা মেটানো সম্ভব এবং বিক্রি করে বাড়তি আয় সম্ভব। তখন তারা আমার ওপর ভরসা পেলো।
আমি ২০১৫ সাল থেকে খুব মনোযোগ দিয়ে যে দুটো জিনিস চর্চা করছি, তা হচ্ছে বাড়ির আশপাশের জিনিসপত্র দিয়ে খুব সহজেই কি করে জৈব সার তৈরি করা যায় এবং জৈব বালাইনাশক তৈরি করা যায়।
আমাদের চেষ্টার ফলে কৃষানীরা ধীরে ধীরে জৈব চাষে আগ্রহী হচ্ছে।
আমরা নারীকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করি, কারন নারীর মমতা এক অনন্য জিনিস। একমাত্র নারীর মমতায় পৃথিবীর যত্ন নিলেই কেবল পৃথিবীর গ্লোবাল ওয়ার্মিং নামক জ্বর সারানো সম্ভব। এখন পর্যন্ত আমাদের খামারে কৃষানীরাই এগিয়ে।
কৃষানীদের উৎপাদন বাড়ালেই তো শুধু হবে না। উৎপাদিত বাড়তি পণ্য বিপণন করে দিলে আশপাশের আরোও মানুষ উৎপাদনে আগ্রহী হবে।
এই ভাবনা থেকে শস্য ইউটিউব চ্যানেল, ফেসবুক পেইজ থেকে কৃষকের পণ্য বিপণন শুরু করে দিলাম।
এতে করে শহরের মানুষ নিরাপদ খাদ্য পাচ্ছে এবং গ্রামের কৃষকরা একটা আর্থিক নিশ্চয়তা পাচ্ছে।
স্থানীয় বাজারে বিপণন চলছে এবং সফল হচ্ছে।
স্থানীয় বাজারে দোকান নিয়ে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারলে কার্বন জ্বালানি ব্যবহারের প্রয়োজন হবে না, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এভাবেই শহর ছেড়ে গ্রামে এসে থিতু হলাম, নিরাপদ খাবার আর সাসটেইনেবল পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে ও প্রকৃত কৃষিচর্চা টা ধরে রাখাই আমার মুল উদ্দেশ্য।
আশা করি আমার এই জার্নিতে আপনাদের ও পাশে পাবো।
ভালো থাকুক পৃথিবী, নিরাপদ হোক খাবার।