27/05/2025
এই শহর দিনের শেষে যখন ঘুমিয়ে পড়ে, ঠিক তখনই কোথাও না কোথাও একটা ছেলেমেয়ে চুপিচুপি রেখে যায় তার শেষ চিঠিখানা। শব্দগুলো কাঁপা হাতে লেখা—"ক্ষমা করে দিও", "আর পারছি না", "চাপ নিতে নিতে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে..."
আরেকটি জীবন নিভে যায়, আরেকটি স্বপ্ন মাটির নিচে চাপা পড়ে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসছে একই রকম সংবাদ। কখনো ঢাকা, কখনো রাজশাহী, আবার কখনো চট্টগ্রাম কিংবা খুলনা—কোনো এক কলেজছাত্র, স্কুলপড়ুয়া কিশোর, বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী চলে যাচ্ছে চিরতরে। বয়স মাত্র ষোল থেকে কুড়ি। চোখে থাকার কথা ছিল আকাশছোঁয়া স্বপ্ন, কণ্ঠে থাকার কথা ছিল জীবনের গান। অথচ তারা বেছে নিচ্ছে মৃত্যু, বেছে নিচ্ছে নীরবতা।
এই কি সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ?
যেখানে একজন শিক্ষার্থীকে তার ফলাফল দিয়ে বিচার করা হয়, তার ক্লান্তি বোঝা হয় না?
যেখানে ভালোবাসার চেয়ে প্রত্যাশা বড় হয়ে দাঁড়ায়—এত বড় যে, তাতে চাপা পড়ে যায় কারো হৃদস্পন্দন?
এই প্রজন্ম ভেঙে পড়ছে, কারণ তাদের কান্না কেউ শুনতে চায় না। তাদের ক্লান্তি কেউ বুঝতে চায় না। বাবা-মা চায় সাফল্য, শিক্ষক চায় নম্বর, সমাজ চায় ‘প্রতিযোগিতায় জয়ী এক মডেল সন্তান’। কিন্তু এই ছেলেমেয়েরা কি কোনোদিন বলতে পারে—"আমি একটু হাঁপিয়ে উঠেছি", "আমি একটু কম চাই, একটু শান্তি চাই"?
আমরা অভিভাবক, আমরা শিক্ষক, আমরা সমাজ—আমরা সবাই অপরাধী।
অপরাধী এইজন্য, আমরা শুধু জানতে চেয়েছি ‘রেজাল্ট কেমন?’ কখনো জিজ্ঞেস করিনি, ‘মনটা কেমন আছে?’
এই আত্মহত্যাগুলো আসলে আত্মহত্যা নয়। এগুলো একেকটা সামাজিক ব্যর্থতার সাক্ষ্যপত্র। একেকটা সিস্টেমের ব্যর্থতা, যে সিস্টেমে "মানসিক স্বাস্থ্য" কথাটা এখনো বিলাসিতা, যেখানে কাউন্সেলিংকে এখনো "পাগলের ডাক্তার" বলে অবহেলা করা হয়।
কিন্তু সময় এসেছে রুখে দাঁড়াবার।
সময় এসেছে কান পেতে শোনার—প্রতিটি ক্লান্ত কণ্ঠ, প্রতিটি নিঃশব্দ কান্না।
সময় এসেছে ভালোবাসা দিয়ে বলার—"তুমি একা নও। কথা বলো। শুনছি আমরা।"
এই প্রজন্ম শুধু বইয়ের পৃষ্ঠা নয়—ওরা মানুষ। ওদেরও লাগে বিশ্রাম, ভালোবাসা, আর একটু সহানুভূতি।
ওদের ছায়া যেন না হারায় অন্ধকারে।
ওদের ভাঙা চিঠিগুলো যেন না হয় আমাদের ভবিষ্যতের একমাত্র চিহ্ন।
আমরা কি শুনেছি ওদের? না, আমরা চেয়েছি ওরা শুধু পড়ে, পড়ে, পড়ে—আর সফল হয়।
আমরা যতক্ষণ না বুঝতে শিখি যে ভালো ফলাফলের পাশাপাশি একজন শিক্ষার্থীর মানসিক শান্তি, ভালোবাসা, সম্মান এবং শোনার সুযোগ দরকার—ততক্ষণ এই মৃত্যুগুলো থামবে না।
NCTF-এর তরফ থেকে আমরা বলতে চাই—একা নও তুমি। আমরা শুনি। পাশে থাকি। কথা বলো।
আমরা চাই,
#প্রতিটি স্কুল-কলেজে ছাত্র কাউন্সেলিং সেবা থাকুক,
#শিক্ষকরা শিখুক, কীভাবে ছাত্রদের সাথে সংবেদনশীলভাবে কথা বলতে হয়,
#অভিভাবকরাও বুঝুক—সন্তানের চাপ মানেই ব্যর্থতা নয়।
এই যুদ্ধে অস্ত্র নয়, দরকার কান, মন, আর হৃদয়।
চলো, জীবন বাঁচাই—শুধু নাম নয়, স্বপ্নগুলোও।
[বয়সভিত্তিক পরিসংখ্যান:
১৩-১৯ বছর: আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৬৫.৭%।
২০-২৫ বছর: প্রায় ২৪%
১-১২ বছর: ৭.৪% -
এই পরিসংখ্যান আমাদের সমাজের জন্য একটি সতর্কবার্তা। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব না দিলে, ভবিষ্যতে এই হার আরও বাড়তে পারে। আমাদের উচিত শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ কমানো, পরামর্শদাতা নিয়োগ, এবং পরিবার ও শিক্ষকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।]