25/06/2025
হিসাবের গরমিল!
বৌয়ের পিঠে মারো কিল!
এই বাচ্চা কার বল?
বৌয়ের চোখ টলমল!
২০০৯ সাল। আমি মাত্রই এফসিপিএস শেষ করে এসে নওগাঁয় সাপ্তাহিক প্র্যাকটিস শুরু করেছি। বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্র্যাকটিসের একেবারে প্রথম দিকে এক রোগী এলো। শরীরে নতুন অতিথির আগমন চিহ্ন স্পষ্ট। অনার্স পড়তে পড়তে হঠাৎ দেখতে এসে বিয়ে হয়েছে। অনুষ্ঠানও হয়নি। শ্বশুরবাড়ীর চেহারাও দেখেনি। বিয়ের খবর চাউড় হতে না হতেই নতুন খবর তার জীবনের সব হিসাব গরমিল করে দিয়েছে। খবরটাতে খুশী হওয়ার কথা থাকলেও শ্বশুরবাড়ীর লোকজনের মধ্যে ফিসফাস শুরু হয়ে গেছে। বিয়ের পরে বৌয়ের পিরিয়ডই তো হয়নি! তাহলে এ বাচ্চা আমাদের ছেলের কি করে হয়? এদিকে ডাক্তার আবার বিয়ের আগের পিরিয়ডের হিসাব করে! কি সর্বনাশ! বিয়ে যেহেতু হুট করেই হয়েছে, কাজেই এ বাচ্চা আসলে ওর আগের, আমাদের নয়!
উপায়ান্তর না পেয়ে মেয়ের এক আত্মীয়া আমার কাছে নিয়ে এলেন। হিসাব করে দেখলাম, ওর বিয়ে হয়েছে পিরিয়ডের সাইকেলের যে সময়টাতে, তাতে ধারনা হচ্ছে, বাচ্চাটা মা-বাবার বিয়ের জন্যই কেবল অপেক্ষা করে বসেছিল। এইটারে আসলে 'টোকা দিতেই ফল' বলা যেতে পারে।
সব হিসাব বুঝে নিজে খানিকটা রিলাক্স হয়ে বসলাম রোগীর লোককে বোঝাতে। কেননা, ওদিকে বিয়ের নয় মাস পেরুতে না পেরুতেই বেচারা বৌয়ের বাচ্চা হবে তো হবে, ডিভোর্সও হয়ে যাচ্ছে প্রায়!
শুনুন তবে। কার বাচ্চা ঠিক কত তারিখে কনসিভ করে,এটা কি কেউ বলতে পারে? কারো পক্ষে বলা সম্ভব নয়। লাখে দু’একজন আছে যারা স্পষ্টত: ওভুলেশন পেইন টের পায় ভালভাবে। তারা মোটামুটি ধারনা করতে পারে। এখন ধরে নিন, কেউ যদি স্পেশিফিক্যালি বলে দিল, আমার ঠিক ঐ দিন বাচ্চা পেটে এসেছে। তাহলে ঠিক ঐ দিন থেকে ২৬৬ দিন হিসাব করে বের করলেই বাচ্চা হওয়ার সম্ভাব্য তারিখ আমরা বলে দিতে পারি। বাস্তবে কিন্তু এই ক্যালকুলেশন প্রায় অসম্ভব। কেউই সঠিকভাবে বলতে পারে না, ঠিক কোনদিন কনসিভ করেছে।
তাহলে উপায়? হ্যাঁ, উপায় তো একটা আছেই। আর সেটা আমাদের হিসাবের সুবিধার্থেই। আপনারা অনেকেই জানেন, মেনেস্ট্রুয়াল সাইকেলের মাঝামাঝি সময়ে বাচ্চা কনসিভ করে। কেন করে জানেন তো? কারণ, এই সময় মেয়েদের ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বানু ফুটে বের হয়। তাহলে এই ডিম্বানু ফোটার টাইম বের করতে হলে আমাদের দরকার তার আগের শেষ পিরিয়ডের হিসাব। শেষ পিরিয়ডের প্রথম দিন থেকে ১৪ দিন হিসাব করলেই সাইকেলের মাঝামাঝি হচ্ছে। তাহলে আমরা যদি শেষ পিরিয়ডের প্রথম তারিখের সাথে ১৪ দিন যোগ করি, তাহলে মোটামুটিভাবে ডিম্বানু ফোটার সময় পাওয়া যাচ্ছে অর্থাৎ একটু ঘুরিয়ে বললে বাচ্চা কনসিভ করার তারিখ পাওয়া যাচ্ছে। শেষ পিরিয়ডের প্রথম তারিখটা যেহেতু খুঁজে পাওয়া সহজ, এ কারণে ঐ ২৬৬ দিনের সাথে এই অতিরিক্ত ১৪ দিন যোগ করে আমরা হিসাব করি সম্ভাব্য বাচ্চা হওয়ার তারিখ, শেষ পিরিয়ডের তারিখ থেকে ২৮০ দিন পর।
একটু জটিল লাগছে? দেখি একটু সমীরকরণের মাধ্যমে সরলীকরণ করতে পারি কি না!
শেষ মাসিকের তারিখ + ১৪ দিন = ওভুলেশনের তারিখ(সম্ভাব্য)
ওভুলেশন তারিখ + ২৬৬ দিন= সম্ভাব্য বাচ্চা হওয়ার তারিখ
সুতরাং, শেষ মাসিকের তারিখ +১৪ দিন +২৬৬ দিন= ২৮০ দিন (সম্ভাব্য বাচ্চা হওয়া তারিখ)
আরেকটু, পরিষ্কার করে দিই। ধরুন, ঐ মেয়ের বিয়ে হয়েছে মাসের ১৪ তারিখে। আমরা জানিনা, সে কবে কনসিভ করেছে? কাজেই বাচ্চা হওয়ার সম্ভাব্য তারিখ হিসাব করতে পারব না। সুতরাং, আমরা যাব রেট্রেস্পেকটিভলি। অর্থাৎ, তার আগের মাসের শেষ পিরিয়ডের প্রথম তারিখ জেনে নিব। ধরুন, সেটা হয়েছিল আগের মাসের ১ তারিখে, অর্থাৎ তার বিয়ের আগে। কিন্তু আমরা হিসাবের সুবিধার্থে ঐ তারিখ থেকেই ২৮০ দিন হিসাব করে তার সম্ভাব্য বাচ্চা হওয়ার তারিখ বের করে নিব।
এখন বৌয়ের শ্বশুরবাড়ীর লোক দেখছে, মেয়ের একে তো বিয়ের পরে পিরিয়ডই হয়নি! আবার ডাক্তার বিয়ের আগের পিরিয়ডের তারিখ হিসাব করে বাচ্চা হওয়ার সম্ভাব্য তারিখ দেয়! তাহলে এ বাচ্চা আমাদের হয় কিভাবে?
এবার বুঝেছেন তো, হয় কিভাবে? বিদেশে ফেরত স্বামীরাও অনেক সময় এভাবে স্ত্রীদের সন্দেহ করে। আসলে সমস্যাটা বৌমাদের নয়। সমস্যার সমাধান পেতে ধাত্রীবিদরাই এরকম একটা উল্টা পথ ধরে হিসাব বের করার বুদ্ধি বের করে রেখেছেন। কাজেই এক হিসাবে বলতে পারেন, সমস্যাটা ধাত্রীবিদদের। এরা বড়ই প্যেঁচুক দেখা যাচ্ছে, কি বলেন! এক তারিখ বের করার জন্য কেমন 'উল্টা চললি রাম' টাইপ হিসাব কষেছে!
যাই হোক, এই যে আজ প্যাঁচ খুলে দিলাম। আশা করি, আপনাদের কাজে লাগবে। অযথা কাউকে সন্দেহ করার আগে, একজন ধাত্রীবিদের সাথে কথা বলে নেবেন। আর এটাও তো এখন বুঝলেন, বিয়ের পরে পিরিয়ড না হলেও বাচ্চা কনসিভ সম্ভব। বরং ঐ বৌমাকে তো মাথায় তুলে নিয়ে নাচা উচিত আপনাদের। সে তো এক বলেই ছক্কা মেরে ম্যাচ জিতিয়ে দিয়েছে!
বৌমা জিন্দাবাদ। নতুন শিশু জিন্দাবাদ। বৌমা একেবারে নতুন অতিথি নিয়ে শ্বশুরালয়ে প্রথম প্রবেশ করবে। সুতরাং, শ্বশুরবাড়ীও জিন্দাবাদ।
লেখকঃ ডা.ফাহমিদা নীলা