15/01/2024
ফেসবুক থেকে তিনটা মানসিক রোগ হওয়ার রিস্ক আছে।
আমাদের বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়া ও ফেসবুক নিয়ে বেশ কয়েকটি গবেষণা হয়েছে।
সমাজ ও মন বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত সোশ্যাল মিডিয়া ও মানুষের মনস্তত্ব নিয়ে অনেক আলোচনা ও তথ্য পর্যালোচনা করছেন।
এই সব গবেষণা থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় জানতে পারলাম।
এখানে শেয়ার করছি।
সঠিক উপায়ে ফেসবুক ব্যবহার না করলে , আসলেই তিনটা মানসিক রোগের রিস্ক আছে।
রোগ তিনটি হলো ,
এক: ডিপ্রেশন
দুই : অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার
তিন : পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার
আজ লিখবো , "ডিপ্রেশন" নিয়ে
"ডিপ্রেশন" একধরণের মানসিক রোগ। প্রতিনিয়ত নেগেটিভ চিন্তা ও গভীর হতাশার কারণে মানুষের শরীর থেকে প্রচুর পরিমান বায়ো এমাইন কমে যায়। যে কারণে মানুষটি ধীরে ধীরে একধরণের ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকেন। এক পর্যায়ে এই গভীর হতাশার কারণে তিনি প্রতি দিনের বেঁচে থাকার আনন্দ হারিয়ে ফেলেন।
এখন বলছি ফেসবুক থেকে কেন ডিপ্রেশন তৈরি হয়।
মন বিজ্ঞানীরা দুইটি কারন বলেছেন,
প্রথম কারন হলো , "সোশ্যাল কারেন্সি" আর দ্বিতীয় কারন হলো , "হাই লাইটস ইফেক্ট"
একটু উদাহরণ দিয়ে সহজ করে বলছি।
মনে করুন , শফিক সাহেব একটা বড় কোম্পানিতে চাকরি করেন , উনার মাসিক বেতন সত্তর হাজার টাকা।
উনার একজন কলিগ একই কোম্পানিতে একটু বড় পোস্টে চাকরি করেন কিন্তু উনার মাসিক বেতন কত এই বিষয়টি শফিক সাহেব জানেন না। তিনি যেহেতু এই বেতনের পরিমানটা জানেন না, এই কারণে সফিক সাহেব উনার কলিগকে কখনো হিংসা করেন না, এমনকি উনার ব্যাপারে খুব বেশি একটা মাথা ঘামান না।
কিন্তু যদি কোন কারণে সফিক সাহেব জানতে পারেন যে উনার কলিগ , কামাল সাহেবের বেতন এক লক্ষ বিশ হাজার টাকা তাহলে সফিক সাহেবের মন খারাপ হবে কারন তিনি প্রথমেই বুঝতে পারবেন যে, তিনি কামাল সাহেবের তুলনায় গরিব। এই গরিব চিন্তাটিই হতাশার মূল কারন। এখন চিন্তা করুন, যদি সফিক সাহেব প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে চিন্তা করেন উনার বেতন কম , সারাদিনও এই কথাই চিন্তা করেন , অফিসে বসে খালি চিন্তা করেন , কার বেতন কত ? জামান সাহেব কত পান ? গত মাসে হারুন সাহেব কত পেয়েছেন ? আমি কত আর উনি কত ?
এই জাতীয় চিন্তা কোন সুস্থ মানুষের জন্য ভালো নয়।
ফেসবুকে এটাই রিস্ক। আপনার বন্ধু ''ক'' ফেসবুকে নিজের একটা ছবি দিয়ে কিছুক্ষন পর পর দেখছে , কত লাইক পড়লো। সকালে ছবি দিয়ে সারাদিন হিসাব করে রাতে নয়টার সময় দেখে তখনও লাইক সংখ্যা মাত্র পনের। অথচ পাশের বাসার ভাবি, কি একটা চিংড়ি মাছের তরকারির ছবি দিয়ে দুইশর মত লাইক নিয়ে গেছে। ছবি দেখেই বুঝা যায় হলুদ বেশি, এরপরও দুইশ লাইক ! মানুষ কি সব পাগল নাকি !
এছাড়া "গ" পেয়েছে সত্তর লাইক , "ঢ" পেয়েছে বারোটা ওয়াও ইমোজি সহ পঁচাশি লাইক !
মানুষের ঢং দেখে বাঁচি না !
আপনার বন্ধু "ক" এই যে হিসাব নিকাশ করছেন, এইটাকে বলা হয় "সোশ্যাল কারেন্সি"
আপনার লাইক সংখ্যার উপর নির্ভর করে সোশ্যাল মিডিয়াতে হিসাব করা হয় আপনি এখানে ধনী নাকি গরিব।
কেউ যদি নিয়মিত মন খারাপ করেন এই ভেবে যে, উনার সোশ্যাল কারেন্সি কম তাহলে উনার মধ্যে এক ধরণের হতাশা তৈরি হবে।
যেদিন আমরা বেশি বেশি লাইক পাই , সেদিন আমাদের বেশি ভালো লাগে। আসে পাশের সবাইকে আপন মনে হয়। নিজেকে বেশ হাসি -খুশি লাগে। কারন হলো ঐ দিন আমাদের মার্কেট ভালো , কারেন্সি বেশি এবং শরীরে ডোপামিনের পরিমান অন্য দিনের তুলনায় বেশি থাকে।
কিন্তু যেদিন ভালো ছবি ও লেখা দেয়ার পরও পরিমান মত লাইক আসেনা , সেদিন মনটা অনেক খারাপ হয় । কারন হলো , ডোপামিন ও অন্য বায়ো এমাইন কম।
ব্রেন থেকে পরিমান মত বায়ো এমাইন রিলিজ না হলে , ডিপ্রেশন হওয়ার রিস্ক থাকে।
পুরো বিষয়টাই একটা নিউরো কেমিক্যাল ব্যাপার।
দ্বিতীয় কারন হলো , "হাই লাইটস ইফেক্ট"
হাই লাইটস কি ?
আমরা যখন নিউজ পেপার পড়ি , তখন সময়ের অভাবে শুধুমাত্র মেইন হেডিং গুলো পড়ে যাই। খবরের ভিতরে বিস্তারিত কি তথ্য আছে সেটি জানার চেষ্টা করিনা । শুধু হেড লাইন দেখে দ্রুত পাতা উল্টে চলে যাই । কোন খবরের গভীরে যাই না।
ফেসবুকেও আমরা তাই করি । অনেক সময় দ্রুত নিউজ ফিড স্ক্রল করে খালি দেখে চলে যাই। মানুষের আবেগ অনুভূতি , শাড়ির রং , ব্যাকগ্রাউন্ডে দেয়ালের কাজ এই সব দেখার সময় পাইনা।
জাস্ট দেখে চলে যাই।
একই রকম ভাবে টিভিতে যখন নিউজ দেখতে বসি , হাই লাইটস শুনার পর অনেক সময় নিউজ বন্ধ করে দেই । কিংবা একটা পুরো খেলা না দেখে শুধু মাত্র খেলার মূল হাই লাইটস দেখে শেষ করে দেই।
এই ব্যবহারের কারণে আমাদের সব কিছুতেই একটা ভুল ও মিথ্যা ধারণা তৈরি হওয়ার রিস্ক থাকে । এবং জীবনকে গভীরে না দেখে সহজ করে দেখার অভ্যাস গড়ে উঠে।
ফেসবুকের হাই লাইটস ইফেক্ট হলো , এই খানে বেশির ভাগ মানুষ তার সুন্দরটুকু প্রকাশ করে।
খুব যত্ন করে ওয়াইফের সাথে , দারুন এঙ্গেলে রোমান্টিক ছবি তুলে ফেসবুকে দেয়। আর খুব দ্রুত এই ছবি দেখে আমাদের মনে হয় , আহা ! মানুষের সঙ্গী কত রোমান্টিক ! কত সুন্দর !
আর আমার কপালে এইটা কি জুটলো ?!
কেউ একজন দার্জিলিং বেড়াতে গিয়ে খুব সুন্দর ছবি দিয়েছেন। সেই ছবি দেখে আমাদের মনে হতে পারে আমার জীবনটাই বৃথা। খালি কাজ আর ঘর-সংসার করে জীবন কাটাচ্ছি। মানুষ কত মজা করে ঘুরছে !
কেমন ম্যাদা মারা এই জীবন !
প্রতিবেশীর বন্ধু সিঙ্গাপুর গিয়েছেন , এয়ারপোর্টে ছবি দিয়েছেন। এই ছবি দেখে হাই লাইটস ইফেক্টের কারণে আফসোস হতে পারে , দেশের বাইরে আর যাওয়া হলোনা। অথচ সেই বন্ধু আসলে লিভার কেন্সারের চিকিৎসার খোঁজ নিতে গিয়েছেন। ভিতরের খবর কি আর সব কিছু জানা যায় ?
সত্যি ব্যাপার হলো , আমাদের সবার জীবন প্রায় একই রকম। এইখানে ভালো মন্দ চরিত্র আছে। আজ আমার বন্ধু "ক" খুব রোমান্টিক কিন্তু আগামী সোমবার আমার সেই বন্ধুই তার বৌকে দেরি করে বাসায় ফেরার জন্য বকা দিবে , খারাপ ব্যবহার করবে। কিন্তু সেইদিনের কোন ভিডিও ফেসবুকে আপলোড হয়না।
দার্জিলিং আপনার বন্ধু জীবনে একবারই বেড়াতে গিয়েছেন। আর কোন দিন যাওয়া হবে কিনা জানা নেই।
এই তথ্য একটা ছবি দেখেই জানা যাবেনা।
এলিসা ফেসবুকে মডেলিং স্টাইলে একটা ছবি দেয়। আর আপনি-আমি "সো বিউটিফুল" বলে কমেন্ট দেই। কিন্তু এলিসার জীবন সম্পর্কে আমাদের অনেক কিছুই জানা নেই। সে যে তার এপার্টমেন্টে উঠতে বসতে তার হাজবেন্ডের সাথে ঝগড়া করে এই বিষয়ে আমাদের কোন ধারণা নেই।
কিন্তু হাই লাইটস ইফেক্টের কারণে এই সব আমাদের মাথায় আসে না। বরং মনে হয় মানুষের জীবন কত মধুর ! কত সুন্দর !
আর আমার জীবন ?
কোন রোমানস্ নেই , এডভেঞ্চার নেই।
একটা হতাশ জীবন !
সুতরাং সঠিক ভাবে না জেনে ফেসবুক ব্যবহার করলে , ডিপ্রেশন হওয়ার রিস্ক আছে।
আমাদেরকে মানুষের জীবন সম্পর্কে জানতে হবে। মানুষের চরিত্র এবং তার চাওয়া -পাওয়া নিয়ে গভীর জ্ঞান থাকতে হবে। এই পৃথিবীতে মানুষের হাসি-কান্না ও সুখ -দুঃখ সব একই রকম।
শুধু হয়তো আমাদের গল্প আলাদা।এখানে কারো সাথে কোন তুলনা করতে নেই। প্রতিটি মানুষের জীবন কাহিনী আলাদা বলেই , এই পৃথিবী এত সুন্দর।
ফেসবুক সুন্দর।
আমার কাছে অনেকটা ডায়েরি লেখার মত। এখানে মানুষের আবেগ -অনুভূতি , সুন্দর মুহূর্ত ও কথা লেখা থাকে। ভালোবাসার ছোঁয়া থাকে। সত্য -মিথ্যা আর বিপ্লবের ভাষা থাকে।
এখানেই আমার বন্ধুর মায়া ভরা মুখের ছবি আছে।
কিন্তু হিংসা আর ঘৃণা তৈরি হবে নাকি ভালোবাসা তৈরি হবে সেটা নির্ভর করে আমাদের জ্ঞান ও জানার উপর।চিন্তা ও জীবন দর্শনের উপর।
সব সময় মনে রাখবেন , ফেসবুকে আপনার জীবন যেন কখনোই বন্দি না থাকে।
ফেসবুক ছাড়াও জীবন অনেক সুন্দর।
"ইনসাইট ওয়ান"
-ডা.শামছুল আলম