29/04/2024
গত কয়েক বছর ধরে একজন রেজিস্টার্ড ডাক্তার হিসাবে প্র্যাকটিস করছি। এসময়ে আমার কাছে রোগি হয়রানির একটা বড় কারণ মনে হয়েছে আমাদের দেশের ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিকগুলোতে চলতে থাকা দালাল ভিত্তিক রোগি ধরার সিস্টেম, যাকে আমরা ক্ষেত্রবিশেষে সুন্দর করে “পিসি (পল্লী চিকিৎসক) সিস্টেম” বলে থাকি। অধিকাংশ মানুষই এই সিস্টেমটা বোঝেন না। তাই একটু ভেঙেই বলছি। এই সিস্টেমের মূলনীতি হল- “রোগি দাও, কমিশন (ত্রাণ) নাও”।
এই সিস্টেমের প্রথম অভিজ্ঞতা হয় ইন্টার্ন থাকাকালীন সময়ে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডিউটি করছি, সার্জারি ওয়ার্ডে প্লেসমেন্ট, মাথায় সামান্য চোট নিয়ে এক রোগি ভর্তি হলেন। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে অবজারভেশনের জন্য রোগিকে ভর্তি রাখা হল। কিছুক্ষণ পর হাসপাতালের এক ওয়ার্ড বয় ডক্টরস’ রুমে ঢুকে বললেন –
“স্যার, রোগীর তো মাথায় চোট লাগসে, রোগীর লোকজন তাইCT scan of Brain করাইতে চায়।”
আমি রোগীর লোকজনকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম যে, মাথায় চোট লাগলেই সবসময় CT scan লাগে না, কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ থাকলেই কেবল CT scan লাগে, আপনার রোগীর সেরকম কোনো সমস্যা নাই, তাই করানোর দরকার নাই।
কিন্তু লাভ হলো না। একজন অভিজ্ঞ ওয়ার্ড বয় এর কাউন্সেলিং এর কাছে একজন নব্য চিকিৎসকের কাউন্সেলিং কোনো পাত্তাই পেল না। অবশেষে রোগীর লোকের অনুরোধে ঢেঁকি গিলতে হলো।
তখনও এর পেছনের রহস্য আমার জানা ছিল না। পরে অভিজ্ঞদের সাথে কথায় কথায় জানতে পারলাম যে, এই রোগিকে নিয়ে গিয়ে CT scan করাতে পারলে শুধুমাত্র সেটার ফি থেকেই প্রায় ২৫-৩০% (প্রায় ৫০০ টাকা) পাবে সেই ওয়ার্ড বয়!!! এই টাকাটা কিন্তু নেওয়া হবে রোগীর থেকেই, যত ডিসকাউন্টই লিখে দেওয়া হোক না কেন। আর এরকমটা শুধু যে CT scan এর ক্ষেত্রেই ঘটে তা না। সকল প্রকার টেস্ট এর ক্ষেত্রেই কমিশন (ত্রাণ) সিস্টেম চলমান। এরপর থেকে প্রয়োজনের ক্ষেত্রে আমি নিজে ডায়াগনস্টিক এর রিপ্রেজেন্টেটিভ এর সাথে কথা বলে ডিসকাউন্ট নিশ্চিত করেই কেবল রোগিকে CT scan/MRI বা অন্যান্য টেস্টের জন্য রোগিকে পাঠানোর ব্যবস্থা করতাম।
এমন আরও বহু ঘটনার অভিজ্ঞতা হয়েছে ইন্টার্নশিপের ১ বছরে।
সকালের রাউন্ডে এপেন্ডিসেকটমির সিদ্ধান্ত হওয়া অস্বচ্ছল রোগিকে অপ।রেশনের আগেই বিকালে উধাও হয়ে যেতে দেখেছি। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে সেই রোগীর অপ।রেশন হয়েছে বাইরের ক্লিনিকে। হাসপাতালে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা ছিল না বলে নয়, কোনো এক দালালের কথায় ব্রেনওয়াশড হয়েই রোগি ক্লিনিকে গিয়েছিলেন। আর এসব অপ।রেশনের বিল থেকে একটা অংশ ত্রাণ হিসাবে যায় দালালের পকেটে।
এবার বলি হাসপাতালের বাইরে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের অভিজ্ঞতা।
একজন সনোলজিস্ট (যিনি আল্ট্রাসনোগ্রাম করে থাকেন) হওয়ার সুবাদে আমি নিজেও এই সিস্টেমের ভিতরে ঢুকে গেছি। সুবিধাভোগি হিসাবে নয়, একজন ভুক্তভোগি হিসাবে। যে পল্লী চিকিৎসক ডায়াগনস্টিকে রোগি পাঠায় টেস্ট করার জন্য তিনি ত্রাণ হিসাবে পেয়ে থাকে বিলের প্রায় ২৫-৪০%। যেমন, ধরুন একটা আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে যদি রোগীর থেকে নেওয়া হয় ৪০০৳, তাহলে ডাক্তার পান ১৫০৳, পিসি পান ১৫০৳, আর বাকিটা ডায়াগনস্টিকের। যদিও এটা কেবল পল্লী চিকিৎসকেরাই নিয়ে থাকেন তা নয়, অনেক বড় বড় বিশেষজ্ঞ ডাক্তারও নিয়ে থাকেন এরকম ত্রাণ। ব্যতিক্রমও আছে, কিন্তু সংখ্যাটা খুব বেশি নয়, তবে দিনদিন বাড়ছে।
এই সিস্টেমের কারণে মানহীন ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিকের খপ্পরে পড়ে একদিকে যেমন রোগী হয়রানি হচ্ছে, অন্যদিকে বাড়ছে চিকিৎসা খরচও। তাই এর বিকল্প সিস্টেম তৈরি করা খুব জরুরি।
তবে এসব সিন্ডিকেট সিস্টেম বন্ধ করা কেবল সরকার বা ডাক্তার বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা পল্লী চিকিৎসক, কারো একার পক্ষে ‘নামুমকিন হে’। বন্ধ করতে গেলেই তৈরি হয় নানা রকম বিশৃঙ্খলা যার তালিকা অনেক লম্বা। তাই সকলের সচেতন হওয়ার কোনো বিকল্প নাই। এতে খুব বেশি কিছু না হলেও অন্তত হয়রানি ও মানহীন টেস্টের পিছনে অপচয় কমবে।
পাশাপাশি প্রয়োজন কমিশনবিহীন রেফারাল সিস্টেম যা উন্নত দেশগুলোর হেলথসিস্টেমের মূল কাঠামো।
©ডাঃ মোঃ শাহরিয়ার আলম, এমবিবিএস
(জেনারেল ফিজিশিয়ান ও সনোলজিস্ট)
Send a message to learn more