30/04/2023
আজকে একটি জনপ্রিয় বিজ্ঞানভিত্তিক গ্রুপে একটি ভয়াবহ ব্যাপার চোখে পড়লো। এক ব্যক্তি গরমের কারনে দুই দিনে ১০ প্যাকেট খাবার স্যালাইন (সঠিক নিয়মেই অর্থাৎ ১ প্যাকেট আধা লিটার পানিতে) খেয়েছে। এখন সে শারিরীক অস্বস্তি বোধ করছে। ব্যাপারটি কেন ভয়াবহ বলছি। প্রথমত খাবার স্যালাইন কোন কোমল পানীয় না যে ভালো লাগলে বা না লাগলেই খেয়ে ফেলবেন। পানিশূন্যতা বিশেষ করে ডায়রিয়া জনিত পানিশূন্যতায় দেহ থেকে বেরিয়ে যাওয়া লবন ও পানির অভাব দ্রুত পূরণ করতে চিকিৎসা হিসেবে এই ওরস্যালাইন এর জন্ম যা বাচিয়েছে লক্ষ কোটি মানুষের প্রাণ। কিন্তু এই প্রাণ রক্ষাকারী স্যালাইন যদি আপনি কারনে অকারনে অপরিমিতভাবে খান তাহলে তা শরীরের উপকার না করে মারাত্নক ক্ষতি করতে পারে। কিভাবে করে বলছি।
একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের জন্য দৈনিক খাবার লবন গ্রহনের সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যকর মাত্রা হলো ৬গ্রাম (২.৪ গ্রাম সোডিয়াম), চামুচের হিসাবে আধা চামুচের কম। এক প্যাকেট ওরস্যালাইনে থাকে ১.৩ গ্রাম সোডিয়াম। কেউ দুই দিনে ১০ প্যাকেট অর্থাৎ দিনে ৬.৫ গ্রাম সোডিয়াম খেলে দৈনিক সর্বোচ্চ মাত্রার প্রায় ৩গুন বেশি হবে। এর বাইরে আমরা যে নিয়মিত খাবার খাই, তাতে প্রচুর পরিমানে লবন থাকে এমনকি নলকূপ বা ডিপ টিউবয়েল থেকে ওঠানো পানিতেও কিছু মাত্রায় লবন থাকে বিশেষ করে উপকুল এলাকায়। ২০১৭ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশের একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ গড়ে দৈনিক ১৭ গ্রাম পর্যন্ত লবন গ্রহন করে যা স্বাস্থ্যকর সর্বোচ্চ মাত্রার তিন গুণ (https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC5678496/ #:~:text=We%20corroborated%20these%20findings%20with,findings%20derived%20from%20spot%20urine. )
এর বাইরেও স্যালাইন, ডাবের পানি, এনার্জি ড্রিংক, সফট ড্রিংক, লবন মাখা আমড়া, আরও নানাবিধ উপায়ে কত পরিমান লবন আমরা খাচ্ছি সেটা নিজেই চিন্তা করুন। দীর্ঘমেয়াদে এই পরিমান লবন কি ক্ষতি করে সেটা পরে বলছি। আগে দেখি কারনে অকারনে স্যালাইন বা অন্য উপায়ে হঠাৎ অতিরিক্ত লবন খেলে কি হতে পারে।
লবনের সাথে অতিরিক্ত সোডিয়াম আমাদের শরীরে ঢুকে রক্তে ও কোষের বাইরে থাকা তরলের ঘনত্ব বাড়িয়ে দেবে। যার কারনে কোষ থেকে পানি বেরিয়ে আসবে, এতে একদিকে কোষের কর্মক্ষমতা কমে যাবে অন্যদিকে কোষ থেকে পানি রক্তে চলে আসায় রক্তচাপ বাড়বে, এমনকি মস্তিষ্কের বিভিন্ন স্থানে পানি জমে খিচুনি, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। এটি একটি ভয়াবহ বিপদজনক অবস্থা। এতো বললাম শুধু সোডিয়ামের কথা। এরচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি করতে পারে পটাশিয়াম। মানবদেহে দৈনিক পটাশিয়াম গ্রহনের সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যকর মাত্রা ৩.৫ গ্রাম। এক প্যাকেট খাবার স্যালাইনে থাকে ০.৭৫ গ্রাম। অর্থাৎ ৪-৫ প্যাকেট স্যালাইন খেলেই সর্বোচ্চ মাত্রা অতিক্রম করবে। ডাবের পানিতে এর চেয়ে বেশি পটাশিয়াম থাকে। আধা লিটার ডাবের পানিতে প্রায় ০.৯ গ্রাম পটাশিয়াম থাকে। কেউ প্রয়োজনের বেশি পটাশিয়াম গ্রহন করলে হাইপারক্যালেমিয়া তৈরি হতে পারে যার ফলাফল কিডনি ফেইলিওর, হার্ট এট্যাক ও মৃত্যু।
সুতরাং গরমে ঘেমে গেলেই বা দুএকবার পাতলা পায়খানা বা বমি হলেই খাবার স্যালাইন বা ডাবের পানি ঘন ঘন খাবেন না। শুধুমাত্র পানিশূন্যতার লক্ষণ দেখা দিলে খেতে পারেন চিকিৎসকের পরামর্শ মত। পানিশূন্যতার লক্ষণ হলো প্রচন্ড পিপাসা পাওয়া, জিহ্বা আংগুল দিয়ে স্পর্শ করলে ভেজা অনুভূতি না পাওয়া, প্রস্রাব ঘন হলুদ বর্ণের এবং অল্প পরিমানে হওয়া, মুখ, ঠোট, চোখ শুকিয়ে যাওয়া, মাথা ঘোরানো, প্রচন্ড শারিরীক দুর্বলতা ইত্যাদি। শুধুমাত্র ঘাম হবার কারনে এ ধরনের লক্ষন ছাড়াই খাবার স্যালাইন খাওয়া উপকারী নয় বরং ক্ষতিকর হতে পারে।
এতক্ষণ তাতক্ষনিক ক্ষতির কথা বললাম। আর দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির প্রথমেই থাকবে উচ্চরক্ত চাপ, সেখান থেকে উচ্চ রক্তচাপ জনিত অন্যান্য শারীরিক জটিলতা যেমন কিডনি ফেইলিও, হার্ট ফেইলিওর, হাইপারটেন্সিভ রেটিনোপ্যাথি (দৃষ্টিশক্তির সমস্যা) এবং স্ট্রোক হতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর প্রায় ৬৮% ই এ ধরনের অসংক্রামক রোগ জনিত কারনে হয় যার মাঝে ২০%ই আবার উচ্চ রক্তচাপ জনিত কারন। সুতরাং আপনার দৈনিক খাদ্যতালিকায় লবনের পরিমান যাচাই করুন। কোন কোন উপায়ে প্রতিদিন মাত্রাতিরিক্ত লবন গ্রহন করছেন তালিকা করুন। ভাত তরকারির সাথে থাকা লবন হঠাৎ করে কমিয়ে ফেলা অনেকের ক্ষেত্রেই সম্ভব নয় কিন্তু অন্যান্য উৎস যেমন বিভিন্ন কোমল পানীয়, নাস্তা, চিপস, লবন মাখানো ফল, সস, ভাজা পোড়া, খাবার স্যালাইন ইত্যাদি উৎস নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব।
গরমে ঘেমে যাওয়া স্বাভাবিক। ঘামলেই স্যালাইন বা হালের জনপ্রিয় ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংক খাওয়ার প্রয়োজন নেই বরং সাধারন খাবার পানি পান করুন। এতেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে শরীর থেকে বেরিয় যাওয়া পানির অভাব পূরন হবে।
কার্টেসী : ডাঃ মারুফুর রহমান অপু।