28/10/2019
রক্তশূন্যতা বা এনিমিয়া কোনো অসুখ নয়। এটি অসুখের পূর্ব লক্ষণ বা উপসর্গ মাত্র। রক্তশূন্যতা মানে রক্ত কমে যাওয়া নয় বরং রক্তের উপাদান লোহিত কণিকায় হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে গেলেই রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। বিশেষ করে গর্ভবতী মায়ের অধিক মৃত্যুহারের অন্যতম কারণ এই ‘রক্তশূন্যতা।
রক্তশূন্যতার উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হলো :
(ক) দেহে আয়রণের অভাবজনিত রক্তশূন্যতা,
(খ) থ্যালাসেমিয়া,
(গ) এপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া,
(ঘ) অন্যান্য হিমোলাইটিক অ্যানিমিয়া,
(ঙ) ব্লাডক্যান্সার বা লিউকোমিয়া
রক্তশূন্যতার কারণ :
বহুবিধ কারণে রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে। এগুলোর মধ্যে প্রধান ৩টি কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো।
ক) অস্থিমজ্জায় লোহিত কণিকা কম তৈরি হওয়া। এর কারণগুলো হলো-
অস্থিমজ্জার স্বল্পতা
লৌহ, ভিটামিন বি১২ অথবা ফলিক এসিডের অভাব (মাসিক, গর্ভধারন, সন্তান প্রসব, দীর্ঘদিন রক্তক্ষরণ);
দীর্ঘস্থায়ী জীবাণু সংক্রমণ, থাইরয়েড গ্রন্থির অসুখ বা লিভারের অসুখ, বিভিন্ন প্রকার ওষুধ সেবন, কীটনাশক ওষুধের ব্যবহার, রঞ্জন রশ্মি বা তেজস্ক্রিয় রশ্মির প্রভাব ইত্যাদি।
খ) অতিরিক্ত পরিমাণে লোহিত কণিকা ভেঙ্গে যাওয়ার কারণগুলো হলো-
জন্মগতভাবে লোহিত কণিকাতে ত্র“টি যেমন: থ্যালাসেমিয়া
গ) অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ এর কারণগুলো হলো-
সাময়িক ও দীর্ঘস্থায়ী রক্তক্ষরণ যেমন আঘাতজনিত কারণ।
পেপটিক আলসার, পাইল্স, বক্র কৃমির সংক্রমণ, ঘন ঘন গর্ভধারণ ও প্রসব, মহিলাদের মাসিকের সময় অধিক রক্তক্ষরণ ইত্যাদি।
রক্তশূন্যতার স্বভাবিক লক্ষণ :
গামান্য পরিমাণ রক্তশূন্যতায় তেমন কোনো উপসর্গ দেখা দেয় না। রক্তশূন্যতা প্রকট হলে নিচের উপসর্গগুলো দেখা দিতে পারে-
-অবসাদ, দুর্বলতা, ক্লান্তি
-বুক ধড়ফড় কর
-স্বল্প পরিশ্রমে শ্বাসকষ্ট
-মাথা ঝিমঝিম করা
-চোখে ঝাপসা লাগা
-মাথা ব্যথা করা
-হাতে পায়ে ঝিনঝিন করা, অবশভাব হওয়া
-হাত, পা, সমস্ত শরীর ফ্যাকাশ হয়ে আসা
এছাড়া লৌহের অভাবজনিত কারণে যেটা আমাদের দেশে বেশি দেখা যায় রক্তশূন্যতা হলে-
-অস্বাভাবিক খাদ্যের প্রতি আসক্তি জমায়
-মুখের কোণায় ঘা হয়
-জিহ্বায় ঘা বা প্রদাহ
-খাদ্য গিলতে অসুবিধা
-নখের ভঙ্গুরতা ও চামচের মতো আকৃতির নখ হয়ে যাওয়া
-থ্যালাসেমিয়াতে চেহারার আকৃতি মঙ্গোলিয় জাতির মতো দেখায় ও চাপা দেখা যায়
রক্তশূন্যতায় করণীয় :
লৌহের অভাবজনিত কারণে রক্তশূন্যতা দেখা দিলে (যেমন খাদ্যে ঘাটতি, বক্রকৃমির সংক্রামক, পেপটিক আলসার এর রক্তক্ষরণ ইত্যাদি) আয়রন ট্যাবলেট খেতে হবে।
ভিটামিন বি১২ বা ফলিক এসিড এর অভাবে উক্ত উপাদানের ঘাটতি পূরণ করতে হবে। যে কোনো কারণেই হোক যদি রক্তশূন্যতা অত্যন্ত প্রকটভাবে দেখা দেয় তবে অল্প সময়ে সাময়িক উন্নতির জন্য রক্ত পরিসঞ্চালন করা জরুরি হয়ে পড়ে এবং এজন্য হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রয়োজন।
প্রেক্ষাপটে গর্ভবতী ও স্তন্যদায়ী মা এবং শিশুদের অধিবাংশই সাধারণ রক্তশূন্যতার শিকার। রক্তশূন্যতা রোধে গর্ভবতী মা, শিশুদের লৌহসমৃদ্ধ খাবার বেশি করে খেতে দিতে হবে।
কালো কচু, ধনেপাতা, কাটা নটে, ডাটা শাক, আমচুর, পাকা তেঁতুল, ছোলা শাক, ফুলকপি, আটা, কালোজাম, চিড়া, শালগম, কলিজা, চিংড়ি এবং শুটকি মাছেও আয়রন রয়েছে। তাই এগুলো মা ও শিশুকে খেতে দিতে হবে।
গর্ভবতী মাকে গর্ভের চতুর্থ মাস থেকে আয়রন ট্যাবলেট কেতে দিতে হবে। শিশুর কৃমি রক্তশূন্যতার অন্যতম কারণ। তাই কৃমি প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
পরিশেষে কেউ কেউ শরীর দুর্বল হলে বা ফ্যাকাশে হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিজেরাই আয়রন সিরাপ বা ট্যাবলেট্ খেয়ে থাকেন। এটা ঠিক নয়, এতে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি যেমন- থ্যালাসেমিয়া। থ্যালাসেমিয়াতে রক্তশূন্যতার হয় ঠিকই কিন্তু আয়রনের অভাব হয় না।
বরং আয়রন জমা হয়ে অসুবিধার সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে রক্তের প্রয়োজন। সর্বোপরি অসুখ হলেই নিজের ইচ্ছামতো কোনো ওষুধ খাওয়া ঠিক হবে না, অসুখের সঠিক কারণ বের করে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা করাতে হবে।
রক্তশুন্যতার কারণে থ্যালেসেমিয়া রোগ হতে পারে :
এটা একটি জন্মগত সমস্যা যা প্রয়োজনমতো হিমোগ্লোবিন সংশ্লেষণ না হওয়ার জন্য হয়। এ রোগের লক্ষণ উল্লেখ করা হলো-
সাধারণত বাচ্চা বয়সেই এ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেয়ে থাকে;
শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়;
রোগী সবসময় বিষন্ন থাকে এবং আশেপাশের লোকদের জ্বালাতন করে;
রক্তশূন্যতার সাধারণ লক্ষণসমূহ প্রকাশ পায় (পূর্বে আলোচিত);
খাওয়ায় অরুচি এবং ঘন ঘন ডায়ারিয়া ও জ্বর হয়;
অনেক সময় পেটে চাকা দেখা দিতে পারে;
যৌনাঙ্গের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়;
মুখের আকৃতি অনেকটা মঙ্গেলিয়ানদের মতো হয়ে যায়;
দেহের আকৃতি স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট হয়;
অনেক সময় জন্ডিস দেখা দিতে পারে;
যৌনকেশরাজি ও বগলের নিচে চুলের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকে;
যকৃত-এ প্লীহা বড় হয়ে যায়।
থ্যালেসেমিয়ার চিকিৎসা :
নিয়মিত রক্ত পরিসঞ্চালন করা।
রোগ সংক্রান্ত প্রতিকার ও প্রতিরোধ করা।
অনেক ক্ষেত্রে প্লীহা অপারেশন করে ফেলে দিতে হয়।
অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করা।
প্রতিকার :
রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ে প্রথা বন্ধ করা।
বাচ্চা গর্ভে থাকাকালীন জেনেটিক পরীক্ষা করে প্রয়োজনমতো গর্ভপাত করা।