
07/07/2025
★★★★★" সোনার হরিণ "★★★★★
--------- ( একাদশ পর্ব)(দেখামাত্র গুলি)----
একেবারে চাকুরি জীবনের গোড়ার দিকের কথা ।
মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার পরে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অফিসার আমাকে মহিলা আউটডোরে রোগী দেখার জন্য মৌখিক নির্দেশনা দিলেন।
এর কারন পরে বুঝতে পেরেছিলাম। পুরুষ ও শিশু আউটডোরে তুলনা মূলক ভীর কম। এই কারনেই হয়তোবা অন্যান্য কলিগ পুরুষ ও শিশু আউটডোরে বসতে শুরু করেছে। মহিলা আউটডোর তখনো খালি পরে আছে।
চা খেয়ে নির্ধারিত রুমে বসে আছি রোগী দেখার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে।
''আচ্ছালামালাইকুম" বলে ঢুকলেন একজন মাঝবয়সী লোক। ছোট ছোট করে কাটা আউটডোরের সিল ছাপ্পর মারা সাদা কাগজের স্লিপ আমার টেবিলে সাজিয়ে রেখে চলে যাচ্ছিলেন।
হাতের ইশারায় ডেকে পরিচয় জানতে চাইলাম।
তিনি বললেন তার নাম রমজান আলি।
তিনি এই হাসপাতালের ' মালি' পদে আছেন। তবে বাগান না থাকায় বড় স্যার তাকে আউটডোরে ডিউটি করতে বলেছেন।
বেশ! বেশ!, জিজ্ঞেস করলাম - ''এখানে রোগী কেমন হয়? ''
রমজান জবাব দিল--" রুগি ম্যালা স্যার, বানের পানির লাহান ঠেকায়া রাখা যায় না। "
রমজান কে বললাম - '' টেবিলে বা ড্রয়ারে কোন প্রেশার মাপার যন্ত্র দেখছিনা যে! ''
রমজান অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল --"কোন স্যারতো চায় না ; পাশের ঘরে আছে, আইন্যা দিমু? "
বললাম - '' আনো। ''
নিতান্ত অনিচ্ছা সত্বেও রমজান পাশের মেডিকেল অফিসারের রুম থেকে প্রেশার মাপার যন্ত্র এনে তাচ্ছিল্যের সাথে আমার টেবিলে রেখে দিলো।
ইতিমধ্যে ফার্মাসিস্ট সাহেব কয়েকটি ওষুধের নাম লেখা একটি ছোট কাগজ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে গেলেন - " এটি হল আজকের সাপ্লাইকৃত ওষুধের তালিকা। "
দেখলাম লেখা আছে -- ১) পি, সি, ( মানে প্যারাসিটামল) - ২০০।
২) হিস্টা (মানে হিস্টাসিন) - ২০০।
৩) এন্টাসিড -- ৩০০।
৪) এফ এস ( ফেরাস সালফেট ; মানে আয়রন ট্যাবলেট) --- ৫০০।
আরো ৩/৪ টি আইটেম, সংখ্যা উল্লেখ পুর্বক লেখা আছে।
আমি বললাম -- " ওষুধের লিস্ট বুঝলাম। তার পাশে এই সংখ্যা লেখা কেন?"
তিনি বুঝিয়ে বললেন - " এগুলি আজকের দিনের জন্য বরাদ্দ। এর বেশি আজ খরচ করা যাবে না।"
আমি বোকার মত জিজ্ঞেস করলাম "কেন?"
তাতে তিনি যা বললেন তার সারমর্ম হল এই যে, স্টোর কিপারের কাছে যা স্টকে আছে তা পর্যাপ্ত নয়।
তিনি জেলা সিভিল সার্জন অফিস থেকে প্রতি তিন মাসের কিস্তিতে মালামাল নিয়ে আসেন।
সেই মালামালের বড় অংশ থাকে ইনডোরে ভর্তি রোগিদের জন্য। কিছু মালামাল জরুরি বিভাগের জন্য। আর সামান্য কিছু আউটডোরের জন্য।
আউটডোরের প্রাপ্য মালামালের সবটাই যদি আউটডোরে একবারে সাপ্লাই দিয়ে দেয়া হয় , তাহলে তা দিয়ে সাকুল্যে পনের দিন চলতে পারে। বাকী আড়াইমাস আউটডোর বন্ধ রাখতে হবে। " সরকারি অফিসতো বন্ধ রাখা যায় না স্যার!"
তাই এটা হল স্থানীয় ব্যবস্থাপনা। যাতে রেশনিং সিস্টেমে প্রতিদিন আউটডোর চালু রাখা যায়!
আমি বললাম - " আচ্ছা বুঝলাম, এখন আজকের যে বরাদ্দ, সেটা যদি আধাঘণ্টার মধ্যে শেষ হয়ে যায় তখন উপায় কি হবে? "
তিনি বললেন - " কোন উপায় নাই স্যার, শেষ হওয়ার পর শেষ। এরপর রোগি আসলে 'ওষুধ নাই ' বলে বিদায় করে দিতে হবে। "
আমি বললাম - " এই যে ওষুধ নাই, রোগিকে এ কথা কে বলবে? ডাক্তার বলবে, নাকি আপনি ফার্মাসিস্ট বলবেন ? "
ফার্মাসিস্ট মহাশয় বললেন -- " স্যার এটাতো ডাক্তার স্যারেরা বলবেন, কারন রোগিরাতো ডাক্তারের কাছে আসবেন। "
ফার্মাসিস্টের কাছে এই নসিহত শুনে মন খারাপ হয়ে গেল। রেডিও টেলিভিশনে এরশাদ স্বয়ং এবং তার মন্ত্রীরা অহরহ বলে যাচ্ছেন যে, নতুন নতুন হাসপাতাল করা হচ্ছে! চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে!পর্যাপ্ত ওষুধ পত্র দেওয়া হচ্ছে! স্বাস্থ্য সেবা জনগের দোরগোড়ায় পৌছে দেওয়া হচ্ছে! ইত্যাদি ইত্যাদি। আর তার বিপরীতে আমরা নিয়োগপ্রাপ্ত ডাক্তারবাবুরা বলবো - "ওষুধ নাই, ওষুধ নাই। "
"আমাদের পিঠের চামড়া থাকবেতো!?"
কিছুক্ষণ পর দুই একজন করে মহিলা রোগী আসতে শুরু করলো।
তাদেরকে পাশের টুলে বসিয়ে, ধীরে সুস্থে জিজ্ঞাসাবাদ করে, টুকটাক পরীক্ষা করে, তাদের নিয়ে আসা ছোট্ট টিকেটে প্রেস্ক্রিপশন লিখে দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম।
কিন্তু দেখা গেল তারা বড়ই অসহিষ্ণু!
টুলে বসিয়ে, সমস্যার কথা জিজ্ঞেস করার আগেই তারা কেউ বলল - " 'আমাশার -' ওষুদ দ্যান, কেউ বলল - ' গ্যাসের ওষুদ দ্যান।
আমি এসব কথায় বিভ্রান্ত না হয়ে তাদেরকে টুলে বসিয়ে কিছু কথাবার্তা জিজ্ঞেস করে প্রেস্ক্রিপশন সহ দুই একটি ওষুধ যেগুলি সাপ্লাই আছে সেগুলি দিয়ে বিদায় করতে লাগলাম।
কিছুক্ষনের মধ্যে মনে হল বাইরে বেশ শোরগোল লেগে গেছে!
মুখ তুলে দেখলাম অসংখ্য মহিলা! কারো কোলে দুধের বাচ্চা, হাতে ধরা আরেক বাচ্চা! পরস্পর ঠেলাঠেলি করতে করতে চিৎকার চেঁচামেচি করে গোটা বারান্দা নরক গুলজার করে ফেলেছে!
মুহুর্তের মধ্যে এত মানুষ কোত্থেকে এলো বুঝতেই পারিনি। রমজান আলি দরজার একটি কপাট বন্ধ করে দিয়ে এক পাল্লা খোলা রেখে, চিৎকার করে শিশুসমেত উশৃংখল নারীদের লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। মনে হচ্ছে মহিলারা দরজা ভেঙে একবারে ঘরের মধ্যে হুরমুড় করে ঢুকে পড়বে!
আমি কিছুটা থতমত খেয়ে গেলেও রোগী দেখতে মনোনিবেশ করলাম।
কিছুক্ষন পরেই রমজান ধাক্কাধাক্কি করতে করতে ভিতরে ঢুকে এসে আমার কানে কানে বলে গেলো-- " স্যার, 'হাত চালান'। "
"হাত চালান! " মানে আমাকে দ্রুত বেগে রোগি দেখতে হবে!?
আমি ছিলাম বরাবর এক বোকা কিসিমের মানুষ।
কিভাবে দ্রুত রোগি দেখতে হয় তখনো তা আমি শিখে উঠতে পারিনি।
এভাবে প্রতিদিন সকাল সাড়ে নয়টা থেকে ডাক্তার হিসাবে রোগি দেখা নয়, যেন এক প্রচন্ড ঘুর্নীঝড়ের মোকাবেলা চলতে লাগলো।
আধাঘণ্টার মধ্যে ওষুধ শেষ হয়ে গেলে আবার নতুন
গজব শুরু হতো -- " ওষুধ নাই ক্যান ? , সরকার ওষুধ ঠিকই দ্যায় , ডাক্তারেরা বেঁইচ্যা খায়!, ওষুধ নাইতো এখানে বইস্যা আছেন ক্যান?
এসব কথাবার্তা ইতিমধ্যে গা সহা হয়ে গেছে।
প্রাণপণ চেষ্টা করছিলাম, যাতে ওষুধ না দিয়েও ভালো প্রেসক্রিপশন দিয়ে বিদায় করা যায়।
তার জবাবে উলটা মুখ ঝামটানি শুনতে হতো --
" ওষুদ যুদিল বাইরে থেইক্যাই কিনা খামু তাইলে হাসপাতালে আপনেগারে কাছে আসমু ক্যা ? "
কখনো কখনো বলতাম - " তখন কোথায় যেতেন? "
তাদের উত্তর হত - " ক্যা, ডাক্তারের কাছে যামু। "
এই ডাক্তার মানে - 'গ্রাম ডাক্তার ', পল্লি চিকিৎসক! '
এই ভাবে কয়দিন চলার পর নিজের মধ্যে একধরনের হীনমন্যতা শুরু হল। নিশ্চয়ই আমি সব কিছু ঠিকমত ম্যানেজ করতে পারছি না। কোথাও হয়তো আমার ত্রুটি আছে। আমার রুমেই সবচেয়ে বেশি গ্যাঞ্জামের উৎপত্তি হচ্ছে । এর মাঝে বড় স্যার একদিন আমার রুমে উঁকি মেরে দেখে গেছেন।
আমার মনে হল, নতুন মেডিকেল অফিসার হিসাবে আমার অদক্ষতা ওনার কানে চলে গেছে!
রমজানের পরামর্শমত আমার 'হাত যথেষ্ট চালু' হয় নাই। এসব চিন্তা করে আমার হীনমন্যতা আরো বেড়ে যেতে লাগলো।
ইতিমধ্যে এক অদ্ভুত জিনিষ খেয়াল করলাম, আমার পাশের রুমের সিনিয়র মেডিকেল অফিসার শমসের ভাইয়ের রুমে কখনোই কোন ভীরভাট্টা নাই, কোন গ্যাঞ্জামও নাই।
এতে আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে, আমার অদক্ষতাই আমার নাকানিচুবানি খাওয়ার অন্যতম কারন।
একদিন আউটডোর শেষে শমসের ভাই চা খেতে ডাকলেন।
চা খেতে খেতে কথাটা পেরেই ফেললাম।
শমসের ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম -- " আমার রুমে সারাক্ষণ ভীর আর গ্যাঞ্জাম লেগে থাকে, অহরহ গঞ্জনা সহ্য করতে হচ্ছে! , আপনার রুমে কোন ভীর নাই, গ্যাঞ্জাম নাই, বসে বসে চা খান আর পেপার পড়েন, রহস্য টা কি? "
শমসের ভাই এক রহস্যময় হাসি দিয়ে বললেন --
" যেদিন রমজান আলি আমার ড্রয়ার থেকে প্রেশার মাপার মেশিন নিয়ে আপনার টেবিলে দিয়েছে, সেদিনই বুঝেছি আপনার রুমে গ্যাঞ্জাম হবে, আপনি বিপদে পড়বেন। "
আমি কিছু বুঝে উঠতে না পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম শমসের ভাইয়ের রহস্যময় হাসির দিকে।
শমসের ভাই আবারো বললেন -- " দাদা, এভাবে হবে না। "
আমি বললাম - " কিভাবে হবে? আমাকে কি করতে হবে? "
তিনি বললেন -"দেখামাত্র গুলি করতে হবে! "
তিনি ব্যাখ্যা করে বললেন - " এখানে ডাক্তারি করার কোন দরকার নাই। রোগি আসা মাত্র যে যা চায় দিয়ে দিবেন। 'জ' উচ্চারণ করার সাথে সাথে বুঝে নিবেন জ্বরের কথা বলছে, সোজা পিসি ( প্যারাসিটামল) লিখে দিয়ে দিবেন। সর্দি কাশি বলার সাথে সাথে হিস্টা (হিস্টাসিন) লিখে দিবেন । যখন অন্য ওষুধ সব শেষ হয়ে যাবে তখন কোন কিছুই আর শোনার দরকার নাই ;যতক্ষন এফএস (আয়রন ট্যাবলেট) অথবা বিসি ( বি কম্পলেক্স ট্যাবলেট) আছে, ততক্ষন তাই দিতে থাকবেন ;এগুলিতো শরীরের কোন ক্ষতি করবে না। আবার রোগিদেরও পাওনা ওষুধ পাওয়া হয়ে গেল!।
যখন সব শেষ হয়ে যাবে তখন দেখবেন, ফার্মাসিস্ট সাহেব একটা কাগজে লিখে দিয়ে যাবে -- " এসব ওষুধ নাই।"
যে সব রোগি পরে এসে হাউকাউ করবে ' ওষুধ নাই কেন? -- তাদেরকে মুখে কিছু বলার দরকার নাই ; ফার্মাসিস্ট এর "কোন ওষুধ নাই "লেখা কাগজটি দেখিয়ে দিবেন! "
এইভাবে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমিও এক সময় " দেখামাত্র গুলি চালানোতে " অভ্যস্ত হতে থাকলাম !!!।।।
(------- চলবে --------)
------ ডাঃ সুকুমার সুর রায়।।
পাদটীকা ঃ
( পঁয়ত্রিশ বছর আগের এই পদ্ধতি " দেখা মাত্র গুলি "
এখনো বহাল তবিয়তে চলমান আছে।
এর সুদূর প্রসারী ফলাফল কি হয়েছে বা হচ্ছে! বাংলাদেশের সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে! বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এ থেকে মুক্ত কিনা? বাংলাদেশের নিম্নবিত্তের মানুষ মেডিকেল ভিসা নিয়ে কেন বন্যার পানির লাহান ভারতে চলে যাচ্ছে!?
এসব বিষয় পর্যায়ক্রমে আলোকপাতের ইচ্ছা রইল।)