23/10/2025
ভারত অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শুধু ক্রিকেটের জন্য হারে না। ক্রিকেটের পাশাপাশি বড় ভূমিকা পালন করে কালচার, ইতিহাস, শিক্ষাব্যবস্থা ও সাইকোলজি। ক্রিকেট থেকে শেখার কিছু নাই, আবার অনেক কিছু আছেও।
শিক্ষাব্যবস্থা নিয়েই বলি। শুধু ক্রিকেট না, আমাদের উপমহাদেশের দেশগুলোর প্রায় সব জায়গায় ব্যর্থতার অন্যতম কারন হল শিক্ষাব্যবস্থা। অস্ট্রেলিয়াসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলোর স্কুলে ব্যক্তিগত মেধাকে কিভাবে টিমওয়ার্কে কাজে লাগানো যায় তা প্র্যাক্টিকালি, হাতে-কলমে শেখানো হয়। কোন অঙ্কনের প্রতিযোগিতায় কেউ যদি তার টিম থেকে বের হয়ে পিকাসোর মতও কিচ্ছু এঁকে ফেলে সেটাকে তারা খুব বেশি এপ্রিশিয়েট করে না। টিমওয়ার্ক তাদের কাছে এতটুকু গুরুত্বপূর্ণ। খুব স্বাভাবিক ব্যাপার মনে হলেও অল্প বয়সে এগুলো শেখার ফলে পুরো জীবনব্যাপী তা প্রয়োগ করা সহজ হয়।
সম্পূর্ণ স্কুল ভবন আগুনে পুড়ে যাচ্ছে এমন পরিস্থিতিতে কী কী করতে হবে, ঠান্ডা মাথায় কিভাবে শৃঙ্খলার সাথে বের হতে হবে, কিভাবে প্যানিক না হয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করবে - এগুলো তাদের ২য় বা ৩য় শ্রেণীর বাচ্চাদের শেখানো হয়। আমাদের কোন ভার্সিটি ভবনে আগুন লাগলেও শুধু পদদলিত হয়ে মারা যাবে কয়েক ডজন ছাত্র। বিপর্যয়ের সময় আতঙ্কিত না হয়ে কিভাবে এগিয়ে যেতে হবে প্রাইমারিতে সেই অর্জিত শিক্ষা প্রাপ্তবয়সে যাওয়ার পর শুধু ক্রিকেট ও ফুটবল নয়, বরং প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা আমাদের চেয়ে ভালভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়।
২০২৩ বিশ্বকাপের ফাইনালের আগে অজি ক্যাপ্টেন প্যাট কামিন্স তার মোবাইল ক্যামেরা দিয়ে পিচের ছবি তোলার দৃশ্যটি খুব আলোচিত হয়েছিল। আমরা সবাই ক্রিকেটীয় ট্যক্টিক্সের অংশ হিসেবেই ভেবেছিলাম, তবে সম্ভবত তার চেয়ে বেশি ছিল মানসিক প্রস্তুতির একটা অংশ। কামিন্স ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি সিডনিতে বিজনেসে ব্যাচেলর করেছেন এলিট এথলেট প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে। তার এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন তার একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইনফরমেশন প্রসেসিং ও বিশ্লেষণে সর্বোচ্চ সাহায্য করেছে। যেখানে আমাদের কোন ছেলের ক্রিকেটে ন্যাচারাল ট্যালেন্ট দেখলে একাডেমিক সংশ্লিষ্টতার আর প্রয়োজনবোধ করি না।
অস্ট্রেলিয়ায় যে পরিমাণ ক্রিকেটার আছে ভারতে অন্তত তার কয়েক হাজারগুণ বেশি আছে। এমনকি বর্তমান ভারত দলের প্রতিটি ক্রিকেটার ব্যক্তিগতভাবে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটারদের থেকে অনেক মেধাবী। তবুও বড় টুর্নামেন্টগুলোতে কেন বারবার তাদের বিপক্ষে হারতে হয় আমরা দেখে আশ্চর্য হই। আমরা আশ্চর্য হই মাত্র ৫০ লক্ষ জনসংখ্যার নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দেড়শ কোটির ভারতের পরপর দুই বিশ্বকাপে পরাজয় দেখে, যেখানে ক্রিকেট তাদের ২য় বা ৩য় জনপ্রিয় খেলা আর অন্যদিকে ভারতে ক্রিকেটকে পূজা করা হয়। আসলে এটা মোটেও আশ্চর্যের বিষয় নয়।
কেন আশ্চর্যের বিষয় নয় তার আরেকটা উদাহরণ দেই। উন্নত দেশগুলোতে ক্রীড়া শুধু বিনোদনের অংশ নয়, এটা তাদের পাঠ্যপুস্তকের অংশ। এটা রুটিন। বিজ্ঞান কিংবা সাহিত্যের ক্লাসের পর স্পোর্টস এর ক্লাস থাকবে। বিজ্ঞানের ক্লাসের মত সেখানেও উপস্থিত থাকতে হবে। গুরুত্বেও কোন কম বা বেশি নাই। স্পোর্টসকে তারা কমিউনিকেশন, লিডারশিপ, টিম ইথিক্স ও রেজিলিয়েন্স গড়ার উপকরণ হিসেবে দেখে। যেখানে আমাদের বেশিরভাগ স্কুলগুলোর ক্যাম্পাসে একটা মাঠও থাকে না। এখানেই শেষ নয়, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ফলাফলের সময় স্পোর্টসের জন্য আলাদা ক্রেডিট যোগ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের লিগগুলো আমাদের পেশাদার লিগগুলো থেকেও বেশি সুসজ্জিত থাকে।
অর্থাৎ আমাদের প্লেয়াররা জাতীয় দলে আসার পর যা শেখে, তারা হাই স্কুল লেভেলেই তা আয়ত্ত করে ফেলে। আমাদের স্পোর্টসের স্কিল কোন ক্ষেত্রে বেশি হতে পারে, তবে তাদের জাতীয় দলে সদ্য সুযোগ পাওয়া প্লেয়ার আমাদের চেয়ে মানসিকভাবে অনেক বেশি সুগঠিত ও পরিপক্ব থাকে। চাপের মুখে বা বিপর্যয়ে কী করতে হবে তা সে খেলা শেখারও অনেক আগে শিখে এসেছে। টিমওয়ার্ক সে প্রাইমারি থেকেই শিখে এসেছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় তার মস্তিষ্কের নিউরনগুলো ছোটবেলা থেকেই ওয়েয়ার্ড-আপ থাকে।
তাই তাদের শিক্ষাব্যবস্থা পরিপূর্ণ দক্ষতাসম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তুলে, স্পোর্টস কিংবা স্পোর্টসের বাইরে।
ডা. সাইফুর রহমান
২৩.১০.২৫