19/11/2024
নর্থ ইষ্ট ক্যান্সার হাস্পাতালের একজন সন্তুষ্ট সেবাগ্রহীতা।
আপনার পাশে থাকতে পেরে আমরা গর্বিত।
আসসালামু আলাইকুম। আমি একজন ডেন্টাল সার্জন, সিলেটে প্রাইভেট প্রাক্টিস করি। আজ আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই আমার মায়ের ক্যান্সার জার্নি নিয়ে কিছু কথা এবং ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ দুজন স্যারের ব্যাপারে।
আল্লাহর রহমতে একজন ডাক্তারের মা হওয়ার কারণে হয়তো আমাদের জন্যে এই কঠিণ জার্নিটা কিছুটা সহজ হয়েছিল। বছর দেড়েক আগে মায়ের ডায়াগোনসিস হয়, "Ca O***y with Peritoneal Carcinomatosis". Histopathology, Immunohistochemistry ইত্যাদি পরীক্ষা-নিরিক্ষার পর স্যাররা জানালেন Ant Abominal Wall, Peritoneum ইত্যাদিতে মেটাস্টাসিস হয়েছে, স্টেজ ৪ ক্যান্সার। মানসিকভাবে আমরা পুরো পরিবার ভেঙ্গে পড়েছিলাম। হসপিটাল-বাসা সাথে ছোট একটি চেম্বার, পাশাপাশি বড় পরিবার, সব মিলিয়ে কেমন যে কেটেছে আমার সময়! আল্লাহ আমাকে তাঁর অনুগ্রহে সাহায্য করেছিলেন।
ফ্যামিলির সবাই চাচ্ছিলেন ইন্ডিয়ায় চিকিৎসা করাতে, আত্মীয় স্বজন সহ অনেকেই এমন সব কথা বলতেন যে সবাই একেকজন ক্যান্সার স্পেশালিষ্ট। আমিও যে একজন ডাক্তার, কিছু ব্যাপারে আমিও জানি! তা অনেকেই ভুলে যেতেন। আমি ইন্ডিয়ার ব্যাপারে শুরুতেই "না" ছিলাম।ইন্ডিয়ায় একটি ক্যান্সার হাসপাতালের MO এর সাথে কনভার্সেশনও হলো, আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড় রইলাম। চিকিৎসা দেশেই করাবো। আল্লাহর সাহায্য এবং দেশের চিকিৎসার প্রতি আস্থা রেখেই আমি একাই লড়েছি সবার বিরুদ্ধে যেয়েও। কথাতো অনেকেই বলে, সাজেশানও অনেকেই দেয়! কিন্ত এতো লম্বা চিকিৎসা জার্নিতো আমাকেই পোহাতে হতো।
যাক, আজ আমি দুজন স্যারের ব্যাপারে লিখবো। অপারেশানের পর ডায়াগোনসিস হলো, এক পর্যায়ে আম্মুকে ম্যানেজ করলাম যে ঢাকায় দেখাবো। যদিও আমার কলেজ "নর্থ ইষ্ট মেডিকেল কলেজে স্বয়ংসম্পূর্ণ ক্যান্সার হাসপাতাল রয়েছে।" তাও আম্মুর মানসিক শান্তির জন্যেই নিয়ে গেলাম। যথারীতি এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে গেলাম, বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হসপিটালে। প্রফেসর ডাঃ কামরুজ্জামান চৌধুরী স্যার। অনেকটা হোপলেস আমি, যখন সিরিয়াল আসলো। আম্মুকে নিয়ে স্যারের রুমে ঢুকলাম। অনেক ডাক্তার দেখানো হয়েছে, সবার কাছে নিজে ডাক্তার এই পরিচয় দিতেও মন চাইতো না। তো জড়সড় হয়ে আমি প্রফেসর স্যারের রুমে ঢুকে দাঁড়িয়ে বললাম, "স্যার, আমি একজন জুনিয়ার ডেন্টাল সার্জন, সিলেট থেকে মাকে নিয়ে এসেছি।" অবাক করে দিয়ে বয়বৃদ্ধ প্রফেসর স্যার দাঁড়িয়ে আমার হাত ধরে বললেন, ডাক্তার সাহেব বসেন। অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে প্রায় ঘন্টাখানেক সময় নিয়ে প্রতিটি রিপোর্ট পেন্সিল দিয়ে দাগিয়ে পড়লেন, ফিল্মগুলো দেখলেন। আমার মাকে এতোবড় প্রফেসর স্যার, "আন্টি বলে সম্বোধন করলেন, অত্যন্ত যত্নের সাথে সাহস দিলেন।" ডাক্তার হিসেবে গর্ব বোধ করলাম।
যখন বের হচ্ছি তখন স্যার একটা রিসিপ্ট দিয়ে বললেন, "ডাক্তার সাহেব, কাইন্ডলি একাউন্টসে এই কাগজটা দেখাবেন। আর কিছু পরীক্ষানিরিক্ষা দিলাম, ম্যাক্সিমাম ডিসকাউন্ট দিয়ে দিয়েছি, তাও আপনি আপনার পরিচয় দিবেন।" মুগ্ধ হয়ে গেলাম, স্যারের ভিজিটটাও ফেরত দিলেন। পরের ভিজিটে স্যার বললেন,"যেহেতু আপনি ডাক্তার, আপনাদের ক্যান্সার হাসপাতালে খুব ভাল মানের কনসালটেন্ট রয়েছেন, আপনার জন্যে ওইখানে চিকিৎসা নেয়া সহজ হবে বলে মন করছি। তাও যেকোন প্রয়োজনে আমাকে স্মরণ করবেন। সেদিন সত্যিই আমি জায়নামাযে কেঁদেছি, শুকরিয়া আদায় করেছি আল্লাহ আমাকে ডাক্তার বানিয়েছেন এর জন্যে এবং স্যারের জন্যে দোয়া করেছি। আমার অনুভূতি লিখে শেষ করার মতো নয়। আল্লাহ স্যারকে দীর্ঘজীবী করুন, দুনিয়া -আখেরাতে সম্মানিত করুন।
লেখার পরিধি কিছুটা বড় হয়ে যাচ্ছে। সিলেটে ক্লিনিকাল অনকোলজিস্ট, আমার কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ রুহুল আমিন ভূঁইয়া স্যারের অধীনে চিকিৎসা নিয়েছি মায়ের জন্যে। যেহেতু আমি ডেন্টাল ইউনিটে পড়েছি, তাই আমার সরাসরি শিক্ষক না হলেও, স্যার আমার কলেজের শিক্ষক। সিরিয়াল নিয়ে গেলাম, স্যারকে বিরক্ত করতে চাইনি কখনো। পরিচয় দেওয়ার পরপর আমাকে আবারো এই স্যার কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ করলেন। এসিসটেন্টকে বললেন, "আজকেই একটা নোটিশ লাগাবা, ডাক্তার সাহেবদের সিরিয়ালের প্রয়োজন নেই।" আমাকে বললেন, "যেকোন সমস্যা আমার সাথে শেয়ার করবা।" চিকিৎসার প্রতিটা স্টেজ সুন্দরভাবে বুঝাতেন প্রতিটা ভিজিটেই। আম্মুকে সাহস দিতেন। রুহুল আমিন স্যারের ব্যবহার এমন, যে ইনার সাথে যেকোন রোগী দেখা হওয়ার পরপর মানসিকভাবে সাহসী হয়ে যাবে। বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখবে নতুন করে।
কেমোথেরাপি যেন কম খরচে নিতে পারি, স্যার কথা বলেবলে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ফার্মেসি কোম্পানির সাথে নিজে কথা বলতেন। এখনো বলেন। আন্তরিকতা এমন যে, তিনি তাঁর মায়ের চিকিৎসা দিচ্ছেন। আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না। আল্লাহ আমাদের রুহুল আমিন স্যারকে আরো অনেক বেশি সম্মানিত করুন। উত্তম জাযা দান করুন। পুরো সিলেট বিভাগে স্যারের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে, তাঁর ব্যবহার এবং আন্তরিকতায় রোগী এবং রোগীর স্বজনরা মুগ্ধ। হাসপাতালের আমার সিনিয়ার /জুনিয়ার মেডিকেল অফিসাররাও অনেক আন্তরিকতার সাথে আমার মায়ের চিকিৎসা দিয়েছেন, আমি তাদের জন্যে দোয়া করি।
আল্লাহর রহমতে আমার আম্মু খুবই ভাল আছেন। ১২ সাইকেল কেমোথেরাপি দেওয়ার পর এখন Pet Scan, CT Scan, Tumour marker আশাব্যঞ্জক। মায়ের কোন উপসর্গ নেই, স্বভাবিক জীবন যাপন করছেন। রুহুল আমিন স্যার বর্তমানে IV Chemo বন্ধ করেছেন, Oral Drug শুরু করেছেন, আমার মা প্রতিনিয়ত দোয়া করে চলেছেন তাঁর চিকিৎসা দানকারী ডাক্তারদের জন্যে।
চিকিৎসা শুরুর পূর্বে আরো ডাক্তার দেখিয়েছিলাম, আশায় বুক বাঁধতে পারিনি। কিন্ত আমাদের মেডিকেল সোসাইটিতে প্রফেসর কামরুজ্জামান স্যার, এসিসটেন্ট প্রফেসর রুহুল আমিন স্যারদের মতো এমন আন্তরিক রত্নতূল্য মানুষ আছেন বলেই হয়তো নিজেকে ডাক্তার ভাবতে গর্ব বোধ করি।
আল্লাহ আপনাদের হায়াতে বারাকা দান করুন, সম্মানিত করুন। এই পোস্ট এর উদ্দেশ্য নয় স্যারদের খুশি করা, কিংবা হয়তো স্যাররা এই পোস্ট দেখবেনও না। কিন্ত এর উদ্ধেশ্য হলো একজন জুনিয়ার ডাক্তার হিসেবে কতখানি সম্মান আমি পেয়েছি, এবং আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর আস্থা রাখলে হয়তো অনেক ভাল কিছু সম্ভব, এটুকু বলা।