15/08/2025
ডাক্তার রোগীর সম্পর্ক হওয়া উচিত ছিল আস্থা, সম্মান আর ভালোবাসার, কিন্তু প্রায় সময়ই এখানে এসে বাসা বাঁধে বিতৃষ্ণা, বিদ্বেষ আর ঘৃণা! এই পেশা নিয়ে মানুষের এক অদ্ভুত দ্বৈত মনোভাব দেখি, যুগপৎ ভাবে ভালোবাসা আর ঘৃণার সম্পর্ক। কিছু ভুল ধারণাও থাকে অনেকের মনেই। তাই, এসব নিয়ে দুটো কথা।
প্রথমত, আমরা ডাক্তার কেন দেখাই? সবসময়ই কি রোগী ভালো করার জন্য দেখাই? রোগ ধরতে না পারলে কি বিফলে মূল্য ফেরত? রোগী রোগ নিয়ে আসেন বটে, কিন্তু রোগ ধরার নিশ্চয়তা দেয়া যায়না কখনোই। কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই সকল সুযোগ সুবিধা সত্ত্বেও রোগ ধরা নাও পড়তে পারে। আবারও অনেক সময় রোগ জানাই থাকে, যেমন প্রেশার, ডায়াবেটিস ইত্যাদি। এক্ষেত্রে রোগী সাধারণ তদারকির জন্যই যেতে পারেন, ফলো আপ যাকে বলা হয়। তাহলে, ডাক্তার প্রেসক্রিপশনে ঔষধ লিখার জন্য টাকা নেননা, রোগ ভালো করার পারিশ্রমিক হিসেবেও নয়। তিনি টাকা নেন তাঁর দেয়া সময়ের জন্য। অনেক সময়ই একটা ঔষধও না লিখে শুধু কথা বলে বা রিপোর্ট দেখে প্রয়োজনে পারিশ্রমিক পেতে পারেন তিনি।
দ্বিতীয়ত, ডাক্তার রোগী দেখে রোগ ধরতে ব্যার্থ হয়ে ইনভেস্টিগেশন করান, এটা খুব অদ্ভুত কথা। রোগ ধরতে তিনটি বিষয় লাগে, রোগীর ইতিহাস, ডাক্তার কতৃক রোগীর শারীরিক পরীক্ষা এবং ইনভেস্টিগেশন। রোগীর সাথে দুই ঘন্টা ভ্যাজর ভ্যাজর করলেও তার ব্লাড গ্লুকোজ বলুন, রক্তের চর্বির পরিমাণ বলুন বা হিমোগ্লোবিন থেকে হরমোন, এসব রক্তের পরীক্ষা ছাড়া কোনভাবেই বোঝা সম্ভব নয়। এটা ডাক্তারের ব্যর্থতা নয়, এটা বাধ্যবাধকতা। ডাক্তার নিজের দরকারে পরীক্ষা দেন না, পরীক্ষা রোগীর প্রয়োজনেই দেয়া হয়।আবার রোগ ধরা ছাড়াও ঔষধের পরিমাণ নির্ধারণ, রোগের জটিলতা দেখা বা ঔষধের সাইড ইফেক্ট দেখার জন্যও প্রচুর পরীক্ষা নিরীক্ষা লাগতে পারে এবং এখন অসংখ্য ডাক্তার আছেন যারা এইসব পরীক্ষা কোন কমিশন গ্রহণ করেন না।
তৃতীয়ত, ডাক্তার তার প্রাথমিক সাক্ষাৎকার এবং রিপোর্ট দেখা, এসব মিলিয়ে কেমন ভিজিট নেবেন এই ব্যাপারে কোন নির্দেশনা নাই, তাই অনেকেই নিজের যুক্তি অনুযায়ী তা নেন। যেমন কেউ হয়তো প্রথম ভিজিট ১২০০ রেখে রিপোর্ট ফ্রী করেন, কেউ আবার ভিজিট ৮০০ রেখে রিপোর্ট ২০০ রাখেন। উভয়ের যুক্তি আছে। অনেকেই ভাবেন, বিনি পয়সায় কিছু পেলে তার মূল্য থাকেনা, অনেকেই ভাবেন, রিপোর্টের সময় যেহেতু বিস্তারিত আলোচনা করতে হয়, তাই তিনি রিপোর্টের জন্য একটা নির্দিষ্ট ফি নিতে চান।
চতুর্থত, আমাদের যেহেতু কোন ভিজিট নির্ধারনী নীতিমালা নাই, সকলে নিজ নিজ ইচ্ছেতে তা নির্ধারণ করেন। এটি অবশ্য সব সার্ভিসের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। একটি নামকরা ডিজাইনার স্টুডিওর একটা সিংগেল ব্লক প্রিন্টের কামিজের দাম আমি দেখেছি পাঁচ ছয় হাজার রাখতে, গুলিস্তানের পাঁচশো টাকার শার্টের মতোই শার্ট পাঁচ হাজারে বেচা হয়, এক কাপ কফি বা একটা বার্গারের দাম হাজার টাকা হয়। এতো দাম নেয়া হয় আসলে ব্র্যান্ড ভ্যালু হিসেবে। তাহলে যে ডাক্তার নিজেকে সেভাবে ব্র্যান্ড হিসেবে দেখেন, তাঁর ভিজিট তিনি অতি উচ্চমূল্যে নির্ধারণ করলে আমি রাগ করতে পারি, তাকে বয়কট করতে পারি, কিন্তু গালি দেয়া বা প্রতিবাদ করার তেমন ভিত্তি নেই। আপনার যা সামর্থ, আপনি সেখানেই যাবেন। যেমন কেউ ব্রেকফাস্ট করে সোনারগাঁওয়ে, কেউ বা হোটেল সালাদিয়াতে!
পঞ্চমত, ডাক্তার কথা বলেন না, সময় দেন না, মেজাজ গরম করেন, এসব অভিযোগ তো আছেই। এসব ক্ষেত্রে কিছু কিছু আছে, আচরণগত, যিনি জন্ম থেকে স্বল্পভাষী বা মেজাজি, তিনি ডাক্তার হোন বা মোক্তার, এরকমই থাকবেন। কিন্তু আপনার তো বেছে নেয়ার অপশন আছে। এখন আমাদের দেশে অগনিত বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, আমি বরং দেখেছি, সময় নিয়ে দেখা ডাক্তারদের ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ কম। অথচ আপনি চাইলেই বেছে নিতে পারেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সে সুযোগ আছে, সুযোগ আছে খারাপ ডাক্তার বয়কট করার।
সবচেয়ে বড়ো কথা, খুব দুঃখজনক হলেও এটা ঠিক যে, আমাদের দেশের একটা বিশাল অংশ মানুষ খারাপ, অসৎ এবং দুর্নীতিবাজ। সুতরাং ডাক্তারদের ভেতরও খারাপ মানুষ থাকতেই পারে, ডাক্তার মানে কোন অবোধ নিষ্পাপ অপাপবিদ্ধ প্রাণী নয়, তাঁরা এই সমাজেরই অংশ। কিন্তু এর পাশাপাশি অসংখ্য মানবিক ডাক্তার এমনকি নিজের পকেট থেকে অর্থ সাহায্য করে, বিনা ভিজিটে বা স্বল্প ভিজিটে, আরও অনেক রকম ভাবে সাহায্য করে রোগী দেখেন। তাই যখন সামগ্রিক ভাবে ডাক্তারদেরকে গালি দেয়া হয়, বাকীরা খুবই আশাহত হন।
এদেশে মানুষ কতোখানে যে বেহুদা টাকা ঢালে! একটা সাইনের জন্য, একটা ফাইল এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে নেয়ার জন্য অবলিলায় লক্ষ( এখন নাকি কোটিতেও হয়) টাকা ঢালেন। নাকের ডগা দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ে, ঔষধ পাতিও কেনেন চড়া দামে, কিন্তু আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতায় জানি, ডাক্তারের ভিজিট দিতে অনেকেরই খুব গায়ে লাগে। এক সিগনেচারে যারা লক্ষ টাকা ঢালেন, তারাই আবার একটা কাগজে কয়টা মাত্র ঔষধ লিখা দেখে হাজার টাকা দিতে মরমে মরে যান। অথচ চিকিৎসা দেয়া সেবা নয় সবসময়, এটা ডাক্তারের পেশাও বটে। জীবনের হাসি আনন্দ, আরাম আয়েশ বাদ দিয়ে রোগী ঘাঁটাঘাঁটি করেন তারা জীবিকার তাগিদেই।
অনেক কিছুই লিখলাম, জানি কিছুই হবেনা, তাও লিখলাম। আমি রোগীদের কষ্টও জানি, বুঝি, এসব শুধু ডাক্তারদের দায় নয়, আমাদের সিস্টেমও বড়োই অদ্ভুত! তবুও নিজে ডাক্তার সমাজের অংশ বলে, খুব গালাগালি শুনি বলেই এতো কথার অবতারণা। ভালো থাকবেন সবাই।
* কারও রোগ না হোক, ডাক্তারের কাছে আসা না লাগুক।অন্য পেশায় না হয় চলে যাবো, যদি দরকার হয়।*
( লেখকের নাম ইচ্ছে করেই উল্লেখ করলাম না।কারণ, আমাদের বক্তব্য একই)