26/05/2025
বাংলাদেশে ডিপ্লোমা ডিগ্রি: শিক্ষার নামে প্রতারণা না কি সম্ভাবনার অপচয়?
📌ভূমিকা
ডিপ্লোমা ডিগ্রি হলো সাধারণত কম সময়ের মধ্যে কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের কোর্স। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে এই ডিগ্রি তরুণদের দ্রুত কর্মজীবনে প্রবেশে সহায়তা করে। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে ডিপ্লোমা ডিগ্রি এক ধরনের শিক্ষাবাণিজ্যে পরিণত হয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে হাজারো শিক্ষার্থী সময়, অর্থ এবং ভবিষ্যৎ—সবকিছু হারাচ্ছে।
বাংলাদেশে প্রচলিত ডিপ্লোমা ডিগ্রিসমূহ:
১. পলিটেকনিক (Diploma in Engineering):
✅চার বছরের কোর্স।
✅ইলেকট্রিক্যাল, মেকানিক্যাল, সিভিল, কম্পিউটার প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষা।
✅অনেক প্রতিষ্ঠান মানহীন, ল্যাব/মেশিন নেই, শিক্ষক অনভিজ্ঞ।
২. আইএইচটি (IHT - Institute of Health Technology):
✅ল্যাব টেকনোলজি, ফিজিওথেরাপি, ডেন্টাল, ফার্মেসি ইত্যাদিতে ডিপ্লোমা।
✅অনেক ছাত্র-ছাত্রী কোর্স শেষ করে বেকার, চাকরির ব্যবস্থা নেই।
৩. ম্যাটস্ (MATS - Medical Assistant Training School):
✅সাড়ে চার বছরের মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট কোর্স।
✅গ্রামীণ পর্যায়ে চিকিৎসা সহকারী হিসেবে কাজের সুযোগ কমে আসছে।
✅সরকারি নিয়োগ সীমিত, বেসরকারি চাহিদা প্রায় শূন্য।
৪. কৃষি ডিপ্লোমা (Diploma in Agriculture):
✅চার বছর মেয়াদী কৃষি শিক্ষাক্রম।
✅সরকারি চাকরিতে সীমিত সুযোগ, মাঠ পর্যায়ে কর্মসংস্থান খুবই কম।
✅প্রযুক্তি ও বাজার ভিত্তিক কৃষি শিক্ষার অভাব রয়েছে।
মূল সমস্যাসমূহ:
১. মানহীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পাঠ্যসূচি:
➡️প্রায় ৮০% বেসরকারি ডিপ্লোমা কলেজ-ইনস্টিটিউটে পর্যাপ্ত ল্যাব, শিক্ষক ও পরিবেশ নেই।
➡️সিলেবাস পুরাতন, বাস্তব চাহিদার সাথে মিল নেই।
২. চাকরির সংকট:
➡️সরকারি নিয়োগ বছরে গুটিকয়েক।
➡️বেসরকারি খাতে কাজের সুযোগ খুব সীমিত, বেতনও নগণ্য।
➡️অধিকাংশ ডিপ্লোমা পাস শিক্ষার্থী বছরের পর বছর বেকার থাকছে।
৩. উচ্চশিক্ষায় বৈষম্য:
➡️অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের ভর্তি নেয় না।
➡️যে কয়টি নেয়, সেখানেও আসন সংখ্যা কম, প্রতিযোগিতা চরম।
৪. প্রাতিষ্ঠানিক ও সরকারি তদারকি নেই:
➡️কোনো রকম নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই চলছে নতুন নতুন ইনস্টিটিউট।
➡️শিক্ষার্থীরা পরে বুঝছে—তাদের সার্টিফিকেটের বাস্তবে কোনো মূল্য নেই।
ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীদের অভিজ্ঞতা:
⏩ “আমি চার বছর ইলেকট্রিক্যাল পলিটেকনিকে পড়েছি। চাকরি পাইনি, কোথাও ইন্টার্ন করতেও দেয় না। এখন দোকানে বসে মোবাইল সারাই করি।”
— এক ডিপ্লোমাধারীর ভাষ্য
⏩“ম্যাটস থেকে পাস করার পর ২ বছর হয়ে গেছে, কোথাও চাকরি পাইনি। বেসরকারি ক্লিনিকে চাই ২ বছরের অভিজ্ঞতা, কিন্তু কোথা থেকে আসবে?”
— ম্যাটস পাস এক তরুণীর অভিযোগ
সম্ভাবনার অপচয়:
বাংলাদেশের তরুণদের মাঝেও দক্ষতা, আগ্রহ ও পরিশ্রম করার মানসিকতা আছে। কিন্তু ভুল পথে ঠেলে দিলে সেই শক্তি ক্ষয়ে যায়। ডিপ্লোমা ডিগ্রির আড়ালে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ ধ্বংস হচ্ছে কেবল:
👉অভিভাবকদের অজ্ঞতার কারণে,
👉ব্যবসায়িক মনোভাবসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কারণে,
👉এবং সরকারি তদারকির অভাবে।
উপায় কী?
১. সচেতনতা বাড়ানো: অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের জানানো দরকার—ডিপ্লোমা মানেই চাকরি নয়।
২. মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনুমোদন দেওয়া: যাচাই ছাড়া নতুন প্রতিষ্ঠান খোলায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া দরকার।
৩. শিল্প/চাকরি সংযোগ নিশ্চিত করা: প্রতি ডিপ্লোমা কোর্সের সাথে সংশ্লিষ্ট খাতের নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
৪. বিকল্প পথ তৈরি করা: যেমন — আইটি, ফ্রিল্যান্সিং, স্মার্ট কৃষি, স্মল বিজনেস মডেল শেখানো।
উপসংহার:
বাংলাদেশে যেভাবে ডিপ্লোমা ডিগ্রির বিস্তার ঘটেছে, তা উন্নয়নের নয়, বরং একটি লুকানো বেকারত্বের ফাঁদ।
অভিভাবকদের এখনই সচেতন হওয়া প্রয়োজন — শুধু সার্টিফিকেট নয়, দরকার বাস্তবমুখী শিক্ষা ও দক্ষতা।
আপনার সন্তানের জীবন নিয়ে গেম খেলবেন না। জেনে-শুনে সিদ্ধান্ত নিন।