02/07/2025
আজ ২ রা জুলাই,
১৮৪৩ সালের এমন দিনে ভোর পাঁচটায় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতির আবিষ্কারক স্যামুয়েল হ্যানিমানের মৃত্যু হয়েছিল।
৮৮ বছর বয়স্ক হ্যানিম্যান বেশ কিছুদিন ধরে শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন।
অনেকেই জানেন না ----
মেলানি নামের এক ফ্রেন্স ভদ্রমহিলা তার নিজের চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে হ্যানিম্যানের কাছে গিয়েছিলেন। তখন হ্যানিম্যানের বয়স ছিল ৮০ বছর। অনেক বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে, অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা সামলিয়ে, হ্যানিম্যান তখন সবে থিতু হয়েছেন, একটুখানি মানসিক শান্তি পেয়েছেন। বিপত্নীক হ্যানিম্যান দুই মেয়ের সাথেই থাকতেন। একটি মেয়ে অবিবাহিত ছিলেন আর একজনের স্বামী মারা গেলে শিশুপুত্র নিয়ে বাবার কাছেই থাকতেন।
ম্যাডাম মিলানি এসেই কিভাবে যেন হ্যানিম্যানকে বশীভূত করেন। তিন প্রস্তাব দিয়েছিলেন হ্যানিমানকে বিবাহ করে তাকে দেখাশোনা করতে চান। মিলানির তখন বয়স ছিল ৩৩ বছর, হ্যানিম্যানের ৮০, বিবাহ হয়েছিল।
ফ্রাঞ্চের রাজধানী প্যারিসে চলুন, সেখানেই আমি আপনাকে যত্ন করে রাখবো, এই কথা বলে মেলানি হ্যানিম্যানকে প্যারিসে নিয়ে যান।
প্যারিসে অবশ্য হ্যানিম্যান রাজকীয় সম্মান পেয়েছিলেন। আট বছর মাত্র তিনি সেখানে বেঁচে ছিলেন, কিন্তু এই ৮ বছরে তিনি অনেক সম্মান পেয়েছিলেন, মানুষের ভালোবাসা পেয়েছিলেন, অনেক রোগী দেখেছিলেন।
কিন্তু মেলানির উদ্দেশ্য ছিল হানিমানকে দিয়ে টাকা কামানো। হ্যানিম্যানের জনপ্রিয়তা দেখে রোগীদের কাছ থেকে প্রচুর টাকা নিতে আরম্ভ করেন মেলানি। তখন এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা উন্নত হয়নি, এ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বাজারে আসেনি, টি বির, টাইফয়েডের ঔষধ আবিষ্কার হয়নি। বলতে গেলে মডার্ন চিকিৎসা বিজ্ঞান একেবারে অন্ধকারে ছিল।
যেহেতু হোমিওপ্যাথি ঔষধ রোগীকে দিতে গেলে বহু ক্ষেত্রে পরীক্ষা নিরীক্ষা লাগে না, রোগ ধরার প্রয়োজন হয় না, অথচ আশাতীত রেজাল্ট, সেইজন্য মানুষ ওই সময় দলে দলে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের কাছেই ভীঁড় করতো। মেলানি এই সুযোগ গ্রহণ করেছিল,হ্যানিম্যানকে দিয়ে টাকা উপার্জনের রাস্তা বের করেছিল।
এই মেলানি যে কত বড় অসভ্য, লোভী, এবং নোংরা মহিলা ছিলেন তার দুই চারটা কথা বলছি ----
প্যারিসে থাকাকালীন হ্যানিম্যানের বহু দিনের পুরানো ডাক্তাররা, বন্ধুরা দেখা করতে আসলে বিভিন্ন অজুহাতে মেলানি তাদের সাথে হানিম্যানের দেখা করাতেন না। এমনকি হানিমানের অত্যন্ত এক পুরানো প্রিয় ছাত্র স্টাফকেও দেখা করতে দেয়নি।
মৃত্যুর সাত দিন আগে কোন এক সোর্স মারফৎ খবর পেয়ে হ্যানিম্যানের যে কন্যা জার্মানীর বাড়িতে হ্যানিম্যানের সাথে থাকতেন তিনি তার শিশুপুত্র নিয়ে দেখা করতে এসেছিলেন, কিন্তু মেলানী তাদেরকে একবারের জন্যও হ্যানিম্যানের সাথে দেখা করতে দেননি। হ্যানিম্যান অসুস্থ অবস্থায় বারবার নিজেও তাদের সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তারা অন্য জায়গায় থেকে প্রত্যহ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মেলানির বাড়ির সামনে বসে থাকতেন, মেলানির নির্দেশে দারোয়ান তাদেরকে বাড়ীতে ঢুকতে দিত না।
হ্যানিম্যানের চিকিৎসার জন্য তখনকার ফ্রাঞ্চের কোনো ভালো হোমিওপ্যাথিক বা এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসককে মেলানিা নিয়োগ করেনি। কারণ মেলানি যখন বুঝেছিলেন হ্যানিম্যান আর বাঁচবে না তখন বিচার টাকা নষ্ট করতে চায়নি, ধরেই নিয়েছিল হাঁস থেকে যখনআর সোনার ডিম পাওয়া যাবে না, হাঁসের পিছনে অযথা মেহনতি করে কোন লাভ নেই
হ্যানিম্যানের মৃত্যুর খবর মেলানি কাউকে জানায়নি। জানাতে চায়ও নি।
৯ দিন ধরে মৃতদেহ বাড়িতে সংরক্ষিত করে রেখেছিল। তখন ছিল বর্ষাকাল, প্রত্যহ বৃষ্টি হতো। মেলানির উদ্দেশ্য ছিল যেদিন খুব বৃষ্টি হবে, রাস্তাঘাটে লোকজন থাকবে না তেমন দিনে হ্যানিম্যানের মৃতদেহটি পাশের সেন্ট মন্টারিও খৃষ্টান কবরস্থানে ফেলে দিয়ে আসবে। তাহলে কেউ কিছু জানতে পারবে না।
তেমন দিন এসেছিল নয় দিন পরে ১১ ই জুলাই। রাত থেকে অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছিল। হ্যানিম্যান মারা গেছে দারোয়ানের কাছেই খবর শুনে ওই বৃষ্টির মধ্যে হ্যানিমানের কন্যা এবং নাতি জোর করে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে। পরবর্তীকালে ওই নাতি বলেছেন --মৃতদেহের কফিন বের করার সময় কফিনের একটি কণা লেগে সিঁড়ির পাশের দেয়ালে রং চটেছিল বলে মেলানি কফিন বাহকদের উপরে বেজয় ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন।
তারপর কোন লোকজন নয়, কোন শোভাযাত্রা নয়, অজস্র বৃষ্টির মধ্যে একটা ভাঙাচোরা ঘোঁড়াযর গাড়িতে তুলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা বিজ্ঞানীর পচা গলা দেহটির কফিন সেন্ট মন্টারিও কবরখানায় ফেলে দিয়ে আসে মেলানি, ঠিক যেমন করে ভাগাড়ে মৃত পশুদেরকে ফেলে দিয়ে আসে মানুষ।
অবশ্য নতুন কোন কবর নয়। ঐসব দেশে কবর কিনতে হয়। মেলানির এই কবরটি কেনা ছিল আগেই। এই কবরের মধ্যে আগেই সে তার বাবাকে সমাহিত করেছিল, তারপরে তার প্রেমিক গহারিওকে সমাহিত করেছিল, দুইটি কফিন ফেলার পরে উপরে যে দুই ফুটের মতন জায়গা খালি ছিল সেখানে হ্যানিমানের কফিনটি ফেলে দেয় মেলানি। প্রত্যক্ষদর্শী হ্যানিম্যানের নাতি জানিয়েছেন লম্বা হানিমানের কফিনটি ঠিকমতো ঢোকেনি, কিছুটা অংশ একদিকে উঁচু হয়ে পড়েছিল।
হ্যানিম্যান তার কবরের উপরে বসানোর জন্য একটি ফলক তৈরি করে মেলানিকে দিয়েছিলেন , ফ্রেঞ্চ ভাষায় লেখা ছিল --Non inutli vixi,
বাংলা অর্থ --আমি বৃথা জীবন ধারণ করি নাই। কিন্তু হ্যানিম্যানের শেষ ইচ্ছা মেলানি রাখেনি, বসানো হয়নি সেই ফলক।
অনেক বছর পরে বিখ্যাত আমেরিকান হোমিওপ্যাথরা প্যারিসে এসে স্থানীয় কর্পোরেশনের সাথে দেখা করে হ্যানিম্যানের কফিনটি ঐ কবর থেকে তুলে অন্য একটি ভালো কবরখানায় নতুনভাবে সুন্দর করে সমাহিত করেছেন।
এরপর অর্গাননের ষষ্ঠ এডিশনের পান্ডুলিপি নিয়ে বিশ্বের হোমিওপ্যাথদের সাথে মেলানির টাকাপয়সা নিয়ে দর কষাকষি তো সবাই জানে। দর কষাকষি করতে করতেই মেলানি মারা যায়, তবু হ্যানিমানের পান্ডুলিপি এই অর্থলোভী মহিলা কাউকে দেন নি। অনেক বছর পরে ১৯২১ সালে অনেক কষ্টে তার পালিতা মেয়ের হাত থেকে তা উদ্ধার করা হয়েছিল ডাঃ বোরিকের প্রচেষ্টায়।
অনেক মহিলা অত্যন্ত ধূর্ত অর্থলোভী, ও নিচুমনের হয়। এরা অতি সহজ সরল দুর্বল চিত্তের পুরুষদেকে প্রভাবিত করে নিজেদের কাজ হাসিল করে। এরা সাধারণত ভীষণ লোভী হয়। মেলানি যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
আমি হাইকোর্টের একজন অত্যন্ত নাম করা এ্যাডভোকেটের কথা জানি। এক সুন্দরী জুনিয়র এ্যাডভোকেট মহিলা প্রেমের অভিনয় করে তার সমস্ত সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়েছিল। চরম মানসিক অশান্তির মধ্যে থাকাকালীন ভদ্রলোক নিজের পুকুরে চান করার সময় ডুবে মারা যান। অনুশোচনার অঙ্গারে পুড়ে দগ্ধ হয়ে এটি আত্মহত্যাই ছিল বলে অনেকের ধারণা।
তথ্য---
১) লাইভ এন্ড লেটার্স অফ হ্যানিম্যান -- ডাঃ হেল,
২) হ্যানিম্যান বায়োগ্রাফি --ব্রাডফোর্ড