18/12/2024
ডায়াবেটিস রোগীর জ্বালানি।(ক্যালোরি)
**********************************
ডাঃ কল্যাণ কুমার পাল
এখানে ডায়াবেটিস বা মধুমেহ রোগ বলতে মূলত বয়স্ক বা adult (type-2) ডায়াবেটিস বোঝানো হচ্ছে। যদিও আজকাল অল্প বয়সেও এই ডায়াবেটিস হচ্ছে। পৃথিবীতে আজ ডায়াবেটিস-র রাজধানী হচ্ছে ভারতবর্ষ।
মোটর গাড়ি চালাতে যেমন জ্বালানি লাগে , আমাদের শরীর এবং তার ক্রিয়া প্রক্রিয়া চালাতেও তেমনি জ্বালানি লাগে। গাড়ির জ্বালানি যেমন আমরা জানি:: পেট্রোল বা ডিজেল বা জ্বালানি গ্যাস বা ইলেকট্রিসিটি ( ব্যাটারী) বা আগামী দিনে হাইড্রোজেন আয়ন। আর মানুষের শরীরে জ্বালানি যোগান(supply) দেয় আমাদের খাদ্য (source)। আমাদের খাদ্য হল::
কার্বোহাইড্রেট
প্রোটিন
ফ্যাট বা চর্বি
ভিটামিনস
Minerals বা বিভিন্ন ধাতু।
এগুলোর মধ্যে জ্বালানি দেয় শুধু মাত্র কার্বোহাইড্রেট..প্রোটিন..ফ্যাট। আর এই জ্বালানিকে বলে ক্যালরি(Calories). বিভিন্ন খাদ্যের বিভিন্ন রকম ক্যালরি::
১ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট দেয়...৪ ক্যালরি।
১ গ্রাম প্রোটিন দেয়...........৪ ক্যালরি।
১ গ্রাম ফ্যাট দেয়...............৯ ক্যালরি।
এইবার অ্যামেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন অনুযায়ী একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের সারাদিনের ক্যালরির প্রয়োজন::(মোটামুটি)
মহিলাদের.....১২০০--১৫০০ ক্যালরি।
পুরুষদের.......১৫০০--১৮০০ ক্যালরি।
তবে বয়স, ওজন, লিঙ্গ, কাজের ধরণ অনুযায়ী ক্যালরির যোগানের কম বেশী তারতম্য হবে। কম ওজনে কম.. বেশী ওজনে বেশী ক্যালরি। মহিলাদের কম .. পুরুষদের বেশী ক্যালরি দরকার। কম বয়সে বেশী ক্যালরি ..বেশী বয়সে কম ক্যালরির চাহিদা। কম শারীরিক খাটুনির কাজে কম ক্যালরি... বেশী গায়ে গতরে খাটুনির কাজে বেশী ক্যালরি দরকার।
একেবারে বসে বসে কাজে(Sedentary life) খুব-ই কম ক্যালরির যোগান দরকার:: হিসেব হোল:: ওজন কে জি-তে( কিলোগ্রাম)×১৫=...
মনে রাখতে হবে মানুষ ঘুমিয়ে থাকলেও জ্বালানির বা ক্যালরির প্রয়োজন হয়, কারণ আমাদের হৃৎপিন্ড চলে , ফুসফুস চলে, শরীরের বিচিত্র ক্রিয়া বিক্রিয়া চলে, মাথা কাজ করে, শরীর গরম রাখতে হয় ইত্যাদি। এইখানেই মোটর গাড়ির সঙ্গে আমাদের পার্থক্য। গাড়ির চাবি বন্ধ করলেই আর জ্বালানির দরকার নেই। আমাদের মানুষের যদি এ রকম চাবি থাকতো কি মজা হোত তাই না!!!!
এবার একটু গভীরে আসি ....শুধু কার্বোহাইড্রেট প্রোটিন ফ্যাটের ক্যালরির হিসাব দিয়েই আমাদের শরীরের রক্তের গ্লুকোজের পরিমাণ ঠিক রাখার হিসাব করা যায় না। আমাদের readymade বা তাড়াতাড়ি রক্তের গ্লুকোজ বাড়ায় কার্বোহাইড্রেট খাদ্য....প্রোটিন ফ্যাট নয়। প্রোটিন ফ্যাট অনেক ঘুর পথে .. অনেক বিক্রিয়ার মাধ্যমে(metabolism) আমাদের রক্তে গ্লুকোজ বাড়ায় অর্থাত অতি ধীরে।(NEOGLUCOGENESIS)
আবার মজা হোল সব ধরণের কার্বোহাইড্রেট খাদ্য সমান দ্রুততায় আমাদের রক্তের গ্লুকোজ বাড়ায় না। Complex কার্বোহাইড্রেট (মানে অনেক আঁশযুক্ত..starch..fibre) খেলে আমাদের অন্ত্র থেকে ধীরে ধীরে গ্লুকোজ রক্তে মেশে আর আমাদের শরীরের প্যাংক্রিয়াসও হাতে সময় পায় ধীরে ধীরে ইনসুলিন নিঃসরণ করে রক্তের গ্লুকোজ কমানোর। (ইনসুলিন আমাদের রক্তের গ্লুকোজ কমায় বলেই আমরা বেঁচে আছি)। সরল কার্বোহাইড্রেট খেলে দ্রুততার সঙ্গে আমাদের রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যাবে... ফলতঃ প্যাংক্রিয়াস আর পেরে উঠবে না অত তাড়াতাড়ি ইনসুলিন বার করতে... ফলতঃ blood sugar বাড়বে।
আর এই জন্যেতেই ডাক্তারিতে এসেছে নতুন শব্দ::
গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (G I). যেই কার্বোহাইড্রেট খেলে যত দ্রুত blood sugar বাড়ে সেই কার্বোহাইড্রেটের তত বেশী G I. G I কে তিনটে শ্রেনীতে ভাগ করা হয়েছে::
কম= ৫৫-র নীচে।
মাঝারি= ৫৬-৭০।
বেশী= ৭১-১০০।
নীচে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হোল G.I-র::
গ্লুকোজ.....১০০।
সুক্রোজ.....৬৫। (চিনি)
ফ্রুকটোজ....১৯--২৫।(সাধারণতঃ মিষ্টি ফলে, আখের রস, মধু ইত্যাদিতে থাকে)
ল্যাকটোজ....৪৬।(দুধে থাকে..Glucose+galactose).
দেখতেই পাচ্ছেন গ্লুকোজের G.I সব চেয়ে বেশী। আবার ফ্রুকটোজের G.I কত কম। তাই অল্পস্বল্প মিষ্টি ফল খেলে blood sugar খুব একটা বাড়ে না। তাছাড়া ফ্রকটোজ metabolism খুব complicated এবং আরেকটা সুবিধে ফ্রকটোজ metabolism-এ ইনসুলিন দরকার হয় না।(insulin independent).
আবার দেখুন:: ল্যাকটোজ-র(দুধে থাকে) G.I...৪৬ অর্থাত কম। অর্থাত অল্প বার দুধ চা খেলে blood sugar খুব বাড়ে না। আরও কারণ আছে।
আমাদের সব কার্বোহাইড্রেট খাদ্যেই বিভিন্ন রকম কম বেশী গ্লাইসেমিক ইনডেক্স আছে। কম G.I মানে ভালো অর্থাত তাড়াতাড়ি রক্তের গ্লুকোজ বাড়াবে না--বাড়লে ধীরে ধীরে বাড়বে... প্যাংক্রিয়াস হাতে সময় পাবে ধীরে ধীরে ইনসুলিন নিঃসরণ বাড়াতে।
আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে.. Glycemic LOAD(G.L) অর্থাত ধরুন আপনি কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স-র খাদ্য বেশী পরিমাণে খেলেন, তবে তো আপনি অনেক পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট (গ্লুকোজ) খেয়ে ফেললেন অর্থাত আপনার G.L বেড়ে গেল.... মানে ভালো না।
****প্রোটিন বা ফ্যাটের কোনও গ্লাইসেমিক ইনডেক্স নেই--একে বারে শূণ্য। তবুও এরা গ্লুকোজ তৈরী করতে পারে বৈকি, করেও ,তবে অনেক ঘুর পথে.. কঠিন বিপাকের (Metabolism)মাধ্যমে। এর-ই নাম NEOGLUCOGENESIS OR GLUCONEOGENESIS.
এবার আসি আসল কথায়:: আগে তো বলেছি কত ক্যালরি খাদ্য আপনার দৈনিক দরকার। এবার বলি কোন্ প্রকার খাদ্য ...কার্বোহাইড্রেট..প্রোটিন..ফ্যাট..কতখানি দরকার আপনার ক্যালরির হিসাবে::
৫০%-র মত বা একটু কম ক্যালরি.. (আঁশযুক্ত) complicated কার্বোহাইড্রেট থেকে।
১৫-২০% -র মত ক্যালরি.. প্রোটিন থেকে।
২৫-৩৫%-র মত ক্যালরি ...ফ্যাট বা চর্বি থেকে তথা তেল থেকে।
অনেকেরই ধারণা কথা ডায়াবেটিস রোগীদের তেল খাওয়া একদম বারণ বা অতি কম। একদম ভুল কথা। পরিমাণ মত তেল খাওয়া অতি প্রয়োজন আমাদের শরীরের অনেক শারীরবৃত্তীয় কাজের জন্য। তাছাড়া Fat soluble বা তেলে দ্রবিভুত ভিটামিনস হোল ADEK অর্থাত ভিটামিন A , ভিটামিন D, ভিটামিন E, ভিটামিন K. অর্থাত এই ভিটামিনস গুলো তেলে দ্রবিভুত না হলে আমাদের শরীরের অন্ত্রনালী( INTESTINE) থেকে শোষিত হয়ে রক্তে মেশে না অর্থাত শরীরের ক্ষতি হবে।
এবার বলি কোন ফ্যাট বা তেল খাওয়া ভালো আর কোনটা খারাপ। এখানে একটু বলে নিই কোলেস্টেরল মাত্রই শরীরের জন্য খারাপ নয়। সমাজে ভালো ছেলেও থাকে , গুন্ডা বদমাইসও থাকে। গুন্ডা বদমাইসকে এড়িয়ে চললেই হোল। সেরকমই ভালো কোলেস্টেরল আছে:: কোলেস্টেরল-র প্রকারভেদ::
HDL( high density lipoprotein): এই কোলেস্টেরল বেশী থাকা ভালো। ভালো ছেলে। হার্ট অ্যাটাক থেকে নিরাপত্তা দেয়।
LDL(Low density lipoprotein) .এ খারাপ কোলেস্টেরল। বদ ছেলে। বেশী থাকা খুব খারাপ। হার্টের জন্য ক্ষতিকর।
VLDL(Very low density lipoprotein). বেশী থাকা খুব খারাপ।
Triglycerides....বেশি থাকা খুব খারাপ।
এইবার চর্বি বা তেলের প্রকারভেদ::
১) Saturated fat...সামগ্রিক তেল বরাদ্দের ৭%-র বেশী খাওয়া উচিত নয়। যেমন, খাসির মাংস গরুর মাংস শুয়োরের মাংস ইত্যাদি। ক্ষতিকর। ।
২) Monounsaturated fat...খুব ভালো তেল। যেমন Olive oil. এতে থাকে প্রচুর Omega-3, Omega-6 fatty acid... এরা HDL বাড়িয়ে দেয়। হার্টের নিরাপত্তা দেয়। BEST কিন্তু দামি।
৩) Polyunsaturaed fat ...ভালো। Omega-3, Omega-6 fatty acid অনেক থাকে। HDL বাড়িয়ে দেয়। হার্টের জন্য ভালো। সানফ্লাওয়ার বা ঐ জাতীয় তেল। সর্ষের তেলও ভালো-Omega-9 fatty acidও বাড়ায়। সামুদ্রিক মাছের তেলে অনেক থাকে।
৪) Trans fat... বাজে। জমাট বাঁধা তেল। যত কম খাওয়া যায়। যত রকম ফাস্টফুড আছে, বার্গার ইত্যাদি।
শেষের দিকে এসেছি। আমরা যেমন দুর্দিনের জন্য সঞ্চয় করে রাখি, শরীরও দুর্দিনের জন্য সঞ্চয় করে রাখে গ্লাইকোজেন ( Complicated কার্বোহাইড্রেট) ----
লিভারে......মাংস পেশীতে। অনাহারে গ্লাইকোজেন ভেঙে গ্লুকোজ হয়... আমাদের বাঁচিয়ে রাখে।
শেষ পাতে ... ডায়াবেটিস রোগীরা বড় দুঃখী। চোখের সামনে সব খাওয়া ..লোভনীয় অথচ খেতে পারছে না। আমি নিজেও ডায়াবেটিস রুগী। আমাদের কথা ভাবুন। আমাদেরও জিভে( এবং মুখ গহ্বরেও কিছু) taste bud(স্বাদ গ্রন্থি) আছে , হাইপোথ্যালামাসে SATIETY CENTRE তথা তৃপ্তি কেন্দ্র আছে....... তারা স্বাদ আস্বাদন করতে চায়, খাওয়ার তৃপ্তি পেতে চায়। মাপুন আপনারা ক্যালরি, হিসাব করুন গ্লাইসেমিক ইনডেক্স,...ক্ষতি নেই। হিসাব কড়ায় গন্ডায় থাকুক, তবু রসনা যেন তৃপ্ত হয়। মেনু যেন মানবিক হয়।
WE WANT JUST JUSTICE.
( কার্বোহাইড্রেট প্রোটিন... খাদ্যের উপাদান টাইপ নিয়ে আলাদা কিছু বললাম না)