11/09/2025
কলকাতা পুলিশের উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি।
প্রিয় Kolkata Police,
মনে হচ্ছে আপনারা যেন নোটিশ আর সমন ছাপানোর নতুন ব্যবসা খুলেছেন। গত এক মাসের বৌবাজার আর হেয়ার স্ট্রিট থানা থেকে সব মিলিয়ে পাঠিয়েছেন ৫৮টিরও বেশি সমন। প্রাপক? ১৮ জনেরও বেশি মানুষ - জুনিয়র ডাক্তার, সিনিয়র ডাক্তার, মেডিক্যাল পড়ুয়া, এমনকি তাঁদের পরিবারও বাদ যায়নি। কেউ ৭টা, কেউ ৮টা, কেউ বা ৯টা নোটিশ পেয়েছেন জিজ্ঞাসাবাদ এর জন্য থানায় হাজিরা দেওয়ার জন্যে! সবই এক বছরের পুরোনো মামলায়, অভয়ার ন্যায়বিচারের দাবির জন্য রাস্তায় নামার ' অপরাধে ', শান্তিপূর্ণ মিছিল, সমাবেশ, অনশন, জমায়েত এ অংশগ্রহণের 'অপরাধে'!
আমরা প্রশ্ন করতে চাইছি, এ কীসের তদন্ত? এ কীসের ন্যায়বিচার? নাকি প্রতিশোধই এখন আপনাদের কর্তব্যের একমাত্র সংজ্ঞা?
আমরা জানি আপনাদের ব্যস্ততা কম নয়। গত এক বছরে আপনাদের ওপর ধকলও কম যায়নি—কখনও ডাক্তার প্রশ্ন করছে, কখনও শিক্ষক প্রশ্ন করছে, কখনও সন্তানহারা মা-বাবা প্রশ্ন করছে। এই সমস্ত প্রশ্নের তীর যখনই শাসকের দিকে বাঁক নিয়েছে, তখনই আপনারা তা লুফে নিয়েছেন সুপ্রশিক্ষিত অনুগতের মতো। কখনো চাকরিহারা যোগ্য শিক্ষকদের কোমরে লাথি মারা হোক বা মৃতা মেয়ের বিচার চাওয়া মা এর মাথায় লাঠির আঘাত - কাজের খতিয়ান দীর্ঘ। এর মধ্যেই আবার কখনো শাসকদলের নেতার কাছে ফোনে চরম অসাংবিধানিক ভাষায় গালাগাল খেয়েও নিজের পরিবারের লাঞ্ছনা মুখবুজে সহ্য করে হয়তো তারই পদসেবা করতে হয়েছে। কিন্তু এই অতিরিক্ত খাটনির ফাঁকেও এত নিষ্ঠা নিয়ে ডাক্তার-ছাত্রছাত্রীদের হাতে সমন ধরিয়ে দিতে ভুল করেননি। নিজেদের সহকর্মীর খুন-ধর্ষণের বিচার চেয়ে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য আজ আপনাদের প্রতিহিংসার কবলে প্রতিবাদী চিকিৎসক সমাজ!
আমাদের ন্যায়-নীতি, আন্দোলনের অধিকার, এক্তিয়ার ইত্যাদি নিয়ে আপনাদের বহু বক্তব্য আমরা শুনেছি। কিন্তু আমরা বলবোনা আপনাদের কর্তব্য কী, আমরা শুধু একবার মনে করিয়ে দিতে চাই অভয়ার ধর্ষণ ও খুনের পর থেকে আপনারা নিজেদের হাতে তুলে নেওয়া দায়িত্বগুলির কথা। আপনারা নিজেরা পর্যালোচনা করে দেখুন সেগুলির প্রতি কিরকম সুবিচার করতে পেরেছেন।
১) অভয়ার মৃত্যুর দায়ে যাকে এখন একক আসামি বানানোর চেষ্টা করছেন, সেই সঞ্জয় রায় ছিলেন আপনাদেরই কর্মী। আপনাদের দায়িত্ববোধ সেই বিষয়ে কোথায়?
২) আপনারাই তাড়াহুড়ো করে অভয়ার দেহ দাহ করলেন, প্রমাণ লোপাট করলেন, এমনকি তার বাবা-মাকে ঘুষ দিয়ে চুপ করাতে চাইলেন। কোন রহস্য ঢাকতে চেয়েছিলেন? কার স্বার্থ রক্ষা করেছিলেন?
৩) ১৪ই আগস্ট ২০২৪, গভীর রাতে, আর.জি. কর-এর ইমার্জেন্সি ভাঙল, চেস্ট সেমিনার রুম ভাঙার চেষ্টা হল। কারা খোলাখুলি ধর্ষণ আর খুনের হুমকি দিল ডাক্তার-নার্সদের? কারা হোস্টেলে আগুন ধরানোর চেষ্টা করল? তারা কারা? কাদের নির্দেশ আর বরাভয় তাদের এই ক্ষমতা দিল? সেই তদন্তের অগ্রগতি কোথায়?
৪) আর দুর্নীতির তদন্ত? সরকারি হাসপাতালগুলির কোটি কোটি টাকার হিসাব বহির্ভূত খরচ, সন্দীপ ঘোষ ও তার চক্রের দুর্নীতি নিয়ে কী করলেন আপনারা? হাসপাতালের ভেতর জাল ওষুধের ব্যবসা চলছে—তার তদন্তে একটুও অগ্রগতি আছে? নাকি এসব চোখে পড়ে না, কেবল প্রতিবাদী ডাক্তাররাই আপনাদের টার্গেট?
এক বছর কেটে গেছে অথচ সরকারি হাসপাতাল ভাঙচুরের তদন্তে আপনারা শূন্য, দুর্নীতির তদন্তেও আপনারা তথৈবচ। কিন্তু ডাক্তার- মেডিকেল ছাত্রছাত্রীদের ডেকে নিয়ে অপ্রাসঙ্গিক, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রশ্ন করেন, ঘন্টার পর ঘন্টা বসিয়ে রাখেন, আর নোটিশে চাপিয়ে দেন আজব আজব ন্যায়সংহিতার ধারা, জামিন-অযোগ্য ধারাও বাদ যায় না। একে আর যাই বলা যাক, ন্যায়রক্ষকের ভূমিকা অন্তত বলা যায় না! এগুলো স্পষ্টতই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
একথা নিশ্চয়ই আপনাদের অজানা নয় যে চিকিৎসকদের হাসপাতাল থেকে বার বার ডাকার অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হল রোগীর চিকিৎসায় ব্যাঘাত। মালদা, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, তমলুক, দার্জিলিং এর মত প্রান্তিক জায়গায় হোক বা কলকাতার বিভিন্ন হাসপাতালে যারা কর্মরত, হঠাৎ করে সমন পাঠিয়ে তাদের বারবার ডেকে এনে হাসপাতালে বিপর্যয় কিন্তু তৈরি করছেন আপনারাই। এভাবেই কি আপনারা মানুষের সেবা করেন, নাকি সাধারণ মানুষকে বিপর্যস্ত করাই আপনাদের উদ্দেশ্য?
আমাদের আন্দোলনের প্রতিটি কর্মসূচি হয়েছিল প্রকাশ্যে, হাজার হাজার মানুষের চোখের সামনে, মিডিয়ার সদাব্যস্ত ক্যামেরার দৌলতে সমগ্র বাংলার মানুষের সামনে। এই নাগরিক আন্দোলন সংবিধানের অধিকার মেনেই হয়েছিল কারণ গনতান্ত্রিক দেশে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ অপরাধ নয়, বরং নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার। আইনি মারপ্যাঁচ নিঃসন্দেহে আপনারা দারুণ (অপ) ব্যবহার করতে পারেন কিন্তু তার পরেও আপনাদের প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করছি যে আপনারা প্রমাণ করুন সহকর্মীর নারকীয় খুন ধর্ষণ এর বিচার চেয়ে রাস্তায় নামা টা আইনবিরুদ্ধ, নইলে জনগণের সামনে স্বীকার করুন আপনাদের নির্লজ্জতা।
মাননীয় কলকাতা পুলিশ, আপনারা কিন্তু সম্মান হারাচ্ছেন। আদালতে গিয়ে বারবার মুখ পুড়ছে, সংবিধান আপনাদের চপেটাঘাত করছে, তবুও লজ্জা নেই। আমাদের ধৈর্যকে দুর্বলতা ভেবে ভুল করবেন না। দরকার হলে আমরাই আইনের পথে আপনাদের আসল চেহারা দেশের সামনে মেলে ধরব।
অভয়ার চোখের রক্ত এই প্রজন্ম দেখেছে। এ প্রজন্ম জানে ভয় দেখিয়ে আন্দোলনকে স্তব্ধ করা যায় না। তাই আমাদের বিনীত সতর্কবার্তা যে কণ্ঠরোধের এই খেলায় আপনারা কিন্তু শেষ অবধি জিততে পারবেন না।