07/05/2025
"পবিত্র বর্ষাবাস কাল"
লিখেছেনঃ ৰিনয়াচার ভিক্ষু
বর্ষাবাস ঘনিয়ে আসলো। আর মাত্র পাঁচটি বাকি। ভাবছি, এই বর্ষাবাস নিয়ে কিছু লেখা যেতে পারে। কেন এই বর্ষাবাস, কোথা থেকে এর উৎপত্তি, ভিক্ষুদের জীবনে এর গুরুত্বই বা কতটুকু, এসব নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত, অথচ মননস্পর্শী আলোচনা করতে চাই।
১. বর্ষাবাসের উৎপত্তি:
সেই সময় ভগবান বুদ্ধ রাজগৃহে, বেণুবনে কলন্দকনিবাপে অবস্থান করছিলেন। তখনো তিনি ভিক্ষুদের জন্য বর্ষাবাসের কোনো নির্দিষ্ট বিধান দেননি। ফলে ভিক্ষুরা হেমন্ত, গ্রীষ্ম ও বর্ষা, এই তিন ঋতুতেই রাস্তাঘাটে চলাফেরা করছিলেন। অর্থাৎ অনবরত যাত্রা করতেন।
তাদের এই বিচরণ দেখে জনসাধারণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তারা সমালোচনা করতে লাগল এবং প্রকাশ্যে বলতে শুরু করল, “কেন শাক্যপুত্রীয় শ্রমণেরা হেমন্ত, গ্রীষ্ম ও বর্ষায় কর্দমাক্ত পথ দিয়ে চলাফেরা করে, উদ্ভিদ মাড়িয়ে একস্থান থেকে অন্যস্থানে যান? এই আচরণ তো অনুচিত।”
এই জনমতের সংবাদ যখন ভগবান বুদ্ধের শ্রবণে পৌঁছায়, তখন তিনি এ বিষয়ে বিবেচনা করে বর্ষাকালের জন্য একটি অনুশাসন প্রবর্তন করেন। তিনি ভিক্ষুদেরকে বর্ষার তিন মাস (আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত) এক নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করার অনুমতি দেন এবং সেই সময় ভ্রমণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ প্রদান করেন। এইভাবেই বর্ষাবাসের সূচনা হয়, এবং সেই থেকে আজও ভিক্ষুসংঘ এই প্রথা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে আসছে। (ম.ব.১৮৪)
২. বর্ষাবাসের সময় নির্ধারণ:
ভিক্ষুদেরকে বর্ষাবাস পালন করতে হয় দুটি নিয়মের মধ্যে যেকোনো একটির অনুসরণে। এই দুটি সময়কে বলা হয়, প্রথম বর্ষাবাস ও দ্বিতীয় বর্ষাবাস।
১) প্রথম বর্ষাবাস শুরু হয় আষাঢ় (অসাল্হি) মাসের পূর্ণিমার পরদিন থেকে। এটি সাধারণত জুলাই মাসে পড়ে।
২) দ্বিতীয় বর্ষাবাস শুরু হয় পরবর্তী পূর্ণিমার পরদিন থেকে, অর্থাৎ প্রথম পূর্ণিমার এক মাস পর।
বর্তমানে বেশিরভাগ ভিক্ষু প্রথম মেয়াদের বর্ষাবাসই পালন করেন, অর্থাৎ আষাঢ়/জুলাই মাসের প্রথম পূর্ণিমার পরদিন থেকে। তবে যদি ঐ মাসে দুটি পূর্ণিমা পড়ে, তাহলে দ্বিতীয় পূর্ণিমার পরদিন থেকে বর্ষাবাস শুরু করার সুযোগও থাকে। (ম.ব.১৮৪)
৩. বর্ষাবাসের সময়:
ভিক্ষুরা বর্ষাবাস আরম্ভ করেন দু'টি সময়ের যেকোনো একটিতে।
১) প্রথমত, শ্রাবণ মাসের কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদে,
২) দ্বিতীয়ত, ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদে। (ম.ব.১৮৪)
৪. বর্ষাবাসে চলাফেরা:
ভিক্ষুরা বর্ষাবাসের সময় বিনা প্রয়োজনে চলাফেরা করতে পারেন না। এক স্থানেই অবস্থান করতে হয়।
১) প্রথম ধাপ: শ্রাবণ, ভাদ্র ও আশ্বিন,
২) শেষ ধাপ: ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্তিক।
যদি কেউ অকারণে বর্ষাবাসের সময় এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করেন, তাহলে তার দুক্কট অপরাধ হবে। (ম.ব.১৮৫)
৫. বর্ষাবাসের অনুমোদিত স্থান:
ভিক্ষুরা অতিরিক্ত ৩টি জায়গায় বর্ষাবাস আরম্ভ করতে পারে।
১) রাখালের ছাউনিতে,
২) যাত্রীদলের শকটে (গাড়ী/যানে),
৩) নৌকায়। (ম.ব.২০৩)
৬. নিষিদ্ধ স্থানসমূহ:
ভিক্ষুরা অতিরিক্ত ৭টি জায়গায় বর্ষাবাস আরম্ভ করতে পারে না।
১) গাছের গর্তে (কোটরে),
২) গাছের ডালের ফাঁকে,
৩) সম্পূর্ণ খোলা জায়গায়,
৪) অনাবাস (যেখানে বসবাসের কোনো উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই),
৫) শবাগারে,
৬) কেবল সামিয়ানার নিচে,
৭) বড় কোনো গুদামে (মজুদাগার)।
এই স্থানগুলোর কোনো একটিতে যদি কেউ বর্ষাবাস শুরু করেন, তবে তার জন্য দুক্কট অপরাধ হবে। ম.ব.২০৪)
৭. সংবাদ পেয়ে সাতদিনের জন্য যাত্রা অনুমোদন:
ভিক্ষুরা সাত জনের মধ্যে যে কেউ সংবাদ প্রেরণ করলে সাতদিনের জন্য যেতে পারে। এবং সাতদিনের মধ্যে ফিরে আসতে হবে।
১) ভিক্ষু,
২) ভিক্ষুণী,
৩) শিক্ষামানা,
৪) শ্রামণ,
৫) শ্রামণী,
৬) উপাসক,
৭) উপাসিকা।
এই সাত শ্রেণির লোকজন ভিক্ষুর কাছ থেকে কোনো সাহায্য চায়, সেক্ষেত্রে তারা যদি ভিক্ষুকে যেতে বলে, তখন ভিক্ষু যেতে পারে, কিন্তু যেতে না বললে যেতে পারে না। যদি কাজটি সেই ব্যক্তির পুণ্য করার আকাঙ্ক্ষা, ধর্মশ্রবণের আকাঙ্ক্ষা অথবা ভিক্ষুকে দেখার আকাঙ্ক্ষা-সংশ্লিষ্ট হয়, সেক্ষেত্রে ভিক্ষু যেতে পারে। এখানে যদি ভিক্ষুর ভ্রাতা, ভগ্নী জ্ঞাতি, ভৃতিক (এক বিহারে ভিক্ষুগণের সাথে বাসকারী লোক) পীড়িত হয়ে সংবাদ প্রেরণ করে তাহলে যেতে পারে। কিন্তু সংবাদ প্রেরণ না করলে যেতে পারে না। (ম.ব.১৮৭)
৮. সংবাদ ছাড়াও সাতদিনের গমন অনুমোদন:
ভিক্ষুরা সাত জনের মধ্যে যে কেউ সংবাদ প্রেরণ না করলেও সাতদিনের জন্য যেতে পারে। এবং সাতদিনের মধ্যে ফিরে আসতে হবে।
১) ভিক্ষু,
২) ভিক্ষুণী,
৩) শিক্ষামানা,
৪) শ্রামণ,
৫) শ্রামণী,
৬) মাতা,
৭) পিতা।
এক্ষেত্রে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে সংবাদ ছাড়াও, তবে সাতদিনের মধ্যে ফিরে আসতে হবে। (ম.ব.১৯৩-১৯৮)
৯. কোনো অপরাধ ছাড়াই বর্ষাবাস ত্যাগের অনুমতি:
বর্ষাবাস ভঙ্গ করতে হলে সাধারণত দোষ হয়, তবে নিচের পরিস্থিতিতে তা অপরাধ হয় না-
১) পশু দ্বারা আক্রান্ত হওয়া,
২) সাপ, বিছে ইত্যাদির কামড় বা ভয়,
৩) ডাকাত, চোর দ্বারা লুট/আক্রমণ,
৪) প্রেত বা অদৃশ্য অপশক্তির ভয়,
৫) বসবাসকারী গ্রাম আগুনে পুড়ে যাওয়া বা বন্যায় ভেসে যাওয়া,
৬) শয্যা-আসন পুড়ে যাওয়া বা জলমগ্ন হওয়া,
৭) পিণ্ডচারণের কষ্ট বা খাদ্যাভাবে অসুবিধা হওয়া,
৮) আশ্রয়স্থলের বড় ক্ষতি হওয়া,
৯) গ্রামে চোর-ডাকাতের উপদ্রব বেড়ে যাওয়া।
এইসব ক্ষেত্রে নিরাপদ, ভক্তিসম্পন্ন এলাকায় স্থানান্তর অনুমোদিত। (ম.ব.২০০)
১০. খাদ্য, ওষুধ বা সেবকের অভাবে স্থানান্তর:
যদি কোনো ভিক্ষু যথারুচি আহার, ভৈষজ্য বা সেবক না পান, তাহলে ‘এটি অন্তরায়’ মনে করে তিনি স্থান ত্যাগ করতে পারেন। অর্থাৎ,
১) যথোপযুক্ত আহার নেই, আহার থাকলেও তা অনুকূল নয়,
২) ভৈষজ্য নেই,
৩) সেবক নেই,
৪) এই যেকোনো অসুবিধা হলে স্থানান্তরে দোষ হয় না। (ম.ব.২০১)
১১. প্রলোভনের ডাকেও ভিক্ষু বর্ষাবাস ত্যাগ করতে পারেন:
যদি কোনো ব্যক্তি প্রলোভন দেখিয়ে, যেমন—
“হীরক, স্বর্ণ, জমি, গাভী, দাস, দাসী, কন্যা” ইত্যাদি দিয়ে আহ্বান জানায়, তখন ভিক্ষু ‘অন্তরায়’ মনে করে বর্ষাবাস ত্যাগ করতে পারেন। এই আহ্বানকারী হতে পারে-
১) সাধারণ নারী,
২) ক্লীব (পণ্ডক),
৩) বেশ্যা,
৪) জ্ঞাতি,
৫) রাজা বা রাজপরিবার,
৬) চোর,
৭) ধূর্ত ব্যক্তি,
এই প্রলোভনের মাধ্যমে ধর্মচ্যুতি রোধ করাই বিধানের উদ্দেশ্য। (ম.ব.২০১)
Photo Samma Ditti
১৯ জানুয়ারি, ২০১৯ইং, পরমপূজ্য বনভান্তের শততম জন্মজন্তী উপলক্ষে আর্যপুর বনবিহারে বুদ্ধের সামনে সমবেত প্রার্থনারত পূজনীয় ভিক্ষুসংঘ।