07/09/2025                                                                            
                                    
                                                                            
                                            মনসুর হাল্লাজ-নুরাল পাগলা এবং তৌহিদী ক্রোধ // রাজু অনার্য
পারস্যের প্রখ্যাত সুফি সাধক হযরত  মনসুর হাল্লাজ রহ. যিনি হযরত বাবা জুনায়েদ বোগদাদি রহ. এর মুরিদ ও খলিফা ছিলেন। তাঁকে তৌহিদী জনতার দল ধর্মঅবমাননার দায়ে শূলে চড়িয়ে হত্য করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছিলো ৯২২ খ্রিষ্টাব্দে। তাঁর অপরাধ তিনি বলেছিলেন, "আল্লাহর সাথে আত্মিক যোগাযোগ স্থাপন করা যায়।" তিনি বলেছিলেন, "আনাল হক্ব।" আল্লাহর সাথে তাঁর মিলিত হবার বাসনার কারণে তৎকালীন বহু মুসলিম একেশ্বরবাদী ইসলামিক মতাদর্শকে বিকৃত করার অভিযোগ করে উনাকে "ছদ্ম-খ্রিস্টান" বলে আখ্যায়িত করেছিলো। তারা তাঁকে হত্যা করেছিলো যাতে তিনি ধর্মীয় নেতা হতে না পারেন। যাতে তিনি অলী না হতে পারেন, যাতে পৃথিবী থেকে মুছে যায় তাঁর নাম নিশানা। তাদের আহাম্মকি দেখে বাবা মনসুর হাল্লাজ তখন ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে হেসেছিলেন। শুধু এতটুকুই বলেছিলেন, "তোমরা অজ্ঞ। তোমরা আমার দেহটিকেই কেবল শূলে চড়াতে পারবে, কিন্তু আমি তো দেহ নই। আমি আত্মা। সেই আত্মা-তো ধরাছোঁয়ার বাইরে।" মনসুর হাল্লাজকেযখন বিচারের কাঠগড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়, একজন সূফি উনাকে জিজ্ঞাসা করেন যে, "প্রেম কি?"। তিনি জবাব দেন, "তুমি আজ, কাল, আর পরশুদিন তা নিজ চোখেই দেখবে"।
 যখন উনার পা কেটে ফেলা হয়, তখন তিনি বলেন, "এই পা দিয়ে আমি দুনিয়াতে চলাফেরা করতাম, এখন তো জান্নাত তো মাত্র এক কদম দুরে; পারলে সেই পা কাটো।" আর যখন হাত কেটে ফেলা হয় তখন তিনি সেই কাঁটাবাহুর রক্ত মুখে মেখে নেন। "কেন এমন করলেন?" জিজ্ঞাসা করলে উনি জবাব দেন, "আমার শরীর থেকে অনেক রক্তপাত হয়েছে, তাই আমার মুখ হলুদে দেখাচ্ছে, আমি নিজের মুখ ফ্যাকাশে দেখাতে চাই না(যেন মনে হয় যে আমি ভয় পাচ্ছি)।"
স্বয়ং হযরত ঈসা রুহুল্লাহ্ আ. এর মতন উচ্চ মাকামে অধিষ্ঠিত রাসুলকে পর্যন্ত ওরা রেহাই দেয় নি। থুৎনিতে দাড়ি ঝুলিয়ে, জোব্বা, দস্তানা, টুপি শরীরে এঁটে নবীকে পর্যন্ত ক্রুশে ঝুলিয়ে নির্মমভাবে শহীদ করেছে। 
কারা হত্যা করেছিলো ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ইবনে আব্দুল খাত্তাব রা.কে ? কারা মব সৃষ্টিকরে দীর্ঘদিন গৃহবন্দি করে কোরান পাঠরত অবস্থায় হত্যা করেছিলো খলিফা হযরত ওসমান ইবনে আফফান রা. কোরান না মানার অভিযোগে?
কারা কেন মাওলা আলী ইবনে আবু তালিব আ. কে কুফার মসজিদে নামাজরত অবস্থায় নির্দয় নিষ্ঠুরভাবে শহীদ করেছিলো? 
কারা কেন সিফফিনের যুদ্ধে হত্য করেছিলে রাসুল সা. এঁর নবুয়াতে প্রথমদিকের ইসলাম কবুলকারী সাহাবা ও প্রথম মসজিদ নির্মাণকারী মুসলিম হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির রা. কে?
কারা কেন হযরত ইমাম হাসানকে ইবনে আলী আ. কে বিষপান করিয়ে শহীদ করেছিলো? কারা মানবতার সমস্ত সীমা লঙ্ঘন করে বর্বরতার চরম দৃষ্টান্ত রেখে মহানবী সা. এঁর কলিজার টুকরা ইমাম হুসাইনকে ইবনে আলী আ. কে কারবালার মাঠে শহীদ করেছিলো? তাঁর দেহ মোবারককে অশ্বদ্বারা দলিত করেছিলো? তাঁর মস্তক মোবারককে বিচ্ছিন্ন করে তাঁরই পরিবারের নারীদেরকে উপহার দিয়েছিলো ও নবীবংশের রোদনকারী নারীগণের সম্মুখে বিকৃত উল্লাস করেছিলো? নবী বংশের নারী ও শিশুদের নিগৃহীতকরে তারা কোন ইসলাম প্রচার করতে চেয়েছিলো? 
ইতিহাসে ডাইনী হিন্দার ( হিন্দা হচ্ছে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী ও মুয়াবিয়ার মা) ঘটনা আছে। মহানবী সা. এঁর চাচা মুসলিম বীর হযরত আমির হামজাকে রা. কে শহীদ করার পর তাঁর বুক চিড়ে কলিজা বের করে চিবিয়ে খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছিলো সেদিন এই হিন্দা। কতটুকু কুৎসিত ক্রোধ ও হিংসার বশবর্তী হলে এ ঘটনাটি ঘটানো যায়?  
সুফি সাধক, রাসুল প্রেমিক, মুর্শিদ প্রেমিক হযরত বাবা সারমাদ শহীদ রহ. এর শিরোশ্ছেদ করেছে ধর্মান্ধরা ইসলাম রক্ষার নামে!
খাজা বাবা, বড়পীর বাবা, বাবা আহমদ রেফাই, বাবা মহিউদ্দিন ইবনুল আরাবী, বাবা মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমি, বাবা সানাই, বাবা আল্লামা ইকবাল, বাবা ইমাম গাজ্জালী, মরমি কবি কাজী নজরুল ইসলাম সহ শত শত সুফি সাধক, অলী, গাউস, কুতুব, আবদাল, আরিফদের এই সমস্ত উগ্রবাদী মানুষের দল স্রেফ লেবাসের জোরে মুসলিম সেজে কাফের ফতোয়া দিয়েছে। 
তাদের রক্তবীজ, তাদের মতাদর্শের উত্তরাধিকারীরা  কি এই পৃথিবীর মাঝে এখনো বিচরণ করছে না?  করছে।
শরীয়ত রক্ষার জন্য বাংলাদেশের রাজবাড়ি জেলার গোয়ালন্দ উপজেলার জুরান মাতব্বর পাড়ার নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলার ১৪দিন বয়সী লাশ ( ২৩ আগস্ট-০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫) কবর থেকে উত্তোলন করে স্থানীয় পদ্মার মোড়ে নিয়ে ক্রোধের আগুনে পুড়িয়ে ভস্ম করেছে ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি। কবরের ঘোর অন্ধকারে বসবাস করেও ১৪ দিনে পচন না ধরা লাশ তাদের হিংসার আগুনকে দমাকে পারেনি।
হৃদয়ে ষোলআনা ক্রোধ, পৃথিবীর সবটুকু নির্মমতা, এক সিন্ধু বিষাদের সুতীব্র অনল, পর্বতপ্রমাণ হিংসা, এক আকাশ অহমিকা ও নিকৃষ্টতম কুৎসিত কামনা জিইয়ে রেখে মহানবী সা. এঁর দাড়ি, টুপি, জোব্বা মোবারকের  লেবাস নিলেই মুসলমান হওয়া যায় না! মুসলমান হতে হলে রাসুল সা. এঁর মতোন মানবিক, উদার,  পরমত সহিষ্ণু, নিরহংকার ও স্নেহ-মায়া-প্রেম, ভালোবাসা ও সহনশীলতায় পরিপূর্ণ নরম হৃদয়ের মানবিক মানুষ, অপত্য উদারস্নেহে মহত্তম পিতা; পরিশুদ্ধ সিদ্ধ পুরুষ হতে হয়।
এই অশান্ত, উগ্রবাদী, পাষণ্ড, বর্বর, অসভ্য, উন্মাদ, বিকৃত মস্তিষ্কের অধিকারী মবেরদল শেষ পর্যন্ত নিজেদের কুৎসিত চেহারাটা শত চেষ্টা করেও আর ঢেকে রাখতে পারলো না।
মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, "এদের জ্ঞান দাও প্রভু, এদের ক্ষমা করো।" এদের হাত থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের রক্ষা করো।🙏
ছবি: সংগৃহীত ও মনোযোগ আকর্ষণের জন্য