28/05/2025
বছরের শ্রেষ্ঠ দশ দিন (জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন)-এর গুরুত্বপূর্ণ আমলগুলো:
(১) জিলহজের প্রথম ৯ দিন রোজা রাখা; বিশেষত আরাফার দিনের রোজা গুরুত্বপূর্ণ।
নবিজির স্ত্রী হাফসা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিলহজ মাসের ৯ দিন, আশুরার দিন এবং প্রতি মাসের তিন দিন রোজা রাখতেন।
[ইমাম নাসায়ি, আস-সুনান: ২৪১৭; হাদিসটি সহিহ]
অন্য হাদিসে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘আরাফার দিনের রোজার বিষয়ে আমি আল্লাহর নিকট আশা করি যে, তিনি এর দ্বারা বিগত বছর এবং আগামী এক বছরের গু*নাহ মাফ করে দেবেন।’’
[ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ২৬৩৬]
(আরাফার দিনের আমল নিয়ে অন্য পোস্টে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে, ইনশাআল্লাহ)
(২) সামর্থ্যবান হলে কুরবানি করা:
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করলো না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে।’’
[ইমাম ইবনু মাজাহ, আস-সুনান: ৩১২৩; হাদিসটি হাসান]
(৩) এই দশ দিন নখ ও চুল না কাটা:
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘তোমাদের কেউ জিলহজ মাসের চাঁদ দেখলে এবং কুরবানি করার ইচ্ছা করলে, সে যেন তার চুল ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকে।’’
[ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ৫০১৩]
আরেকটি বর্ণনায় এসেছে, শরীরের কোনো ত্বক বা চামড়াও যেন স্পর্শ না করে; অর্থাৎ না উঠায় বা না ছিঁড়ে (হোক সেটি ফাটা বা মরা)।
[ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ৫০১১]
সুতরাং, হাদিস থেকে জানা গেলো, জিলহজ মাস শুরু হয়ে গেলে কুরবানিদাতা ১০ তারিখের আগে চুল, নখ, পশম কাটবেন না; এমনকি ত্বকও স্পর্শ করবেন না। কুরবানিদাতার ক্ষেত্রে এগুলো না কাটার এই হুকুমকে কোনো কোনো আলিম ‘ওয়াজিব’ (আবশ্যক) বলেছেন, আবার অনেকে ‘মুস্তাহাব’ (উত্তম) বলেছেন। । তবে, অন্য হাদিস থেকে বোঝা যায়, যারা কুরবানি দেবে না, তারাও এই দিনগুলোতে এই নিয়ম মেনে চললে বিশেষ লাভবান হবেন।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘আমি কুরবানির দিন সম্পর্কে আদিষ্ট হয়েছি। আল্লাহ তা‘আলা তা এই উম্মতের জন্য ঈদ হিসেবে নির্ধারণ করেছেন।’’
এক ব্যক্তি বললো, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ্! যদি আমার কাছে শুধু একটি মানিহা থাকে (অর্থাৎ, অন্যের থেকে নেওয়া দুগ্ধ দানকারী একটি উটনী থাকে—তবুও কি কুরবানি দিতে হবে?)’ নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘‘না; বরং সেদিন (অর্থাৎ, ঈদের দিন) তুমি তোমার চুল কাটবে, নখ কাটবে, গোঁফ ও নাভীর নিচের পশম পরিষ্কার করবে। এটাই আল্লাহ তা’আলার কাছে তোমার পূর্ণ কুরবানি বলে গন্য হবে।’’
[ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ: ৬৫৭৫; ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান: ২৭৮৯; ইমাম হাকিম, ইবনু হিব্বান, মুনযিরি, তাবারানি, যাহাবি, শুয়াইব আরনাউত্ব (রাহিমাহুমুল্লাহ্)-সহ মুহাদ্দিসগণ হাদিসটির সনদ হাসান (গ্রহণযোগ্য) বলেছেন]
এই হাদিসে ঈদের দিনে নখ ও চুল কাটতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ, প্রথম ৯ দিনে না কেটে একেবারে ঈদের দিনে কাটলে আল্লাহর নিকট পূর্ণ কুরবানির নেকি পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ। সুতরাং, আমাদের মধ্যে যারা কুরবানি দেবো আর যারা দেবো না, সবাই জিলহজ মাসের চাঁদ দেখার আগেই নখ ও চুল কেটে নেবো। এরপর এই ৯ দিন নখ ও চুল না কেটে আরেকবার ঈদের দিন পশু জবাইয়ের পরে কোনো একসময় কাটবো, ইনশাআল্লাহ। ধরুন, দুপুরের পর হতে পারে।
(৪) চার ধরনের যিকরে লেগে থাকা:
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘আল্লাহ তা‘আলার নিকট জিলহজের দশ দিনের আমলের চেয়ে মহান এবং প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই। সুতরাং, তোমরা সেই দিনগুলোতে অধিক পরিমাণে
তাসবিহ (সুবহানাল্লাহ),
তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ),
তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্) ও তাকবির (আল্লাহু আকবার) পড়ো।’’
[ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ: ৫৪৪৬; হাদিসটির সনদ সহিহ]
(৫) বিশেষ করে বেশি বেশি তাকবির তথা আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা করা উচিত।
সাধারণভাবে এই দশ দিন সংক্ষেপে ‘আল্লাহু আকবার’ বেশি বেশি পড়ুন। সাথে, নিচের বাক্যগুলোও সাধ্যানুসারে পড়ুন।
اَللّٰهُ أَكْبَرْ اَللّٰهُ أَكْبَرْ لَا إِلٰهَ إِلَّا اللّٰهُ وَاللّٰهُ أَكْبَرْ اَللّٰهُ أَكْبَرْ وَلِلّٰهِ الْحَمْد
আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার; লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার; ওয়া লিল্লাহিল হামদ।
(আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ; আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ; আল্লাহ ছাড়া কোনও উপাস্য নেই। আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ; আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ; আর আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা)
এটি প্রখ্যাত সাহাবি ইবনু মাস‘উদ (রা.) ও অন্যান্য পূর্বসূরিদের থেকে প্রমাণিত।
[ইমাম দারা কুতনি, আস-সুনান: ১৭৫৬; শায়খ আলবানি, ইরওয়াউল গালিল: ৬৫৪; হাদিসটির সনদ সহিহ]
উল্লেখ্য, আরাফার দিন অর্থাৎ জিলহজের ৯ তারিখ ফজর থেকে শুরু করে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর একাকী বা জামাতে নামাজ আদায়কারী, নারী অথবা পুরুষ—প্রত্যেকের জন্য একবার তাকবিরে তাশরিক (উপরে বর্ণিত তাকবিরটি) পাঠ করা ওয়াজিব। পুরুষরা উচ্চ আওয়াজে বলবে, আর নারীরা নিচু আওয়াজে।
[ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমু‘উ ফাতাওয়া: ২৪/২২০; ইমাম ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মা‘আদ: ২/৩৬০; ইমাম ইবনু আবিদিন, রাদ্দুল মুহতার: ৩/৬১]
(৬) চারটি সম্মানিত মাসের একটি হলো জিলহজ; তাই এই মাসের সম্মানে যথাসম্ভব সকল গু*নাহ থেকে বেঁচে থাকা উচিত।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট সংরক্ষিত ফলকে (বছরে) মাসের সংখ্যা বারোটি—আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তার মধ্যে চারটি (মাস) সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর মধ্যে তোমরা (গু*নাহ করার মাধ্যমে) নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না।”
[সুরা তাওবাহ, আয়াত: ৩৬]
(৭) এই দিনগুলো বছরের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ, তাই এই দিনগুলোতে অধিক পরিমাণে নেক আমলে লেগে থাকা উচিত।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘আল্লাহ তা‘আলার নিকট জিলহজের (প্রথম) দশ দিনের আমলের চেয়ে অধিক মর্যাদাপূর্ণ ও প্রিয় অন্য কোনো আমল নেই।’’ সাহাবিগণ বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আল্লাহ রাস্তায় জি*হাদও কি এর চেয়ে উত্তম নয়?’ তিনি বললেন, ‘‘না। আল্লাহর রাস্তায় জি*হাদও নয়। তবে যে ব্যক্তি তার জান ও মাল নিয়ে (জি*হাদে) ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং এর কোনোটি নিয়েই আর ফিরে এলো না (অর্থাৎ, শ*হিদ হয়ে গেলো, তার কথা ভিন্ন)।’’
[ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ৯৬৯; ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান: ২৪৩৮]
এই দশদিনের ফরজ ইবাদত অন্যান্য মাসের ফরজ ইবাদতের তুলনায় অধিক মর্যাদার। এই দশদিনের নফল ইবাদত অন্যান্য মাসের নফল ইবাদতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।
[ইমাম ইবনু রজব, ফাতহুল বারি: ৯/১৫]
আমরা কী কী আমল করতে পারি?
(এখন যে আমলগুলোর কথা বলা হবে, সেগুলো বছরের যেকোনো সময়ের জন্য। বিশেষভাবে জিলহজ মাসের এই দিনগুলোর জন্য নির্ধারিত নয়। তবে, জিলহজেও এগুলো করতে পারি।)
১- বেশি বেশি ইস্তিগফার পাঠ করা:
কুরআন কারিমে এসেছে, ‘‘(নুহ আ. বললেন) অতঃপর আমি বললাম, তোমরা তোমাদের রবের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের উপর মুষলধারে বৃষ্টি দেবেন, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বাড়িয়ে দিবেন, তোমাদের জন্য বাগ-বাগিচা স্থাপন করবেন এবং তোমাদের জন্য নদী-নালা প্রবাহিত করবেন।’’
[সুরা নুহ, আয়াত: ১০–১২]
২- আন্তরিকভাবে তাওবাহ করা:
আল্লাহ্ বলেন, ‘‘অবশ্যই আল্লাহ তাদের তাওবাহ কবুল করবেন, যারা ভুলবশত মন্দ কাজ করে, অতঃপর দেরি না করেই (দ্রুত) তাওবাহ করে। এরাই হলো সেসব লোক, যাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন।’’
[সুরা নিসা, আয়াত: ১৭]
৩- অধিক পরিমাণে দরুদ পাঠ করা:
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি আমার প্রতি একবার দরুদ পাঠ করবে, আল্লাহ তার প্রতি ১০ বার রহমত বর্ষণ করবেন, ১০ টি গু*নাহ মোচন করবেন এবং তার জন্য ১০ টি স্তর উন্নীত করবেন।’’
[ইমাম নাসায়ি, আস-সুনান: ১২৯৭; ইমাম ইবনু হিব্বান, আস-সহিহ: ৯০৪; হাদিসটি সহিহ]
৪- সাধ্যানুযায়ী দান-সদাকাহ করা:
নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “প্রত্যেক ব্যক্তি (হাশরের মাঠে) তার সদাকার ছায়াতলে থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত লোকদের মাঝে ফয়সালা শেষ না হবে।”
[ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ: ১৭৩৩৩; শায়খ আলবানি, সহিহুত তারগিব: ৮৭২; হাদিসটি সহিহ]
৫- কুরআন তিলাওয়াত করা:
আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, “তোমরা কুরআন তিলাওয়াত করো, কারণ কুরআন কিয়ামতের দিন তার সাথীর (তিলাওয়াতকারীর) জন্য সুপারিশ করবে।”
[ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ১৭৫৯]
৬- সুরা ইখলাস বেশি করে পড়া:
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ! নিঃসন্দেহে এটি (সুরা ইখলাস) কুরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমান।’’
[ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ৫০১৩]
৭- এছাড়াও আমরা আরও যা করতে পারি:
ক- সামর্থ্য থাকলে হজ ও উমরা আদায় করা;
খ- বেশি বেশি দু‘আ করা;
গ- মা-বাবার যথাসাধ্য খেদমত করা;
ঘ- শেষ রাতে তাহাজ্জুদ আদায় করা;
ঙ- অসুস্থ ব্যক্তির সেবা-সুশ্রূষা করা;
চ- মানুষের অভাব ও প্রয়োজন মেটানো;
সকাল-সন্ধ্যা ও ঘুমের আগের আমলগুলো গুরুত্বের সাথে আদায় করা।
সংগৃহীত।