17/06/2024
কতটুকু গরুর মাংস খাওয়া নিরাপদ, আর স্বাস্থ্যসম্মত উপায়েই বা কিভাবে খাবেন?
বছরজুড়ে মাংস খাওয়ার পরিমাণ আমাদের সীমিত থাকলেও কোরবানির ঈদে প্রায় প্রত্যেক ঘরে লাল মাংস বা রেড মিট খাওয়ার পরিমাণ বেড়ে যায়।
আসুন জেনে নেই রেড মিট কি?
গরু, ছাগল, খাসি অথবা উটের মাংসকে রেডমিট বা লাল মাংস বলা হয়। এতে থাকা ভিটামিন আর মিনারেল একদিকে যেমন শরীরের ঘাটতি পূরণে সহায়তা করে আবার অপরদিকে রেড মিটে থাকা কোলেস্টেরল, চর্বি বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকির আশঙ্কা তৈরি করে।
বিশেষ করে হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ বা স্থূলতায় আক্রান্ত মানুষদের জন্য এসব লাল মাংস বিপদের কারণ হতে পারে।
গরুর মাংস খাওয়া কি বাদ দিতে হবে?
অবশ্যই না, কিছু নিয়ম মেনে চললে সবাই কম বেশি গরুর মাংস বা যেকোনো ধরনের রেড মিট স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়িয়ে খেতে পারবেন।
লাল মাংসের উপকারিতা কি?
গরুর মাংসে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আমিষ, ভিটামিন এবং খনিজ উপাদান যা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে। এসব উপাদান আমাদের দাঁত, হাড় ও মাংসপেশি সুগঠিত করে। এছাড়াও লাল মাংস আমাদের ত্বক, চুল ও নখের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে। এর পাশাপাশি এটি আমাদের দৃষ্টিশক্তি ও স্মৃতিশক্তি প্রখর রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গরুর মাংস রক্তস্বল্পতা দূর করে শরীরে শক্তি সরবরাহ করে। এর পাশাপাশি শরীরের বৃদ্ধি এবং বুদ্ধি দুটোই বাড়াতে ভূমিকা পালন করে বলেই বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
লাল মাংসের অপকারি দিক কি?
বহু পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ এই লাল মাংস অতিরিক্ত এবং স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে না খেলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে। কারণ এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে সোডিয়াম যা আমাদের রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। যেটি পরবর্তীতে বিভিন্ন স্বাস্থ্যব্যাধি যেমন হৃদরোগ, স্ট্রোক ও কিডনি জটিলতার কারণ হতে পারে।
গরুর মাংসে যে কোলেস্ট্রল থাকে তা যদি আমাদের শরীরে বেড়ে যায় তাহলে তা হার্টের শিরায় জমতে থাকে এবং রক্তের স্বাভাবিক চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। যার ফলে হার্ট পর্যন্ত পর্যাপ্ত পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ সম্ভব হয় না এবং হার্ট অ্যাটাক পর্যন্ত হতে পারে।
এছাড়াও গরুর মাংস অতিরিক্ত খেলে টাইপ টু ডায়াবেটিক্স, আর্থাইটিস, হজমের সমস্যা, গ্যাস্ট্রিক, পেট ব্যথা, কোষ্ঠকাঠিন্য সহ ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। পাইলসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য লাল মাংস বেশি খেলে সমস্যা আরো বেড়ে যেতে পারে।
কতটুকু রেড মিট খাওয়া স্বাস্থ্যকর?
কোরবানির ঈদ, বা যে কোন সামাজিক অনুষ্ঠান বা ভুরিভোজ পার্টি যেখানেই হোক না কেন কখনোই একটানা মাংস খাওয়া যাবে না। সম্ভব হলে রাতের বেলা মাংস খাওয়া এড়িয়ে যেতে হবে।
পুষ্টিবিদদের মতে একজন স্বাভাবিক মানুষের গরুর মাংস খাওয়ার নিরাপদ মাত্রা সপ্তাহে দুই দিন যেখানে মাংসের মোট পরিমাণ হবে ১৫৪ গ্রাম। অর্থাৎ সপ্তাহের ওই দুই দিন প্রতিবেলায় মাংস খেতে হবে ১৬ থেকে ২৬ গ্রাম। সহজ ভাষায় প্রতিবেলায় ঘরে রান্না করা মাঝারি সাইজের মাংসের ২ থেকে ৩ টুকরার বেশি খাওয়া যাবেনা।
তবে কিডনি রোগ, ডায়াবেটিকস, উচ্চ রক্তচাপ বা হৃদরোগে আক্রান্ত মানুষের ক্ষেত্রে মাংস খাওয়ার পরিমাণ চিকিৎসকের কাছে জেনে নিতে হবে। এক্ষেত্রে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ওই ব্যক্তির ওজন, বয়স ও শারীরিক পরিস্থিতি বুঝে এই পরিমাণ ঠিক করে দেবেন।
সাধারণত সপ্তাহে এক থেকে দুই বেলা মাংস খেলে তেমন ঝুঁকি নেই তবে চিকিৎসকের বিধি নিষেধ থাকলে তা অবশ্যই মেনে চলতে হবে।
গরুর কোন অংশের মাংস খাওয়া ভালো?
বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায় গরুর শরীরে দুটি অংশে চর্বির পরিমাণ অনেক কম থাকে।
যার একটি হলো গরুর পেছনের রানের উপরের ফোলা অংশের মাংস যাকে রাউন্ড বলে এবং অপরটি পেছনের দিকের উপরের অংশ যাকে সেলনয়েড বলে।
অপরদিকে গরুর মাংসের মগজ, কলিজা এবং ঝোলে সবচেয়ে বেশি চর্বি থাকায় এগুলো এড়িয়ে চলাই উত্তম।
গরুর মাংস কাটার সঠিক পদ্ধতি কি?
সাধারণত মাংস কাটা, সংরক্ষণ পদ্ধতি এবং রান্না করার ওপর নির্ভর করে মাংসটি কতটা স্বাস্থ্যকর হবে। এজন্য কোরবানির মাংস বা বাজার থেকে কিনে আনা মাংস বাড়িতে নিয়ে আসার সাথে সাথেই তা ভালোমতো ধুয়ে রক্ত পরিষ্কার করে নিতে হবে। মাংস কাটার সময় যদি মাংসের বাইরের চর্বি ফেলে দেয়া হয় তবে এতে থাকা কোলেস্টেরলের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে। মাংস অবশ্যই ছোট ছোট পিস করে কাটা উচিত এতে করে চর্বির অংশ অনেকখানি কাটা পড়ে।
এরপর কাটা মাংস ভালোভাবে ধুয়ে কিছুক্ষণ পানিতে সিদ্ধ করলে এর ভেতর থেকে চর্বি গোলে পানির উপরে উঠে আসে এই পানি ফেলে দিলেও চর্বির পরিমাণ কমবে। তবে এর সাথে মাংসের ভিটামিনস ও মিনারেলস এটিও বের হয়ে যাবে। ফলে মাংস খাওয়ার স্বাস্থ্য উপকারিতা অনেকখানি কমে যাবে।
এছাড়াও সেদ্ধ মাংস বা কাঁচা মাংসে ভিনেগার, লেবুর রস, টক দই দিয়ে মেরিনেট করে রাখলে একদিকে যেমন মাংসটি কম সময় সেদ্ধ করা সম্ভব হবে অপরদিকে এর ক্ষতিকর চর্বির প্রভাব অনেকটাই কাটানো যাবে।
গরুর মাংস রান্নার সঠিক পদ্ধতি?
চর্বি ছাড়ানো সিদ্ধ করা গরুর মাংসে যতটুকু না দিলেই না ততটুকু তেল দিয়ে রান্না করাই ভালো। আর রান্না করার সময় সোয়াবিন তেল, ঘি, মাখন বা ডালডার পরিবর্তে অলিভ অয়েল ব্যবহার করা যেতে পারে।
বেশি করে তেল মসলা দিয়ে কষে গরুর মাংস রান্না করার চাইতে ঝোল ঝোল করে মাংস রান্না করা ভালো। আর খাওয়ার সময় এসব ঝোল বাদ দিয়ে শুধু মাংস খেতে হবে যাতে করে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল এড়ানো যায়।
রেড মিট অবশ্যই উচ্চতাপে ভালো করে সিদ্ধ করে নরম করে খেতে হবে। কারণ আধা সেদ্ধ বা কাঁচা মাংসে খুব সহজেই ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করে। সবচেয়ে ভালো হয় আগুনে ঝলসে এসব মাংস খেতে পারলে। কারণ এর ফলে এতে থাকা তেল, চর্বি কোলেস্টেরল অনেকটাই ঝরে যায়।
আবার মাংসের তৈরি ভাজা আইটেম যদি তেল তেলে মনে হয় খাওয়ার আগে টিস্যুতে বাড়তি তেল শুষে নেওয়া যেতে পারে।
রেড মিট সংরক্ষণের সঠিক পদ্ধতি কি?
এদেশের আবহাওয়ায় মাংস বেশিক্ষণ বাহিরে রাখলে তাতে খুব সহজেই ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত হতে পারে। এ কারণে মাংস বাসায় আনার সাথে সাথে তা কেটে ভালো মতো ধুয়ে সমস্ত রক্ত পরিষ্কার করে নিতে হবে। এরপর যে অংশ রান্না করা হবে তা রান্না করে নিতে হবে আর বাকি অংশ ফ্রিজে সংরক্ষণ করা যেতে পারে। সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে কখনোই সাধারণ মানের সস্তা পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা যাবে না। এক্ষেত্রে মাংসগুলো ফুড গ্রেডেড সিপ ব্লক ব্যাগ বা ফুড গ্রেডেড সিপ ব্লক পাত্রে রাখা স্বাস্থ্যসম্মত।
আবার মাংস জাল দিয়েও অনেক দিন সংরক্ষণ করা যায়। এক্ষেত্রে মাংসটি ৬ ঘন্টা পর পর গরম করতে হয়।
মাংসের সাথে আর কি খাওয়া যেতে পারে?
কোরবানির ঈদের সময় দেখা যায় সকাল-বিকাল- রাত শুধু গরুর মাংসের নানা পদ খাওয়া হয় যা আমাদের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এ কারণে মাংসের পাশাপাশি প্রতিবেলা বিভিন্ন ধরনের সবজি যেমন- মিষ্টি কুমড়া, লাউ, ফুলকপি, বাঁধাকপি, পেঁপে অথবা টমেটো, শসা, গাজর, লেবু দেয়া সালাত রাখা যেতে পারে। সবজিতে থাকা ফাইবার মাংসের চর্বি হজমে সাহায্য করবে। আবার এতে করে প্রতিবেলা মাংস খাওয়ার পরিমানও কমবে এবং খাদ্যাভ্যাসে একটা নিরাপদ ভারসাম্য তৈরি হবে।
বেশি মাংস খেয়ে ফেললে করণীয় কি?
কখনো যদি বেশি মাংস খাওয়া হয়ে যায় তাহলে কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে যা এড়াতে প্রচুর পরিমাণে পানি, শরবত, ফলের রস, ইসুবগুলের ভুষি সহ অন্যান্য তরল খাবার খাওয়া যেতে পারে।
এছাড়া মাংসের অতিরিক্ত ক্যালরি পোড়াতে প্রতিদিন নিয়মিত হাটা বা ব্যায়ামের অভ্যাস করা যেতে পারে। তবে খাওয়ার পর পরই অবশ্যই ব্যায়াম করা যাবে না, খাওয়া-দাওয়ার পর কিছুটা বিরতি দিয়ে ব্যায়াম করতে হবে।
এভাবে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে মাংস রান্না করে পরিমিত পরিমাণে খেলে যে কোন স্বাস্থ্যঝুকি এড়ানো সম্ভব।
নিজে জানুন, অন্যকে জানান।
নিয়মিত স্বাস্থ্য টিপস পেতে আমাদের পেজের সাথেই থাকুন।