27/04/2025
#সেলফ_রুকইয়াহ: বদনজরের লক্ষণ ও রুকইয়াহ
"বদনজর" বা নজর লাগা" কুসংস্কার নয়। বরং চরম তিক্ত বাস্তবতার নাম বদনজর। কোনো জিনিস দেখে আশ্চর্য বা মুগ্ধ হওয়া কিংবা হিংসা প্রকাশের কারণে নজরের কুপ্রভাব লেগে যায়। জীবনে একবারও বদনজরে আক্রান্ত হয়নি এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। দৈনন্দিন জীবনে প্রতিনিয়ত এই বাস্তবতার সম্মুখীন হচ্ছেন অনেকেই। শরীর স্বাস্থ্য ও চেহারা নষ্ট হয়ে যাওয়া, অস্থিরতা, জ্বর, সর্দি-কাশি, শরীরে ব্যথা সহ দুরারোগ্য বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন নজর-হাসাদ এর কারণে। কিন্তু না জানার কারণে সঠিক নিতে নেওয়া হচ্ছে না। মেডিকেল চিকিৎসা করেও কোনো ভালো হচ্ছে না। বদনজর সংক্রান্ত হাদিসগুলো যতই পড়বেন ততই অবাক হবেন এবং এর তিক্ত বাস্তবতা সহজে বুঝতে পারবেন।
*নজর সংক্রান্ত হাদীস:
১.
আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নিশ্চয়ই বদনজর (এর কুপ্রভাব) সত্য। (বুখারী ৫৭৪০, মুসলিম, আবু দাউদ, ইবনু মাজাহ)
২.
হুমাইদ ইবনু কাইস মক্কী (র) থেকে বর্ণিতঃ জা‘ফর (রা)-এর দুই ছেলেকে দেখে রাসূল (সাঃ) তাদের আয়া'কে বললেন, এই ছেলেরা এত জীর্ণশীর্ণ (দুর্বল) কেন? আয়া উত্তর দিল, ইয়া রসূলাল্লাহ! তাদের উপর খুব দ্রুত (খুব সহজেই) বদ নজর লেগে যায়। অতঃপর রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এদেরকে রুকইয়াহ কর। (তিরমিযী, ইবনু মাজাহ)
৩.
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, বদনজর সত্য। বদনজর মানুষকে কবরে পৌঁছে দেয় এবং উটকে পাতিলে। মুসনাদুশ শিহাব)
৪.
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার উম্মতের মধ্যে তাকদিরের মৃত্যুর পর সর্বাধিক মৃত্যু হবে বদনজর লাগার দ্বারা। (মুসনাদু তয়ালুসি)
৫.
নবী কারীম (সা:) বলেছেন, বদনজর বাস্তব। যদি কোনো বস্তু তাকদিরকে অতিক্রম করত; তবে বদনজর তা অতিক্রম করত। সুতরাং তোমাদের কাছে যখন ( এর প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে) গোসলের জন্য পানি চাওয়া হয় তখন পানি দিবে। (মুসলিম)
৬.
আয়িশা রাদিআল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিতঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ তোমরা আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করো। কেননা বদনজর সত্য বা বাস্তব ব্যাপার।
৭.
সাহল ইবনু হুনাইফ (রা.) এর ওপর একবার আমির ইবনু রাবিআ (রা.) এর নজর লেগে যায়। সাথে সাথে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান এবং প্রচন্ড জ্বর চলে আসে। তখন রাসূল (সা.) আমিরকে ওযুর পানি দিয়ে গোসল করার পরামর্শ দিলেন। গোসলের পর সাহল রা. পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলেন। (মুআত্তা মালিক ১৬৮৮)
এসব হাদিসে বদনজরের কুপ্রভাব এবং তার ভয়ংকর পরিণতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। এসব সমস্যার চিকিৎসা সম্পর্কেও নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দিক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। আয়িশা রাদিআল্লাহু আনহা বলেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বদনজরের কুপ্রভাব থেকে আরোগ্য লাভের জন্য রুকইয়াহ করার নির্দেশ দিতেন।
*বদনজরের সম্ভাব্য লক্ষণ ও রোগব্যাধি:
বদনজরের কারণে বিভিন্ন ধরণের শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। কুরআন-হাদীস, বিশেষজ্ঞ রাকী ও আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে নিচে কিছু সাধারণ লক্ষণ ও সমস্যার তালিকা দেওয়া হলো:
** শারীরিক দুর্বলতা: কোনো কারণ ছাড়াই দুর্বল ও ক্লান্ত অনুভব করা।
* মাথাব্যথা: ঘন ঘন মাথাব্যথা করা এবং ওষুধেও সহজে ভালো না হওয়া।
* অলসতা: কাজে বা কোনো কিছুতেই আগ্রহ না পাওয়া এবং সবসময় ঘুমঘুম ভাব থাকা।
* মেজাজ পরিবর্তন: হঠাৎ করে রেগে যাওয়া বা মন খারাপ হওয়া।
* অনিদ্রা: রাতে ঘুমাতে অসুবিধা হওয়া।
* ঘন ঘন অসুস্থ হওয়া: কোনো কারণ ছাড়াই বারবার অসুস্থ হয়ে পড়া।
* সৌন্দর্যহানি: চেহারার ঔজ্জ্বল্য কমে যাওয়া বা মলিন হয়ে যাওয়া।
* সম্পর্কের অবনতি: পরিবার বা বন্ধুদের সাথে সম্পর্ক খারাপ হওয়া।
* কাজে বাধা: কোনো কাজ শুরু করতে না পারা বা কাজ শেষ করতে অসুবিধা হওয়া।
* আর্থিক ক্ষতি: ব্যবসায় বা চাকরিতে হঠাৎ করে লোকসান হওয়া।
* হিংসা ও বিদ্বেষ: আপনার প্রতি মানুষ খারাপ ধারণা পোষণ করা বা উন্নতিতে কষ্ট পাওয়া।
* অতিরিক্ত হাই তোলা ও ঢেকুর আসা: বিনা কারণে অতিরিক্ত হাই তোলা বা ঢেকুর আসা।
* বমি বমি ভাব: কোনো কারণ ছাড়াই বমি বমি ভাব হওয়া।
* হার্টবিট বেড়ে যাওয়া: হঠাৎ করে বুক ধড়পড় করা।
* শরীরে ঠান্ডা বা গরম অনুভব: হঠাৎ করে শরীরে ঠান্ডা বা গরম লাগা।
*বদনজরের রুকইয়াহ ও প্রতিকার:
*রুকইয়াহ পাঠ করা
১. প্রতিদিন দিন ও রাতে দুইবার সূরা ফাতিহা, আয়াতুল কুরসি, সূরা কাফিরুন, ইখলাস ফালাক ও সূরা নাস এবং নজরের আয়াত পাঠ করবেন।
২. সূরা ফালাক ও সূরা নাস আধঘন্টা করে প্রতিদিন একবার বা দুইবার তিলাওয়াত করবেন।
৩. সূরা বাকারাহ পাঠ করুন। সম্ভব হলে প্রতিদিন একবার কিংবা তিনদিন বা সাতদিনে একবার সম্পূর্ণ সূরা পড়ুন।
৪. মাসনূন দুআ'র কয়েকটি পাঠ করবেন।
أَعُوْذُ بِكَلِمَاتِ اللّٰهِ التَّامَّةِ ، مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ وَّهَامَّةٍ ، وَمِنْ كُلِّ عَيْنٍ لَّامَّةٍ
আউযু বিকািলমাতিল্লাহিত তা-ম্মাহ্, মিং কুল্লি শাইতানিও ওয়া হা-ম্মাহ্, ওয়া মিং কুল্লি আইনিল লা-ম্মাহ্।
بِسْمِ اللَّهِ أَرْقِيكَ مِنْ كُلِّ شَىْءٍ يُؤْذِيكَ مِنْ شَرِّ كُلِّ نَفْسٍ أَوْ عَيْنِ حَاسِدٍ اللَّهُ يَشْفِيكَ بِاسْمِ اللَّهِ أَرْقِيكَ
বিসমিল্লা-হি আরক্কীক, মিং কুল্লি শাইয়িঈ ইউ’যীক, মিং শাররি কুল্লি নাফসিন আও ‘আইনি হা-সিদ, আল্লা-হু ইয়াশফীক, বিসমিল্লা-হি আরক্কীক।
بِاسْمِ اللَّهِ يُبْرِيكَ وَمِنْ كُلِّ دَاءٍ يَشْفِيكَ وَمِنْ شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ وَشَرِّ كُلِّ ذِي عَيْنٍ
বিসমিল্লা-হি ইউবরীক, ওয়া মিং কুল্লি দা-ঈই ইয়াশফীক, ওয়া মিং শাররি হা-সিদিন ইযা-হাসাদ, ওয়া শাররি কুল্লি যী ‘আঈন।
*রুকইয়াহ'র অডিও শোনা
প্রতিদিন একবার বা দুইবার করে নিচের অডিও গুলো শুনবেন।
১. রুকইয়াহ নজর-হাসাদ
২. রুকইয়াহ আযান
৩. ঘুমের সমস্যা থাকলে রাতে ঘুমের পূর্বে রুকইয়াহ আট সূরা।
*রুকইয়াহ'র পানি পান
প্রতিদিন রুকইয়াহ'র পড়া পানি পান করবেন। দৈনিক অন্তত তিনবার বা এর বেশি যতবার ইচ্ছা পান করুন। প্রতিদিনের পানি প্রতিদিন তৈরি করতে পারেন অথবা বেশি পরিমাণে বা ৭ দিন যতদিন লাগে ততদিনের জন্য তৈরি সংরক্ষণ করে ব্যবহার করতে পারেন। এক্ষেত্রে নিচের আয়াত গুলো পাঠ করতে পারেন।
সূরা ফাতিহা আয়াতুল কুরসি সূরা কাফিরুন ইখলাস ফালাক ও সূরা। সাথে নজর-হাসাদ এর কিছু আয়াত। যেমন সূরা বাকারাহ ১-৪, ১০৯, সূরা নিসা ৫৪, সূরা কাহাফ ৩৯, সূরা সফফাত ১-১০, সূরা মূলক ৪, সূরা কলম ১-৫, ৫১-৫২ নং আয়াত।
*রুকইয়াহ গোসল করা
একাধারে ৭ দিন বদনজরের রুকইয়াহ গোসল করবেন। বদনজরের রুকইয়াহ গোসলের নিয়ম -
এক বালতি পানিতে কব্জি পর্যন্ত দুই হাত ডুবিয়ে উপরোক্ত আয়াতগুলো ৩/৭ বার করে ফুঁ দিন। সম্ভব না হলে শুধু সূরা ফাতিহা আয়াতুল কুরসি ও চারকুল ৭ বার করে ফুঁ দিন। এরপর সেই পানি দিয়ে গোসল করুন। সম্ভব হলে গোসলের পূর্বে একটু পানি পান করুন।
*রুকইয়াহ'র তেল ব্যবহার করা।
উপরোক্ত আয়াত গুলো পড়ে অলিভ অয়েল বা কালোজিরার তেলে ফুঁ দিন। এরপর গোসলের পর বা সকাল দুপুর রাতে শরীরের ব্যবহার করুন। বিশেষ করে মাথা, ঘাড়, কাঁধ, কান, বুক, হাত-পা, এবং এলার্জি, চুলকানি ও ব্যথার স্থানে।
*হেফাজতের মাসনূন দুআ
জ্বীনের অনিষ্ট, বদনজর হাসাদ ও জাদু এবং নতুন করে জাদু করলে তা যে প্রভাব না ফেলে, এসবের ক্ষতি থেকে সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও হেফাজতের উদ্দেশ্যে সকাল সন্ধ্যার মাসনূন আমলগুলো নিয়মিত পালন করবেন। কোনদিন যেন মিস না হয়। সুস্থ হয়ে গেলেও স্থায়ীভাবে এইগুলো চালিয়ে যেতে হবে।
তাবিজ কবজ, হারাম ও কুফরী-শিরকি ঝাড়ফুঁক এবং কুসংস্কার পরিহার করুন।
*রুকইয়াহ'র ইফেক্ট বোঝা
রুকইয়াহ'র আয়াত ও দুআ পাঠ করার সময় এবং অডিও শোনার সময় নজর-হাসাদ কেন্দ্রিক সাময়িক বিভিন্ন ইফেক্ট হতে পারে। রুকইয়াহ করলে সমস্যা গুলো বিভিন্ন ইফেক্ট প্রকাশ হওয়ার মধ্য দিয়ে ধ্বংস হয়ে যায়, সমস্যাগুলো চলে যায় এবং পেশেন্ট সুস্থ হয়ে যায়। কি ধরনের ইফেক্ট হতে পারে ধারণার জন্য নিচে কিছু কিছু ইফেক্টের ধরণ উল্লেখ করছি।
নজরের ইফেক্ট– ঘুমঘুম ভাব হওয়া। বারবার হাই উঠা। শরীর ভার ভার লাগা। অস্বাভাবিক গরম লাগা। ঘাম বের হওয়া। শরীর, মাথা, কান দিয়ে গরম বের হওয়া। কখনও কখনও পুরো শরীর বা কোনো অঙ্গ ঠান্ডা লাগা। জ্বর আসা, সর্দি লেগে যাওয়া। প্রস্রাব বা টয়লেটের চাপ সৃষ্টি হওয়া। চোখ দিয়ে পানি আসা। রুকইয়াহ'র পর শরীর হালকা লাগা।
*প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা লিখে রাখা:
প্রতিদিন কি ধরণের ইফেক্ট হচ্ছে, শারীরিক মানসিক এবং সুস্থতার ধরন লিগে রাখুন।
▼ রুকইয়াহ করার পর কেমন অনুভব হচ্ছে?
▼ মানসিক পরিবর্তন হচ্ছে কি না?
▼ শারীরিক পরিবর্তন হচ্ছে কিনা?
*কোনো বাধা অনুভব করলে করণীয়:
* ধৈর্য রাখা এবং নিয়মিত আমল চালিয়ে যাওয়া।
* শয়তান ওয়াসওয়াসা দিতে পারে, তাই নিয়মিত রুকইয়াহ করা।
* বিরক্ত, অনিহা, অনাগ্রহ লাগতে পারে। পাত্তা দিবেন না।
* মনে হতে পারে যে, অসুস্থ হয়ে গেছি চিকিৎসা করে সুস্থ হয়ে তারপর আবার রুকইয়াহ করবো।
* এমন হলে বন্ধ না করে রুকইয়াহ চালিয়ে যাবেন সুস্থ হয়ে যাবেন। ইনশাআল্লাহ।
* আল্লাহর উপর ভরসা রাখা। বিশ্বাস রাখবে- কুরআনে শিফা আছে, আল্লাহ তাআলা সুস্থ করে দিবেন।
*ফলাফল ও সফলতা:
এভাবে ৭ দিন রুকইয়াহ করবেন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে যাবেন ইনশাআল্লাহ। এরপরও সমস্যা থাকলে আরো ৭ বা ১৪ দিন রুকইয়াহ করবেন।