16/06/2025
আজকাল ওজন নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। অনেকেই বলেন—খাবার নিয়ন্ত্রণ করছি, নিয়মিত হাঁটছি, নানা চেষ্টা করছি—তবু কেন যেন ওজন কমে না।
অন্যদিকে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওজন কমানোর উপায় নিয়ে উপচে পড়ছে নানা পোস্ট, ভিডিও আর পরামর্শ। অনেকে কিনছেন স্লিমিং টি, আপেল সিডার ভিনেগার, কেউ খাচ্ছেন নিমপাতার গুঁড়া, ঘৃতকুমারী, মরিঙ্গা পাউডার, করলার রস—আরও কত কিছু।
কিন্তু সত্যিই কি এসব উপায়ে ওজন কমে? না কমলে, তাহলে কীসে কমে?
🤔ওজন বাড়ে কেন?
ওজন মূলত নির্ধারিত হয় দুটি বিষয়ের উপর:
👉 আপনি দিনে কত ক্যালরি গ্রহণ করছেন
👉 আপনি দিনে কত ক্যালরি ব্যয় করছেন
যদি প্রতিদিন গ্রহণ করা ক্যালরি, ব্যয়ের তুলনায় বেশি হয়, তবে সেই অতিরিক্ত ক্যালরি শরীরে চর্বি হিসেবে জমা হতে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওজন বাড়তে থাকে।
তবে বিষয়টা এত সরল নয়। ওজন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে আরও অনেক কিছু—
🔸 জিনগত বৈশিষ্ট্য
🔸 হরমোনের ভারসাম্যহীনতা
🔸 নিউরোট্রান্সমিটার ও মানসিক অবস্থা
🔸 বংশগত মোটা হওয়া
🔸 হাইপোথাইরয়েডিজম, পিসিওএস, কর্টিসোল হরমোনের আধিক্য
🔸 ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (যেমন: স্টেরয়েড, ইনসুলিন, কিছু মানসিক রোগের ওষুধ)
🔸 ফুড ক্রেভিং, ইমোশনাল ইটিং বা ফুড অ্যাডিকশন
মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে থাকা হাঙ্গার ও স্যাটাইটি (তৃপ্তি) সেন্টার এবং হরমোন (লেপটিন, গ্রেলিন, ইনসুলিন ইত্যাদি) নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষুধা, খাওয়া এবং ওজন।
তবে সবকিছুর পরেও, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও কায়িক শ্রমের অভাবই ওজন বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় কারণ।
আপনি স্থূল কিনা বুঝবেন কীভাবে?
📌 বডি মাস ইনডেক্স (BMI) = ওজন (কেজি) ÷ উচ্চতার বর্গ (মিটার)
👉 BMI ২৩-এর বেশি = ওজনাধিক্য
👉 BMI ২৫-এর বেশি = স্থূলতা
👉 BMI ৩০-এর বেশি = মাত্রাতিরিক্ত স্থূলতা (মরবিড ওবেসিটি)
📌 পেটের মাপ:
– নারীদের ক্ষেত্রে: ৮০ সেন্টিমিটারের বেশি
– পুরুষদের ক্ষেত্রে: ৯০ সেন্টিমিটারের বেশি
👉 এগুলোর বেশি হলে তা ভিসারাল ফ্যাট বা বিপজ্জনক চর্বি জমার ইঙ্গিত দেয়।
ওজন বৃদ্ধির ঝুঁকি
জাতীয় স্বাস্থ্য জরিপ (BDHS ২০১৭-১৮) অনুযায়ী—
🔹 ১৫-৪৯ বছর বয়সী নারীদের ৩২%
🔹 প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের ১৮%
ওজনাধিক্য বা স্থূলতায় ভুগছেন।
👉 এর ফলে বাড়ে:
ডায়াবেটিস
উচ্চ রক্তচাপ
হৃদ্রোগ
স্ট্রোক
স্লিপ অ্যাপনিয়া
ফ্যাটি লিভার
বন্ধ্যত্ব
এমনকি কিছু ক্যানসারের ঝুঁকি পর্যন্ত
পাশাপাশি মানসিক অশান্তি, বিষণ্নতা ও আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
🤔 কীভাবে ওজন কমাবেন?
ওজন কমানো মানে শুধু ডায়েট নয়—এটি একটি সুপরিকল্পিত জীবনধারা পরিবর্তন। নিচের চারটি ধাপে কাজ করতে হবে:
১. 🥗 সুষম খাদ্যাভ্যাস
- দৈনিক খাবার থেকে ৫০০ ক্যালরি কমালে ২ সপ্তাহে প্রায় ১ কেজি ওজন কমানো সম্ভব।
- খাবারে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও ফ্যাটের সঠিক অনুপাত বজায় রাখা জরুরি।
- সহজ শর্করা (সাদা ভাত, ময়দা, চিনি) বাদ দিয়ে জটিল শর্করা (লাল চাল, ওটস) বেছে নিন।
- প্রোটিন নিন মাছ, ডিম, দুধ, ডাল থেকে।
- চর্বি হোক বাদাম বা মাছের তেলজাতীয় অসম্পৃক্ত ফ্যাট।
- বাদ দিন ট্রান্সফ্যাট (ফাস্টফুড, ফ্রাই, কেক)।
- প্রচুর শাকসবজি ও আঁশযুক্ত খাবার খান।
✅ সবচেয়ে নিরাপদ ও টেকসই পদ্ধতি: ব্যালান্সড ডায়েট
২. 🏃 ব্যায়াম ও শারীরিক পরিশ্রম
- সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি অ্যারোবিক ব্যায়াম (প্রতিদিন ৩০ মিনিট)
যেমন: হাঁটা, সাঁতার, সাইক্লিং
- উচ্চমাত্রার হলে সপ্তাহে ৭৫ মিনিট যথেষ্ট
-দৈনিক ১০,০০০ পদক্ষেপ লক্ষ্যে রাখুন
- সচল থাকুন—লিফট নয়, সিঁড়ি; গাড়ি নয়, হাঁটা
৩. 😴 ঘুম ও স্ক্রিন টাইম
- প্রতিদিন অন্তত ৭ ঘণ্টা গভীর ঘুম প্রয়োজন
- ঘুম কম বা বেশি—উভয়ই ওজন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে
- স্ক্রিন টাইম দিনে ২ ঘণ্টার বেশি নয়
- নিয়মিত বিরতি নিয়ে কাজ করুন, মাঝে হাঁটাহাঁটি করুন
৪. 💊 ওষুধ প্রয়োগ (প্রয়োজনে)
- BMI ৩০ বা তার বেশি হলে, অথবা
- BMI ২৫-২৯.৯ এবং ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ফ্যাটি লিভার ইত্যাদি থাকলে
→ ওবেসিটি ম্যানেজমেন্টের জন্য ওষুধ ব্যবহার করা যায়
❗ তবে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে
অনেকে আধুনিক ওষুধ ব্যবহার করে ৬ মাসে ৫–২০% পর্যন্ত ওজন কমাতে সক্ষম হয়েছেন।
✅ ওজন কমানোর লক্ষ্য
ওজন ৫-১০% কমলেই ডায়াবেটিস, প্রেসার ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে আসে
১০-১৫% কমলে ফ্যাটি লিভার, বন্ধ্যত্ব, স্লিপ অ্যাপনিয়া উন্নতি হয়
⚠️ ওজন কমানো নিয়ে প্রচলিত ভ্রান্তি
🚫 শুধু স্লিমিং টি, আপেল সিডার ভিনেগার, বা বিশেষ কিছু খেয়ে ওজন কমানো যায় না
🚫 না খেয়ে ওজন কমানো অস্বাস্থ্যকর
🚫 এক–দুই দিন বেশি খেলে সারা সপ্তাহের ডায়েট বৃথা যেতে পারে
🚫 চটজলদি ওজন কমানোর চেষ্টা বিপজ্জনক—ধীরে ধীরে কমান
✅ প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাস ও শারীরিক সচেতনতাই ওজন কমানোর মূল চাবিকাঠি
✅ ওজন কমানোর পর সেটি ধরে রাখাও গুরুত্বপূর্ণ
✅ এটি আপনার লাইফস্টাইলের অংশ হতে হবে, ‘ডায়েট’ নামক এককালীন প্রচেষ্টা নয়
শেষ কথা:
ওজন কমানো মানে শুধুই চেহারা পরিবর্তন নয়, এটি আপনার পুরো জীবনের মান উন্নয়নের একটি ধাপ। স্বাস্থ্যকর জীবনধারা, সচেতনতা, ধৈর্য আর পরিকল্পনা—এই চারটি জিনিস থাকলেই আপনি পারবেন।