24/03/2025
তামিম ইকবালকে ২২ মিনিট CPR দেওয়া হয়, ৩ বার DC শক দেওয়া হয়—তারপর তিনি আল্লাহর ইচ্ছায় ফিরে আসেন। এই খবরটা পড়ে এক সপ্তাহ আগে মারা যাওয়া আমার ওয়ার্ডের খালার কথা মনে পড়ে গেল, যাকে একটানা ১ ঘণ্টা CPR দেওয়ার পরও ফিরিয়ে আনা যায়নি।
কেন ফিরিয়ে আনা যায়নি জানেন? ভেবেছিলাম, এই গল্পটা কখনোই লিখব না। সবাই CPR দিয়ে বেঁচে যাওয়া রোগীদের গল্প শুনতেই পছন্দ করেন, কিন্তু CPR দেওয়ার পরও যারা ফেরে না, সেই কষ্টের গল্পগুলো কেউ শুনতে চায় না।
গল্পটা আসিয়া খালার।
আমার মেডিসিন ওয়ার্ডে কাজ করতেন। ইন্টার্নশিপের প্রথম দিন যিনি আমার হাত ধরে ক্যাথেটার করানো শিখিয়েছিলেন। আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ মানুষ, সকাল থেকে কাজ করছিলেন। হঠাৎ ১১টার দিকে ওয়ার্ডে সবার সামনে পড়ে গেলেন। অ্যাসপিরিন, অক্সিজেন, প্রাথমিক চিকিৎসা—সব কিছু করেও তার জ্ঞান ফেরানো গেল না। তার আগেও হার্ট অ্যাটাকের হিস্ট্রি ছিল।
আমরা বোঝানোর চেষ্টা করলাম, মেডিসিন ওয়ার্ডে তার চিকিৎসা সম্ভব নয়, তাকে CCU-তে নিতে হবে। কিন্তু সরকারি CCU-তে কোনো বেড খালি নেই, আর প্রাইভেট CCU-তে যাওয়ার সামর্থ্য তার নেই।
বিকেল ৩টার দিকে তার খিঁচুনি শুরু হলো। আমি একা কয়েকজন নার্স ও খালাদের সহায়তায় ৬ তলা থেকে ২ তলায়, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ICU-তে নিয়ে গেলাম। CPR দিতে দিতেই পৌঁছলাম। কিন্তু ICU-তে একটাও খালি বেড নেই।
২০টা ICU বেড, ২০টাই আসিয়া খালাদের মতো মরনাপন্ন রোগীদের কাছে। কাউকে সরিয়ে দেওয়ার সুযোগও নেই। আমি পাগলের মতো CPR দিতে থাকলাম। আমি আর একজন সিনিয়র নার্স মিলে একটানা ১ ঘণ্টা CPR দিলাম, মাঝে মাঝে AMBU ব্যাগ দিয়ে অক্সিজেন দিলাম। মনিটরে দেখলাম হার্টরেট বাড়ছে, অক্সিজেন স্যাচুরেশনও বাড়ছে, কিন্তু পালস পাওয়া যাচ্ছে না। তার জরুরি ইন্টুবেশন দরকার ছিল, কিন্তু কোনো সিনিয়র ডাক্তার ছিলেন না। ICU-তে থাকা দুইজন ডাক্তার তখন অন্য দুইজন মরনাপন্ন রোগীকে বাঁচাতে ব্যস্ত। DC শকের ব্যবস্থাও ICU-তে নেই। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু করলাম, কিন্তু আসিয়া খালাদের মতো মানুষেরা ১ ঘণ্টা CPR দেওয়ার পরও বেঁচে ফেরে না কেননা অন্য কোথাও তাদের আর নেওয়ার সুযোগও নেই।
সবাই তামিম ইকবালের গল্প শুনতে চায়, কারণ সেখানে ২২ মিনিটের CPR, ৩ বার DC শক, PCI (Coronary Intervention) করার সুযোগ ছিল। কারণ আমাদের এই দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ সুফল পরে ভাগ্যবান কিছু মানুষের জন্য, যারা চাইলে CCU পায়, Coronary Intervention পায়।
কিন্তু এই দেশ আসিয়া খালাদের জন্য নয়। যারা হাসপাতালের কর্মচারী হয়েও ICU পায় না, CCU তো অলীক কল্পনা। শুধু একটা সরকারি হাসপাতালে চাকরি করার সুবাদে তার ECG করা গিয়েছিল, অন্য কোনো সাধারণ রোগীর মতো ECG করানোর জন্য ১-২ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়নি। আমরা জানতাম কী করতে হবে, কিন্তু এই দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার আশীর্বাদ আসিয়া খালাদের স্পর্শ করে না। কারণ প্রাইভেটের একখানা খালি CCU বেডের মূল্য তাদের জীবনের চেয়ে অনেক বেশি।
শুধু আসিয়া খালা না, আমার হাসপাতালে অনেক রোগীই এভাবেই মারা যাবে ICU/CCU-এর অভাবে, কারণ তারা প্রাইভেটে CCU/ICU-তে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য রাখে না, আর সরকারিতে জায়গা পাওয়া যায় না।
সরকারি হাসপাতালে ১০ টাকার টিকিট কেটে ডাক্তার দেখাতে পেরে আমরা খুশি থাকি, কিন্তু কীভাবে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা, ICU/CCU সবার জন্য নিশ্চিত করা যায়, সেটা নিয়ে ভাবি না। যেন তামিম ইকবাল থেকে শুরু করে আমি, আপনি, আসিয়া খালারা এবং রাস্তায় থাকা অসহায় ভিক্ষুক পর্যন্ত মৃত্যুর আগে বলতে না পারে—"আমি ICU/CCU পাইনি!"
তামিম ইকবালের গল্প নিঃসন্দেহে আমাদের চিকিৎসকদের সাফল্য। এটি আমাদের শেখায়, সুযোগ থাকলে এই দেশের ডাক্তারদের হাতেই মানুষ নিরাপদ। কিন্তু যখন ডাক্তারদের হাতেই জীবন বাঁচানোর সরঞ্জামের অভাব থাকে, যখন চিকিৎসায় সবার সমান সুযোগ থাকে না, তখন আসিয়া খালাদের মতো মানুষের গল্পগুলো আড়ালে রয়ে যায়। আশা একটাই — যেন প্রতিটি CPR-এর গল্প হোক আজকের তামিম ইকবালের মতো সাফল্যের!