12/01/2024
জন্মদিন পালন বিষয়ে ইসলাম কী বলে?
- ত্বরিক বিন মুতালিব
আমার আশেপাশের মানুষেরা অনেকেই জন্মদিন পালন করেন। সন্তানের জন্মদিনে অনুষ্ঠান করেন, কেক কাটেন। সোশ্যাল মিডিয়াতে বন্ধুদের জন্মদিনে উইশ করেন। কেউ কেউ আবার এই দিনটাকে ইসলামিক ফ্লেভার দিতে দুআ-মোনাজাত আয়োজন করে থাকেন। তাই অনেকদিন ধরে জন্মদিন নিয়ে কিছু লিখবো ভাবছি।
প্রথমেই বলে রাখি, আমি কোনো আলেম নই। ফিকহ শাস্ত্র নিয়ে আমার খুব একটা জ্ঞান নেই। কাজেই জন্মদিন পালন করা হারাম না হালাল, এই বিষয়ে নিজে থেকে কিছু বলার সাধ্য আমার নেই। তবে আলেম সমাজের জন্মদিন বিষয়ক কিছু স্বীকৃত ফতোয়ার উল্লেখ করছি এখানে।
ফতোয়া বিষয়ক সবচেয়ে জনপ্রিয় ওয়েবসাইট IslamQA.info-তে জন্মদিন বিষয়ক এক প্রশ্নোত্তরে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে: ইবাদত হিসেবেই হোক বা প্রথা ও ঐতিহ্য হিসেবে হোক, কোনো ব্যক্তির জন্মদিন উদযাপন করা হারাম (haraam to celebrate)। এখানে, জন্মদিন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, অনুষ্ঠানের মিষ্টান্ন খাওয়া এবং উপহার নেওয়া থেকেও বিরত থাকতে বলা হয়েছে। (1)
ইসলামকিউএ বাংলা ভার্সনে বলা হয়েছে: ইসলামে যেহেতু জন্ম-মৃত্যু দিবস পালন করার অস্তিত্ব নেই সেহেতু অমুসলিমদের সাদৃশ্য অবলম্বনে জন্মদিবস পালন করার সুযোগ নাই। সুতরাং এ উপলক্ষে কাউকে উইশ করা, শুভেচ্ছা বার্তা পাঠানো, গিফট দেয়া, কেক কাটা, মোমবাতি জ্বালানো বা ফুঁ দিয়ে নিভানো, বিশেষ খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা, জন্ম দিনের পার্টি করা সবই হারাম। (2)
জন্মদিন পালনকে বিদআত বলে ফতোয়া দিয়েছেন সৌদি আরবের স্থায়ী ফতোয়া কমিটি (3), শায়েখ বিন বায রহিমাহুল্লাহ (4) ও শায়েখ উসাইমীন রহিমাহুল্লাহ (5)। এ প্রসঙ্গে শায়েখ উসাইমীন রহিমাহুল্লাহ উল্লেখ করেছেন: কোন ব্যক্তি নিজের বা সন্তানের জন্মদিন উদযাপন, বিবাহবার্ষিকী পালন বা এধরনের অনুষ্ঠান, এর কোনোটাই অনুমোদিত নয়।
এবার দেখি দারুল উলুম দেওবন্দ কী বলেন? জন্মদিন বিষয়ে দারুল ইফতা ফতোয়া দিয়েছে যে: জন্মদিন পালন করা হারাম (unlawful), এটা পাশ্চাত্যের ঐতিহ্য এবং ইসলামে এর কোন গুরুত্ব নেই। দাওয়াতকারী মুসলিম হোক বা অমুসলিম হোক, এই ধরনের ননসেন্স অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়াটাই ভুল। (6)
মাসিক আল কাউসারের প্রশ্নোত্তর পর্বে এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে বলা হয়: জন্মবার্ষিকী-মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা এবং একে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা ইসলামের শিক্ষা নয়। এগুলো বিজাতীয় সংস্কৃতি। এসকল অহেতুক কাজ থেকে মুসলমানদের বিরত থাকা আবশ্যক। (7)
শায়েখ আহমাদুল্লাহ (হাফি:) এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন: একজন মুসলমান, তিনি জন্মদিবস উদযাপন করবেন না। জন্মদিবস উদযাপন করা, এটা প্যাগানদের থেকে এসেছে। এটা ভিনধর্মী মানুষদের থেকে এসেছে। জন্মদিনকে কেন্দ্র করে যে কাজগুলো হয়ে থাকে.. মোমবাতি জ্বালানো, কেক কাটা.. এই সবগুলো হুবহু এসেছে অনেকগুলো ভ্রান্ত বিশ্বাস থেকে। (8)
আশা করি, একজন মুসলমানের সীদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য এই ফতোয়াসমূহই যথেষ্ট। তবে কারো মনে এই প্রশ্ন আসতে পারে যে, অমুক হুজুর কিংবা তমুক বিখ্যাত দাঈ বলেছেন- হারাম উপকরন বাদ দিয়ে জন্মদিন পালন করা যাবে। উনারা কী কম বোঝেন?
এক্ষেত্রে আমাদের বুঝতে হবে, জন্মদিন উদযাপন নিষিদ্ধ হওয়ার পেছনে দুটো প্রেক্ষাপট আছে:
প্রথমত, জম্মদিন উদযাপনের পদ্ধতিতে বিভিন্ন হারাম উপকরণের সংমিশ্রন, যেমন: মিউজিক, পর্দার খেলাফ, কেক কাটা, মোমবাতি প্রজ্জ্বলন ইত্যাদি।
দ্বিতীয়ত, জম্মদিন উদযাপনের সাথে ভিন্ন ধর্মের যোগসূত্র, যেমন: স্যাটানিক রিচুয়াল বা প্যাগান ধর্মে জম্মদিন উদযাপন করার প্রাচীন প্রথা।
যারা জন্মদিন পালনকে শর্ত সাপেক্ষে জায়েজ বলতে চান, তারা শুধু প্রথম পয়েন্টে মনোনিবেশ করেছেন বলে ধারনা করি। দ্বিতীয় পয়েন্টটি সম্পর্কে ধারণা থাকলে তারা কখনোই এটার পক্ষে মত দিতেন না বলে আমার বিশ্বাস (আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন ভালো জানেন)।
আর যে বিষয়ে দেওবন্দ মাদ্রাসা, সৌদি স্থায়ী ফতোয়া কমিটি, বিন বায (র:), উসাইমীন (র:), আবদুল মালেক (হাফি:), আহমাদুল্লাহ (হাফি:) এবং ইসলামকিউএ সুস্পষ্ট ফতোয়া দিয়েছেন, সে বিষয় পরিহার করতে অজুহাত খোঁজার কোনো কারণ আছে কী?
শেষের আগে, জন্মদিন উদযাপনের সাথে অন্যান্য ধর্মের সংযোগ নিয়ে কিছু আলোকপাত করছি:
ফেরাউন বেশ ঘটা করে জন্মদিন পালন করতো এবং এর সঙ্গে ঐশ্বরিক ক্ষমতা প্রাপ্তির একটা যোগসূত্র আরোপ করতো। ফেরাউনের জন্মদিন পালনের উল্লেখ রয়েছে ওল্ড টেস্টামেন্টে: তৃতীয় দিনটি ছিল ফেরাউনের জন্মদিন। ফেরাউন তার সব কর্মকর্তাদের জন্য ভোজের আয়োজন করে। ফেরাউন তার মদ-পরিবেশক ও রুটি প্রস্তুতকারককে ক্ষমা করে। (9) জন্মদিন পালনের রিচুয়াল ফেরাউনের উদ্ভাবন কিনা, সেটা জানা না গেলেও সে যে খুব গুরুত্বের সাথে জন্মদিন পালন করতো এবং এটাকে তার প্রভুত্ব দাবীর সাথে একীভূত করেছিল, তা মোটামুটি নিশ্চিত।
আরো ভয়ঙ্কর বিষয় হল, জম্মদিন উৎসব শয়তানের ধর্মের সাথে সরাসরি জড়িত। লুসিফার নামক শয়তানের পূজার ধর্মকে Satanic Religion বলা হয়। শয়তানের চার্চের প্রতিষ্ঠাতা এন্টন লেভি Satanic Bible-এ লিখেছে: শয়তানের ধর্মে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হল নিজের জন্মদিন পালন। (10)
প্রাচীন গ্রীক পৌত্তলিকরা বিশ্বাস করতো জন্মদিনে মানুষের উপর খারাপ আত্মা ভর করে। এর থেকে পরিত্রান পেতে তারা চাঁদের আদলে গোলাকার কেক বানাতো এবং ছুরি দিয়ে কাটার মাধ্যমে চন্দ্রদেবী আর্তেমিসকে উৎসর্গ করতো। অর্থাৎ জন্মদিনে কেক কাটার আনুষ্ঠানিকতা মূলত একটি পূজা থেকে এসেছে, আর কেক হল এক্ষেত্রে পূজার প্রসাদ যা চন্দ্রদেবীকে উৎসর্গ করা হয় খারাপ আত্মা থেকে নিরাপত্তা পেতে। মোমবাতি জ্বালানো হয়, কারণ ধারণা করা হতো যে, এই উজ্জ্বলতা সব অশুভ অন্ধকারকে দূর করে দেবে! এসময় গ্রীকরা মৃত আত্না ও দেবতাদের উদ্দেশ্যে উইশ করতো। তারপর ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নেভাতো, যাতে ফুঁ-এর ধোঁয়া আকাশের দেবতার কাছে তাদের উইশ পৌঁছে দিতে পারে। কেক কাটার সময় জন্মদিনের ব্যক্তিকে সবাই ঘিরে রাখতো, যাতে শয়তান তার উপর ভর করে ক্ষতি করতে না পারে। উপরন্তু সবাই মিলে (হাততালি দিয়ে) হট্টগোল করতো, যাতে ভয় পেয়ে শয়তান চলে যায়। (11)
একটু ভেবে দেখুন প্রিয় ভাই, জন্মদিন উদযাপনের নামে যা করছেন, সেটা পূজা অর্চনা ছাড়া আর কি? পূজাকে পূজা মনে না করে করলেও তা হারাম, এ ব্যপারে কোন মতভেদ নেই। তাই একজন মুসলমান হিসেবে জন্মদিন পালন করা উচিৎ কিনা.. নিজেকে প্রশ্ন করুন।
[ফুটনোট:
১. জন্মদিন বলতে এখানে জন্মবার্ষিকী বোঝানো হয়েছে। রাসূল (সাঃ) উনার জন্মবার তথা প্রতি সোমবারে সাওম পালন করতেন, সেজন্য কেউ যদি নিজ সাপ্তাহিক জন্মবারে বা সোমবারে সাওম পালন করেন, সুন্নাহ্ হিসেবে সেটা তিনি করতেই পারেন। জন্মবারের সাথে জন্মদিন উদযাপনকে মেলাতে যাবেন না। দুটো এক নয়।
২. রেফারেন্স লিংক কমেন্টে দেওয়া আছে। বিস্তারিত জানার জন্য রেফারেন্সগুলো দেখতে পারেন।]