10/07/2024
আল্লাহ তো শিরক ব্যতীত সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন বলেছেন। তাহলে, এই যে এতোসব চোর বাটপারেরা মানুষের এতো এতো টাকা লোপাট করছে, চুরি করে নিজেদের সাম্রাজ্য গড়ে তুলছে, স্রেফ তাওবা করলেই কি আল্লাহ এদেরকেও ক্ষমা করে দেবেন?
শিরক ব্যতীত অন্য সকল গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন এই কথা সত্য। তবে, তার আগে আমাদের জানতে হবে ‘হক’ তথা ‘অধিকার’ কতো প্রকার ও কী কী।
ইসলামে দুই ধরণের হকের কথা বলা হয়েছে। প্রথমটা হাক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হক। যেমন—কোনো প্রকার শিরকের সংস্রব ব্যতীত আল্লাহর ওপর বিশুদ্ধ ঈমান রাখা, সালাত আদায় করা, সিয়াম রাখা, যাকাত প্রদান করা ইত্যাদি। মোদ্দাকথা—ব্যক্তিক আমলের সাথে সংশ্লিষ্ট সবগুলোই আল্লাহর হকের সাথে সম্পর্কিত।
এখন কেউ যদি নিয়মিত সালাত আদায় না করে, যাকাত প্রদানে গড়মিল করে, কেউ যদি যথাযথ কারণ ছাড়া সিয়াম ছেড়ে দেয় এবং তা পুরা না করে—এই সমস্ত কাজে আল্লাহর হক লঙ্গিত হয়। তো, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যেহেতু মেহেরবান, পরম করুণাময় এবং অসীম দয়ালু, ইচ্ছা হলে তিনি তাঁর এইসব কম আমলি বান্দা বা আমল পরিত্যাগকারী বান্দাদেরকে মাফ করে দিতে পারেন যদি তারা আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক না করা অবস্থায় মারা যায়।
দ্বিতীয় যে প্রকার হকের কথা ইসলাম বলে সেটা হলো হাক্কুল ইবাদ তথা বান্দার হক। বান্দার হক সম্পূর্ণরূপে বান্দার সাথে সম্পর্কিত। যেমন—লোক ঠকানো, মানুষের ওপর যুলুম করা, কারো সম্পত্তি জবরদখল করা, কাউকে হ/ত্যা করা, অন্যায়ভাবে কাউকে দমিয়ে রাখা সহ যতো প্রকারে মানুষকে বিপর্যস্ত করা যায় তার সবটাই হাক্কুল ইবাদ তথা বান্দার হকের সাথে সম্পর্কিত।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা নিজের হকের ব্যাপারে ছাড় দিয়ে, আমল পরিত্যাগকারীকে ক্ষমা করে দিলেও, যে লোক বান্দার হক নয়ছয় করে, যে লোক দুনিয়ায় মানুষের দূর্ভোগের কারণ হয়, তাকে ততোক্ষণ ক্ষমা করবেন না যতোক্ষণ না ওই বান্দা তাকে ক্ষমা না করছে। অর্থাৎ, যার ওপর যুলুম করা হয়, যাকে ঠকানো হয়, যার সম্পত্তি জবরদখল করা হয়, যাকে হ/ত্যা করা হয়, সে যদি উক্ত লোককে ক্ষমা না করে, আল্লাহও তাকে ক্ষমা করবেন না।
আল্লাহর রাস্তায় শহিদ হওয়ার চাইতে বড় মর্যাদার বিষয় আর কিছু নেই। সহিহ মুসলিমের একটা হাদিসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘ঋণ ব্যতীত শহিদদের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়’। (১) ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেছেন—এখানে ঋণ বলতে বান্দার যাবতীয় হক তথা অধিকারের বিষয়েই বলা হয়েছে।
আল্লাহর রাস্তায় যারা শহিদ হয় তাদের মর্যাদা যে কতো তা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। আল্লাহর রাসূল বলেছেন—কেউ যদি কোনো বান্দার হক বিনষ্ট করে আল্লাহর রাস্তায় শহিদও হয়, তার সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হলেও, বান্দার হকের বিষয়টা ক্ষমা করা হয় না। শহিদদের বিষয়টাই যদি এমন হয়, সেখানে এইসব চোর বাটপারেরা কোন ছাড়?
এই যে চোর বাটপারেরা আমাদের এতো এতো টাকা লোপাট করে বড়লোক হয়, সাম্রাজ্য গড়ে তুলে, এরা কেউ তো আমাদের ক্ষমা পায় না। একদিন তারা মরেও যায়। এদের সাথে আখিরাতে আল্লাহ কীরকম আচরণ করবে, তাই তো?
নিম্নোক্ত হাদিসে সেটার উত্তর মিলতে পারে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে নিঃস্ব ওই ব্যক্তি যে দুনিয়া থেকে সালাত, সিয়াম, যাকাত ইত্যাদি আদায় করে আসবে, তার সাথে ওই লোকেরাও আসবে যাদের কাউকে সে (দুনিয়ার জীবনে) গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, কারো সম্পদ কুক্ষিগত করেছে, কাউকে হ/ত্যা করেছে বা প্রহার করেছে। তখন ওই সকল পাওনাদারকে উক্ত ব্যক্তির নেকী থেকে পরিশোধ করে দেওয়া হবে। এভাবে পরিশোধ করতে করতে যখন তার সকল আমল শেষ হয়ে যায়, তখন পাওনাদারের গুনাহগুলো এনে তার ওপর চাপানো হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (২)
অর্থাৎ, আজকে যারা মানুষের সম্পদ জবরদখল করছে, যারা অন্যায়ভাবে মানুষকে হেনস্থা করছে, বিপদে ফেলছে, অত্যাচার নির্যাতন করছে, মানুষকে বিনা অপরাধে শাস্তি দিচ্ছে, অপবাদ দিচ্ছে, মানুষের টাকা মেরে খাচ্ছে এবং একইসাথে তারা প্রতিবছর হজ্ব করছে, বছরে তিন-চারটা উমরাহ করছে, সালাত পড়তে পড়তে কপালে দাগ ফেলে দিচ্ছে, বাজারের সবচেয়ে বড় গরু দিয়ে কুরবানি দিচ্ছে, এলাকায় গড়ে তুলছে বিশাল বিশাল মসজিদ, মাদ্রাসা এতিমখানায় দান করছে কাড়ি কাড়ি টাকা, কিয়ামতের মাঠে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এই কাজগুলোর সওয়াব তাকে দেওয়ার বদলে সেই সমস্ত মানুষের আমলনামাতে তুলে দিবেন যাদের হক দুনিয়ায় সে লঙ্গন করেছে।
এভাবে দিতে দিতে দেখা যাবে তার আমলের সমস্ত সওয়াব ফুরিয়ে গেছে, পাওনাদেরকে দেওয়ার মতো আর কিছু নেই। তখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা পাওনাদার, অর্থাৎ যাদের সাথে সে অন্যায় করেছে তাদের গুনাহগুলো এনে তার আমলনামায় তুলে দিবেন। তারপর তার পাপের বোঝা পূর্ণ করে তাকে নিক্ষিপ্ত করবেন লেলিহান আগুনের জাহান্নামে।
মানুষের হক বিনষ্ট করে যারা খুব দানবীর সাজে সমাজে, যারা সমুদ্রের পাড়ে তোশক বিছিয়ে, গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে কপাল ঠেঁকিয়ে সালাত আদায় করে, বড় গরু দিয়ে কুরবানি করে, বাইতুল্লাহর গিলাফ ধরে ছবি তুলে দুনিয়াকে জানান দেন যে তারা খুব ওলি-আউলিয়া হয়ে গেছেন, তাদের জন্য এই হাদিসটা অশনিসংকেত। সুতরাং, সাধু সাবধান।
রেফারেন্স:
(১) সহিহ মুসলিম, হাদিস ১৮৮৬
(২) সহিহ মুসলিম, হাদিস ২৫৮১
-
কপি: আরিফ আজাদ