11/02/2021
শিশুদের ডায়রিয়া বা পেটের অসুখ:
**ডায়রিয়া, বা উদরাময়, বা পেটের অসুখ হয়না এ রকম শিশু বিরল। আমাদের দেশের ভূ-প্রাকৃতিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং আমাদের সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতার ঘাটতি এ গুলোর মূল কারণ। আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের ফলে পূর্বের তুলনায় শিশুদের ডায়রিয়ার হার অনেক কমে গেলেও এখনো অনূর্ধ-৫ বছর বয়সীদের মধ্যে ডায়রিয়া অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রোগ হিসেবে বিদ্যমান। শিশুদের ডায়রিয়ার প্রধান কারণগুলি নিম্নরূপঃ
১। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব
২। ‘বাহিরের’ জিনিস খাওয়ানোর অভ্যাস- বর্তমানে মানুষের মধ্যে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছে, ফলে ঘরের জিনিস খেয়ে ডায়রিয়া হবার সম্ভাবনা খুবই কম। নলকূপের পানি খেলে ও ব্যবহার করলে ডায়রিয়া হবার ঝুঁকি নেই বললেই চলে। কিন্তু অসাধু ও অসচেতন ব্যবসায়ীরা যেসব মুখরোচক ও আকর্ষনীয় খাবার তৈরী ও বিপণন করে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যবিধি ও পরিচ্ছন্নতার নিয়ম মানা হয়না। ফলে এ ধরণের খাবার খেয়ে শিশুরা সহজেই পেটের অসুখে আক্রান্ত হয়।
অনেক অভিভাবক শিশুদের খুশী করার জন্য রেডিমেইড খাবার যেমন- চিপস, চকোলেট, আচার, জুস, চানাচুর, লাসসি ইত্যাদি দোকান থেকে কিনে দেন। এগুলি খেয়ে প্রায়ই শিশুদের খাবারের অরূচি, বদহজম, বমি, পাতলা পায়খানা ইত্যাদি অসুখ দেখা দেয়।
আবার সবসময় এসব খেলেই যে প্রতিবার অসুখ হবে, ব্যাপারটা তাও নয়। তবে যে কোন সময় হতে পারে।
আবার অনেক অভিভাবক আছেন মোটামুটি সচেতন। তাঁরা সাধারণতঃ বাহিরের জিনিস দেননা। কিন্তু দেখা যায় বাচ্চাকে বিভিন্নজন- বড়, ছোট অনেকেই আদর করে কোলে নেন; এদিক সেদিক নিয়ে যান এবং টুকিটাকি এটা সেটা আদর করে খেতে দেন। অনেক সময় বাচ্চা নিজেই অন্যের হাতে দেখে বায়না ধরে, ফলে ঘরের বাইরের আদরকারীরা টুকিটাকি কিছু একটা মুখে দিয়ে দেন। ঘরে ফিরার পর মা বা অভিভাবক টেরই পাননা। ফলে দেখা যায় হঠাৎ হঠাৎ বাচ্চা পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়।
৩। আলগা দুধ বা কৌটার দুধঃ
যে কোন ফরমুলা দুধ বা গরুর দুধ খেলে পেটের অসুখ হতে পারে। এটা মূলতঃ ওই দুধের এমন কোন গঠনগত বস্তু যা হয়ত ওই শিশুর পেটে হজমের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। বিশেষ করে যখন কোন দুধ নতুন দেয়া হয়, তখন ওই দুধ কোনো কোনো শিশুর পেটে মানিয়ে নিতে সাময়িক অসুবিধা হতে পারে। কিছুদিন খাওয়ানোর পর ধীরে ধীরে মানিয়ে যায়। তবে অনেকের পেটে কখনোই তা মানিয়ে নিতে পারেনা। সে ক্ষেত্রে ওই দুধ না খাওয়ানোই ভালো।
৪।বোতলের দুধঃ
যে সব শিশুকে ফিডার বোতল দ্বারা দুধ খাওয়ানো হয় তাদের মাঝে মাঝেই পেটের অসুখ হয়। এটা মূলতঃ দুধের দোষ নয়, বরং ঠিকমত বোতল ও বাঁট বা নিপল জীবাণুমুক্ত না করার কারণে হয়। ঠাণ্ডা বা সাধারণ গরম পানি দিয়ে ধুলেই বোতল বা বাঁট জীবাণুমুক্ত হয়না, বড়জোর পরিষ্কার হয়। আমাদের অনেকের কাছে মনে হয়, দেখতে সাদা বা পরিষ্কার মনে হলেই হলো। প্রতিবার দুধ খাওয়ানোর পর বোতল ও বাঁটের ভাঁজে যদি দুধের কিছু ‘ছানা’ বা ‘কণা’ থেকে যায়, তখন সেখানে ধীরে ধীরে জীবাণু জমতে থাকে যা খালি চোখে দেখা যায়না। এভাবে যত পুরাতন হতে থাকবে, অদৃশ্য জীবাণু ধীরে ধীরে শক্তিশালী হতে থাকবে, তারপর কোন একসময় হঠাৎ করে শিশু পেটের অসুখে আক্রান্ত হয়।
আবার অনেক সময় দেখা যায় বাচ্চা একবারে বোতলের পুরা দুধ খেয়ে শেষ করতে পারেনা। এ ক্ষেত্রে অনেকে মনে করেন, আচ্ছা একটু পরে হয়ত খাবে; এই আশায় রেখে দেন। কিছু পরে হয়ত খাওয়ান, অথবা দেরী করে ওই দুধ বা মিশিয়ে নতুন দুধসহ খাওয়ান। এর মধ্যে কোনো কোনো বার হয়ত জীবাণু সংক্রমণ হয়ে যায়।
এক বারের দুধ কোনো অবস্থাতেই দ্বীতিয় বার খাওয়ানো উচিৎ নয়। না খেলে ওই দুধ সাথে সাথে ফেলে দিতে হবে।
ফিডারের বাঁট বা বোতল দেখতে যত পরিষ্কারই মনে হউকনা কেন, প্রতিবার দুধ খাওয়নোর পর সাথে সাথে তা হালকা গরম পানি বা নরমাল পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। এতে বোতল-বাঁট আপাততঃ পরিষ্কার হয়ে যাবে, বাড়তি গন্ধ বা জীবাণু জন্মাতে পারবেনা; তবে তা জীবাণুমুক্ত বা পরিপূর্ণ নিরাপদ নয়। এমতাবস্থায় একে জীবাণুমুক্ত করার জন্য পরবর্তীবার খাওয়ানোর আগে অবশ্যই গরম পানিতে ফুটিয়ে সিদ্ধ করতে হবে কমপক্ষে ১০ মিনিট ধরে। এ রকম সিদ্ধ করলে বোতল বা বাঁটের কোন ক্ষতি হবার সম্ভাবনা নাই। তবে এতে যদি বোতল বা বাঁটের কোনো ক্ষতি হয়, ধরে নিতে হবে ওই বোতল বা বাঁটের মান ভালো নয়, তা বদলিয়ে নেয়াই উত্তম।
৫। প্রিমেচিউর উয়িনিংঃ
সময়ের আগে যদি বাড়তি খাবার শুরু করা হয়, তাহলেও শিশুদের পেটের অসুখ হতে পারে। ৬ মাস বয়স পর্যন্ত শিশুদেরকে শুধুমাত্র বুকের দুধই দিতে হবে, অথবা একান্ত বাধগ্যগত হয়ে যদি অন্য দুধ দিতেও হয় তাহলে শুধু দুধই দিতে হবে, অন্য কিছু নয়। তবে এ সময় যদি কেউ দুধের সাথে মিক্স করে বা আলাদাভাবে সাগু, সুজি, চাউলের গুঁড়া, সেরিলাক ইত্যাদি খাওয়ানো শুরু করেন তাহলেও শিশু বদহজম বা পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হতে পারে।
৬। হাম বা অন্যান্য রোগের সাথেঃ
শিশুদের হাম রোগ হলে অন্ত্রের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, ফলে সহজেই বাচ্চা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। অপুষ্টি আক্রান্ত বাচ্চারাও ঘন ঘন পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়, ফলে তা অপুষ্টিকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
ক্রমশঃ......