18/06/2023
[ঘটনাঃ চার] “শয়তানের নাতির ইসলাম গ্রহণের ঘটনা”
হযরত উমর (রা) এর বর্ণনাঃ
আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে ‘তিহামা’-র পাহাড়গুলোর মধ্যে একটি পাহাড়ে বসেছিলাম। এমন সময় হাতে লাঠি নিয়ে এক বৃদ্ধ আমাদের সামনে উপস্থিত হয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে সালাম দিলেন। তিনি সালামের জবাব দিয়ে তার ভাষাতেই তাকে (ইবলিশের নাতিকে) জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কে?”
সে বলল, “আমি হামাহ্ বিন হাইম বিন লাকীস বিন ইবলিশ।”
নবীজী বললেন, “তাহলে তোমার আর ইবলিশের মাঝে মাত্র দুই পুরুষের ব্যবধান। আচ্ছা, তুমি কত যুগ পার করেছ?”
সে বলল, “আমি দুনিয়ার আয়ু শেষ করে ফেলেছি। কেবল সামান্য কিছু বাকি আছে। কাবীল যখন হাবিলকে কতল (হত্যা) করেছিল সে সময় আমি ছিলাম মাত্র কয়েক বছরের শিশু; কথা বুঝতে পারতাম, ছোট ছোট পাহাড়ে বা টিলায় লাফালাফি করতাম, খাবার নষ্ট করে দিতাম, আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট করার হুকুম দিতাম...।”
তখন রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম বলেন, “বিচ্ছেদ সৃষ্টকারী বৃদ্ধ এবং অলসতা সৃষ্টকারী যুবকের কাজ বড়ই জঘন্য।”
সে আগুন্তক বৃদ্ধ তখন বলে উঠল, “আমাকে এ বিষয়ে ক্ষমা করুন। আমি আল্লাহর কাছে তওবা করেছি। আমি হযরত নূহ্ (আ)-এর সাথে তিনার মসজিদে সেসব লোকের সাথে ছিলাম যারা তার সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে তার প্রতি ঈমাণ এনেছিল। আমি সব সময় হযরত নূহ (আঃ)-কে নিজ সম্প্রদায়কে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য তিরস্কার করতাম। শেষ পর্যন্ত তিনি কেঁদে দেন এবং আমাকেও কাঁদান। তিনি বলেছিলেন- আমি যদি তোমার কথা শুনে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া ছেড়ে দেই, তাহলে অপমানিত অবস্থায় পতিত লোকদের শামিল হওয়া থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাই।”
আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “হে নূহ্ (আঃ) আমি হলাম তাদের একজন, যারা কাবীল বিন আদম কর্তৃক ভাগ্যবান শহীদ হাবীলের হত্যাকাণ্ডে অন্তর্ভুক্ত ছিল। আপনি কি মনে করেন আল্লাহ‘র দরবারে আমার তওবা কবুল হবে?”
তিনি বললেন, “হে হামাহ্, সওয়াবের ইচ্ছা কর এবং দুঃখ-অনুতাপে ভেঙে পড়ার আগে সৎকাজে লেগে পড়। আল্লাহ তায়ালা আমার উপর যা নাজিল করেছেন তাতে আমি পড়েছি, যে ব্যক্তি পরিপূর্ণ দ্বীনদারীর সাথে আল্লাহ্‘র পথে ফিরে আসে অর্থাৎ তওবা করে, আল্লাহ্ তা‘য়ালা তার তাওবা কবুল করেন। ওঠ, ওযূ করে দু’রাকাত নামায পড়।”
কাজেই তখনই আমি হযরত নূহ্ (আঃ)-এর নির্দেশ অনুযায়ী আমল করা আরম্ভ করি। এরপর তিনি আমাকে ডেকে বললেন, “মাথা তোল, তোমার তওবা কবুল হওয়ার খবর আসমান থেকে নাজিল হয়েছে।”
“তাই আমি আল্লাহ‘র ওয়াস্তে এক বছর ধরে সিজদায় পড়ে থাকলাম। আমি হযরত হুদ (আঃ)-এর সাথেও সিজদায় শরীক ছিলাম, যখন তিনি নিজ কওমকে সাথে নিয়ে সিজদা করেছিলেন। তাকে আমি তার অজ্ঞ সম্প্রদায়কে বারবার দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার কারণে তিরস্কার করতাম। শেষ পর্যন্ত নিজ কওমের কথা ভেবে তিনিও কাঁদেন এবং আমাকেও কাঁদান।
আমি হযরত ইয়াকূব (আঃ)-এর সাথেও দেখা করতাম এবং হযরত ইউসূফ (আঃ)-এর মজলিশে বিশ্বস্ততার পদে আসীন ছিলাম।
হযরত ইলিয়াস (আঃ)-এর সাথে উপত্যকায় দেখা করতাম এবং এখনও তার সাথে দেখা করি।
আমি হযরত মূসা (আঃ)-এর সাথেও সাক্ষাৎ করেছি, তিনি আমাকে ‘তাওরাত’[৩] শিখিয়ে বলেছিলেন যদি হযরত ঈসা (আঃ)-এর সাথে তোমার সাক্ষাৎ হয়, তাহলে তাঁকে আমার সালাম বলবে। আমি হযরত ঈসা (আঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেছি এবং হযরত মূসা (আঃ)-এর সালামও তাঁকে জানিয়েছি।”
এসব কথা শুনে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) অশ্রুসিক্ত হয়ে কাঁদতে লাগলেন। এরপর বললেন, “ঈসা (আঃ)-এর প্রতিও দুনিয়া থাকা পর্যন্ত সালাম (শান্তি) বর্ষিত হউক এবং হে হামাহ্, আমানত পৌঁছানোর জন্য তোমার প্রতিও সালাম।”
হামাহ্ তখন বলেন, “হে আল্লাহ‘র রাসূল, আপনি আমার সাথে তাই করুন, যা করেছিলেন হযরত ‘মূসা বিন ইমরান’ (আঃ)। তিনি আমাকে তাওরাত শিখিয়েছিলেন।”
রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে (শয়তানের নাতিকে) ‘সূরা ওয়াক্বিয়াহ’, ‘সূরা মুরসালাত’, ‘সূরা আম্মা ইয়াতাসায়ালূন’, ‘সূরা ইযাশ্ শামসু কুউবিরাত’ এবং ‘মুআউওয়াযাতাইন’ (মুআউওয়াযাতাইন হলঃ সূরা ফালাক্ব-নাস) ও ‘কুল হুওয়াল্লা-হু আহাদ’ শেখালেন এবং বললেন, “হে হামাহ্, নিজের প্রয়োজনের কথা আমাকে বল আর আমার সাথে যোগাযোগ রাখা বন্ধ করে দিও না।”
পরবর্তীতে হযরত ওমর (রাঃ) বলেছেন, “পরে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ইন্তিকালের হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটল এবং তার খবর আমরা আর পেলাম না। জানিনা সে জীবিত আছে নাকি মারা গিয়েছিলো।”
[৩] আসমানী কিতাব ১০৪ খানা; বড় কিতাব শুধুমাত্র ৪ খানা, তন্মধ্যে ‘তাওরাত’ একটি।
[তথ্যসূত্রঃ কিতাবুদ্ দুআফা আক্বীলী। দালায়িলুন্ নুবুয়াত, আবূ নুআইম আসবাহানী; ১৩১]
জ্বিনঃ
মানুষ যেমন স্বতন্ত্র এক সৃষ্টি তেমনি জ্বিন জাতি মানুষের থেকে আলাদা এক সৃষ্টি। জ্বিন শব্দের আভিধানিক অর্থ গুপ্ত, অদৃশ্য, লুক্কায়িত, আবৃত ইত্যাদি। জ্বিন্নাত বা জ্বিন জাতির কুকুর ও ইতর শ্রেনিকে বলা হয় জ্বিন।
জানঃ
‘জান’ হচ্ছে জ্বিন জাতির আদিপিতা।
শয়তানঃ
‘শয়তান’-রা হচ্ছে এক ধরণের জ্বিন যারা আল্লাহর অবাধ্য এবং এরা (অভিশপ্ত) ইবলিশের বংশোদ্ভূত। [তথ্যসূত্রঃ কিতাবুল ফুনুন]
মারাদাহঃ
জ্বিন জাতির মধ্যে সেইসব জ্বিনকে ‘মারাদাহ’ বলা হয় যারা খুবই অবাধ্য ও চূড়ান্ত পর্যায়ের পথভ্রষ্ট।
জ্বিন জাতি কত শ্রেণি?
হাফিয ইবনে আবদুল বার্ বলেছিলেনঃ ভাষাতত্ত্ববিদদের মতে, জ্বিনদের কয়েকটি শ্রেণি রয়েছে। যেমনঃ-
ক) জ্বিনঃ অর্থাৎ সাধারণ জ্বিন।
খ) আমির; বহুবচনে উম্মারঃ যারা মানুষের সাথে থাকে।
গ) আরওয়াহ্ঃ যারা সামনে আসে।
ঘ) শয়তানঃ যারা উদ্ধত, অবাধ্য।
ঙ) ইফরীতঃ যারা শয়তানের চেয়েও বিপজ্জনক।
জ্বিন জাতির সৃষ্টির দিনঃ
আল্লাহ তায়ালা বুধবার ফিরিশতাদের, বৃহস্পতিবার জ্বিন্দের, এবং হযরত আদম (আঃ)-কে শুক্রবার সৃষ্টি করেছেন।
[তথ্যসূত্রঃ কিতাবুল আযামাহ]
জ্বিনদের দেখা কি সম্ভব?
কাযী আবু বকর বাকিলানী (রঃ) বলেছিলেনঃ “আমার কথা হচ্ছে যারা জ্বিনদের দেখেছে, আসলেই তারা তাদের দেখেছে। কেননা আল্লাহ্ তা‘য়ালা জ্বিনদের দৃশ্যরুপ সৃষ্টি করেছেন এবং যাদের দৃশ্যরুপ সৃষ্টি করেননি তাদের কেউ দেখতে পারে না। এসব জ্বিনেরা বিভিন্ন সুরতের ও কোমল শরীর বিশিষ্ট হয়।”
জ্বিন সৃষ্টির উপাদানঃ
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ
“আদমের আগে আমি জ্বিন সৃষ্টি করেছি সামূমের[১] উত্তপ্ত আগুন দিয়ে।” [সূরা আল-হিজর, আয়াতঃ ২৭]
[১] জ্বিন সৃষ্টি করা হয়েছে ‘সামূম’-এর আগুন দিয়ে। যা জাহান্নামের আগুনের ৭০ ভাগের এক ভাগ এবং দুনিয়ার আগুন সে ‘সামূম’ আগুনের ৭০ ভাগের এক ভাগ।
জ্বিনের প্রকারঃ
হযরত আবু দারদা (রাঃ)-এর বর্ণনা অনুযায়ী, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ আল্লাহ্ তায়ালা ৩ প্রকার জ্বিন সৃষ্টি করেছেন। প্রথমতঃ জ্বিন হল সাপ, বিচ্ছু ও জমিনের পোকামাকড়। দ্বিতীয়তঃ যে জ্বিন থাকে শূণ্যে হাওয়ার মত, আর তৃতীয় প্রকার জ্বিন হল- এমন জ্বিন যাদের জন্য রয়েছে (পরকালের) হিসাব ও আযাব।”
সাপের সুরতে জ্বিন
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, “রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ সাপ হচ্ছে রুপান্তরিত জ্বিন, যেমন বাঁদর ও শুকরে রুপান্তরিত হয়েছিল বণী ইসরাঈলের কিছু লোক।”
জ্বিন সম্পর্কে কিছু বিস্ময়কর তথ্য -
[[প্রাথমিক তথ্য]]
✓ কোনো কোনো কুকুরও জ্বিন।
✓ কালো কুকুর হচ্ছে শয়তান।
✓ খর্বকায় জ্বিন; বেঁটে বামনঃ এই জ্বিনের উচ্চতা মাত্র ২ আঙুল।
✓ শয়তান বাম হাতে খাবার খায়।
✓ জ্বিনদের মধ্যে বিয়ে-শাদি হয় এবং জ্বিনদের সন্তানাদিও হয়।
✓ ইবলিশের স্ত্রী সম্পর্কিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
✓ হিজড়ারা জ্বিনদের সন্তান। [তথ্য বিস্তৃত]
✓ রাণী বিলকিসের মা একজন ‘জ্বিন’ ছিলেন।
✓ জ্বিনদের মধ্যে ‘ফিরকা’ আছে।
✓ জ্বিনদের মধ্যে মুসলিম ও মুশরিক (হিন্দু) জ্বিনও আছে।
✓ জ্বিনদের মধ্যে কোনো নবী-রাসূলগণের আগমন ঘটেনি।
✓ জ্বিন-ইনসান সকলের নবী হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
✓ ‘বিসমিল্লাহ’ হচ্ছে জ্বিনদের সামনে পর্দা।
✓ জ্বিন সম্প্রসায় ২ ভাগে (মুসলমান ও কাফির) বিভক্ত।
✓ জ্বিনদের মধ্যে দল-উপদল আছে।
✓ মুমিন জ্বিনরা মানুষের কুরআন তিলাওয়াত শোনে।
✓ সব মসজিদে জ্বিনেরা নামায পড়ে।
✓ জ্বিনেরা লেবু বিদ্যমান ঘরে প্রবেশ করে না। (তথ্য প্রযোজ্য)
✓ বিসমিল্লাহ বলে ব্যক্তি খাওয়া শুরু করলে জ্বিনদের খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।
✓ মানুষের মধ্যে মুগরাবীন (মুগরাবীন- যেসব জ্বিন মানুষের সাথে থাকে) মিশে থাকে।
✓ ইবলিশের ডিমঃ ইবলিশ ৫টি ডিম পেড়েছে। তার বংশধর সে ডিম থেকেই হয়েছে।
✓ রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, “হামাহ্ বিন হাইম বিন লাকীস (ইবলিশের নাতি) জান্নাতে যাবে।” [তথ্যসূত্রঃ ঘটনা শূণ্য]
✓ আল্লাহ্ তায়ালা মানব জাতি ও জ্বিন জাতিকে দশটি ভাগে (৯ ভাগ জ্বিন ও এক ভাগ মানুষ) ভাগ করেছেন। যখন একটি মানবসন্তান জন্মায়, জ্বিনদের তখন ৯টি সন্তান জন্ম নেয়।
✓ জ্বিন বহুরুপী হতে পারে। যেমনঃ চতুষ্পদ পশু, সাপ, বিচ্ছু, উট, গরু, ছাগল, ঘোড়া, খচ্চর, গাধা, এবং পশুপাখির প্রভৃতি রুপ ধারণ করতে পারে।
✓ খারাপ জ্বিনদের বাসস্থান ইরাকে। কারণ, শতকরা ৯০ ভেল্কি (জাদু) সেখানে আছে, পাপী জ্বিনরা সেখানে থাকে এবং মানুষকে অচল করে দেওয়ার মত রোগও সেখানে আছে।
✓ গোশতের চর্বি লাগা কাপড়ে ‘খবীস’-রা (দুষ্ট জ্বিনরা) অবস্থান করে।
✓ জ্বিনদের ঘর হচ্ছে গর্ত; পানিতে এবং জলাভূমির বিলেও জ্বিনেরা থাকে।
✓ মানুষদের মতো জ্বিনরাও খাওয়া-দাওয়া করে। হাড়, কয়লা, গোবর, উটের লাদি এবং বিভিন্ন ধরণের খাবার হচ্ছে জ্বিনদের খাদ্য। [সংক্ষিপ্ত বর্ণনা]
✓ মানব সমাজের জাদুকরদের (ভেল্কিবাজ) মত জ্বিনদের জাদুকর (ভেল্কিবাজ) আছে। জাদুকর জ্বিনদের ‘গাইলন’ জ্বিন বলা হয়। এই জাদুকর জ্বিন (গাইলন জ্বিন) মানুষদের পথ ভুলিয়ে দেয় (অর্থাৎ গোলকধাঁধায় ফেলে)।
✒ টীকাঃ গাইলন দেখতে পেলে আযান (নামাযের মধ্যে যে আযান দেওয়া হয়) দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যার (আযানের) বরকতে আল্লাহর ফিরিশতারা পথহারা মানুষদের সঠিকপথে (যাতায়াত পথ) এনে দেয়।
[[মাধ্যমিক তথ্য]]
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর রেওয়াতে বলা হয়েছে, হযরত ওয়াহাবের বর্ণনাঃ আল্লাহ্ তা‘য়ালা সৃষ্টি করেছেন-
“জাহান্নামের আগে জান্নাতকে। গযবের আগে আপন রহমতকে। যমীনের আগে আসমানকে। নক্ষত্ররাজীর আগে সূর্য ও চন্দ্রকে। রাতের আগে দিনকে। স্থলভাগের আগে পানিভাগকে। পাহাড়-পর্বতের আগে সমভূমিকে। জ্বিনদের আগে ফেরেশতাদেরকে। মানবজাতির আগে জ্বিন জাতিকে। স্ত্রীজাতির আগে পুরুষজাতিকে।” [তথ্যসূত্রঃ কিতাবুল আযামাহ (আবূ আশ্-শাইখ)]
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছিলেনঃ “বেশ কিছুকাল পর ইবলিশ বৃদ্ধ হয়ে যায়, এরপর আবার সে ত্রিশ বছরের বয়সে (যুবক বয়সে) ফিরে আসে।” [তথ্যসূত্রঃ গরাইবুস্ সুনান; ইবনে শাহীন]
‘আল-অস্ওয়াসিল খান্নাস’
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছিলেনঃ শয়তান মূলত বেজীর ন্যায় মানুষের মনের গর্তে নিজের মুখ রাখে এবং তা দিয়ে মনের মধ্যে অস্ওয়াসা(২) দেয়। মানুষ যখন আল্লাহ্‘র যিকর করে তখন শয়তান চলে যায় এবং যখন নীরব থাকে তখন সে ফিরে আসে। একেই বলে ‘আল্-অস্ওয়াসিল খান্নাস।’ [তথ্যসূত্রঃ যাম্মুল অস্ওয়াসাহ্, ইবনু আবী দাউদ]
(২) অস্ওয়াসাঃ এটি এমন একটি উহ্য বিষয় যার দিকে মনের প্রবৃত্তি ও মনের গতি-প্রকৃতি আপনা থেকেই আকৃষ্ট হয়। অন্যভাবে বলা যায়- অস্ওয়াসা হচ্ছে মন-মগজকে বাতিল চিন্তা-চেতনার আলোকে প্ররোচনা দান। এই অস্ওয়াসা মূলত শয়তান সৃষ্টি করে। [অস্ওয়াসা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা]
[[পরিপূর্ণ তথ্যঃ ঘটনাবহ]]
→
→
→
[ঘটনাঃ এক]
এক জ্বিনের বিয়েতে হযরত আ’মাশ (রহ) উপস্থিত ছিলেন। বিয়েটি হয়েছিল মানুষ ও জ্বিনের মধ্যে। তিনি জ্বিনদের জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা কোন খাবার বেশি পছন্দ কর?” তারা বলল, “ভাত।” ফলে লোকেরা জ্বিনদের কাছে ভাতের খাঞ্চা আনতে লাগল আর ভাত শেষ হতে লাগল কিন্তু (খানেওয়ালাদের) হাত দেখা যাচ্ছিল না।
→
→
→
[ঘটনাঃ দুই] “এক জ্বিন নারীর ঘটনা”
হযরত আবু ইউসুফ সারুজী (রহ) বর্ণনা করেছেনঃ একবার মদিনায় এক মহিলা এক ব্যক্তির কাছে এসে বলল, ‘আমরা তোমাদের বসতির কাছে এসে নেমেছি, কাজেই তুমি আমাকে বিয়ে করে নাও।’
মহিলার প্রস্তাবে লোকটি তাকে বিয়ে করল। রাত হলে সে মহিলার বেশ ধরে স্বামীর কাছে আসত। একদিন সে জ্বিন মহিলাটি স্বামীর কাছে এসে বলল, ‘আমরা চলে যাব; সুতরাং এখন তুমি আমাকে তালাক দিয়ে দাও।’
লোকটি তাই করল। পরবর্তীতে কোনো এক সময় সে লোকটি মদীনার কোনো এক রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল হঠাৎ সে জ্বিন মহিলাটিকে রাস্তায় শস্যদানা কুড়ানো অবস্থায় দেখতে পেল। তা দেখে লোকটি বলল, ‘আরে! তুমি এখানে দানা কুড়াচ্ছ?’
এ কথা শুনে মহিলাটি লোকটির দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল এবং বলল, ‘তুমি আমাকে কোন চোখ দিয়ে দেখেছ?’
লোকটি বলল, ‘এ চোখ দিয়ে।’
তখন মহিলাটি নিজের আঙুল দিয়ে ইশারা করা মাত্রই লোকটির চোখ উপড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ল।
→
→
→
[ঘটনাঃ তিন] “শয়তানদের তথ্য চুরি”
একবার রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবীদের নিয়ে উকায বাজারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তখন শয়তানদের সামনে আসমানে যাওয়া ও সেখান থেকে খবরাদি সংগ্রহ করে আনার কাজে প্রতিবন্ধকতা দেখা দিল এবং তাদের উপর উল্কাপিণ্ড নিক্ষিপ্ত হল। এমন অবস্থা দেখে শয়তানরা তাদের কওমের কাছে গিয়ে বললঃ
— “আমাদের এবং আসমানের খবরাদি সংগ্রহের মধ্যে কোনো জ্বিনিস বাঁধা হতে পারে না। মনে হচ্ছে কোনও নতুন কিছু ঘটেছে।”
— “তোমরা পৃথিবীর চারদিকে ঘোরাঘুরি কর। দেখ যে, কোন জ্বিনিস তোমাদের ও আসমানের খবর সংগ্রহের মধ্যে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
সুতরাং তারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিমে খোঁজাখুঁজি শুরু করতে লাগল। তাদের মধ্যে একটি দল ‘তিহামার’-এর দিকে ঘুরতে ঘুরতে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর দিকে এল। সে সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবীদের নিয়ে ‘নাখলা’ এলাকায় ফজরের নামায পড়ছিলেন। জ্বিনের দলটি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর মুখে কোরআন পাক শুনে তিনার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বলতে লাগলঃ
— “আল্লাহর কসম! এ সে বিষয়, যা আমাদের ও আসমানের সংবাদ সংগ্রহের মধ্যে বাঁধা হয়েছে।”
এরপর তারা নিজেদের কওমের কাছে ফিরে গিয়ে বলতে লাগলঃ
— “হে আমাদের (জ্বিন) সম্প্রদায়! আমরা তো এক চমৎকার কোরআন শুনেছি, যা সঠিক পথ নির্দেশ করে, তাই আমরা সে কুরআনের উপর ঈমাণ এনেছি এবং আমরা কখনও আমাদের প্রতিপালকের সাথে কোনো কিছুকে শরিক করব না।”
[তথ্যসূত্রঃ বুখারী শরীফ]
→
→
→
[ঘটনাঃ পাঁচ] “মু’মিনের সাথে ৩৬০ জন ফেরেশতা”
হযরত আবু উমামা (রাঃ) বলেন, নবী করীম সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমালেন, “প্রতিটি মু’মিন লোকের সাথে তিনশত ষাটজন ফেরেশতা থাকেন। যে মুছিবত মানুষের উপর লিখা নেই তা মু’মিন লোকের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেন। শুধু চোখের জন্য সাতজন ফেরেশতা। এসব ফেরেশতা মানুষের নিকট থেকে বালা-মুছিবত এভাবে দূরে সরাতে থাকেন যেমনিভাবে গ্রীষ্মকালের মধুর পেয়ালা থেকে মাছি দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়। এ সমস্ত ফেরেশতাকে যদি তোমাদের সামনে প্রকাশ করে দেওয়া হয়, তাহলে তোমরা তাদের প্রত্যেককে খোলা মাঠে ও প্রতিটি পর্বতে হাত এবং মুখ খোলা অবস্থায় দেখতে পাবে। আর যদি মানুষের মুছিবতকে (রোগ-ব্যধি, দুঃখ-দূর্দশা) চোখের পলকের জন্য তার সত্ত্বাকে (নিজের দেহকে বা স্বকীয় বৈশিষ্ট্যকে) অর্পণ করা হয় তাহলে তার উপর শয়তান দ্রুত আক্রমণ করবে।”
[তথ্যসূত্রঃ কানযুল উম্মাল]
[ঘটনাঃ ছয়] “দুই নবীর প্রতি ঈমান আনয়নকারী জ্বিন”
একবার আমি (সাহল) আদ্ জাতির এক অঞ্চলে গিয়েছিলাম; সেখানে একটি খননকৃত গুহা আমার দৃষ্টিগোচর হয় এবং সেই গুহার মাঝে একটি পাথরের বাড়ী ছিল যেখানে জ্বিনেরা বসবাস করত। সেই বাড়ীতে আমি প্রবেশ করলাম এবং দেখলাম একজন বিরাটাকায় বৃদ্ধ কা’বার দিকে মুখ করে নামায পড়ছেন। বৃদ্ধের গায়ে পরিহিত ছিল চকচকে এক পশমের জুব্বা যা তার বিশালাকার চেহারার চেয়ে অত্যন্ত উজ্জ্বল ও সজীব ছিল! তাকে আমি সালাম দিলাম। তিনি আমার সালামের জওয়াব দিলেন এবং বললেনঃ “হে সাহল! পোশাককে শরীর পুরোনো করে না এবং পোশাককে পুরোনো করে পাপের দুর্গন্ধ আর হারাম খাদ্য। এ জুব্বা আমি সাতশ’ বছর ধরে পরিধান করে আছি। এ জামাটি পরিধান করে আমি হযরত ঈসা (আঃ) ও হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সাক্ষাৎ করেছি এবং তাদের প্রতি ঈমান এনেছি।”
আমি (সাহল) বললামঃ “আপনি কে?”
তিনি বললেনঃ আমি সে ব্যক্তি (জ্বিন)-দের অন্তর্গত; যাদের সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে নাযিল হয়েছিল ‘সূরা জ্বিনের’ প্রথম আয়াতঃ “আপনি বলুন, ওহীর মাধ্যমে আমি অবগত হয়েছি যে; জ্বিনদের একটি দল কুরআন তিলাওয়াত শুনেছে-।”
[তথ্যসূত্রঃ সিফাতুস সফওয়াহ্, ইবনে জাওযী (রহঃ)]
[ঘটনাঃ সাত] “হাজ্জাজ বিন ইউসুফের ঘটনা”
একবার হাজ্জাজ বিন ইউসুফের সামনে এক লোককে হাজির করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল জাদুর।
হাজ্জাজ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন- ‘তুমি কি জাদুকর?’
সে বলল- ‘না।’
হাজ্জাজ তখন একমুঠো কাঁকর নিয়ে সেগুলো গুণতে থাকেন। এরপর অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করলেন- ‘আমার হাতে কত সংখ্যক কাঁকর আছে?’
‘এত সংখ্যক।’ -অভিযুক্ত লোকটি বলল।
হাজ্জাজ তখন সে কাঁকরগুলো ফেলে দিয়ে পুনরায় আরব একমুঠো কাঁকর নেন এবং না গুণেই জিজ্ঞাসা করলেন- ‘এখন আমার কতটি কাঁকর আছে?’
লোকটি বলল- ‘আমি জানিনা।’
হাজ্জাজ জিজ্ঞাসা করলেন- ‘প্রথমবার তুমি ঠিকঠাক বলে দিলে কিন্তু দ্বিতীয়বার তুমি পারলে না কেন?’
‘প্রথমবার আপনি জেনেছিলাম; এর দ্বারা আপনার অস্ওয়াসাও জেনে গিয়েছিল এরপর আপনার অস্ওয়াসা আমার অস্ওয়াসাকে জানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু পরেরবার আপনি নিজেও অবগত ছিলেন না তাই আপনার অস্ওয়াসাও জানেনি সেজন্যে আপনার অস্ওয়াসা আমার অস্ওয়াসাকেও বলতে পারেনি। যার দরুন আমি নিজেও জানতে পারিনি।’ -লোকটি উত্তরে বলল।
[তথ্যসূত্রঃ আল-অস্ওয়াসাহ্, ইবনে আবী দাউদ]
[ঘটনাঃ আট] “জ্বিন ছাড়ানোর তাদবীর”
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেছিলেনঃ মদীনার এক রাস্তা দিয়ে আমি ও রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাচ্ছি। এমন সময় দেখতে পেলাম একজন মৃগী রোগী। আমি তার কাছে গিয়ে তার কানে কুরআনের কিছু আয়াত তিলাওয়াত করার পরে সে সুস্থ হয়ে উঠল। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ ‘তুমি তার কানে কি পড়লে?’
আমি বললাম- ‘আফাহাসিবতুম আন্নামা খালাকানাকুম অবাসাউঁ অ আন্নাকুম ইলাই্না লা তুরজ্বাঊন অর্থাৎ সূরা মু‘মিনূনের আয়াত নং ১১৫ থেকে শেষ পর্যন্ত তিলাওয়াত করেছি।’
নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ ‘যাঁর হাতে আমার জীবন, সে সত্ত্বার কসম! কোনো মু’মিন যদি ইহা কোনো পাহাড়ের উপরেও পড়ে, তাহলে সে পাহাড়ও হটে যাবে।’
[তথ্যসূত্রঃ হাকিম; তিরমিযী; আবূ ইয়া‘লা, ইবনে আবী হাতিম, আকীলী...]
জ্ঞাতব্যঃ দুনিয়াতে মুসলমানদের দুঃখ-কষ্ট, দৈন্য-দূর্দশা, হতাশা-চিন্তা প্রভূত পরকালে ও ক্ষেত্রবিশেষে দুনিয়াতে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি এবং পরকালে অপার পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য; যা (পরকালের পুরস্কারপ্রাপ্তি) কোনো মুসলমান ও কূল-কায়নাতের কারো পক্ষে অনুমেয় নয়। তদুপরি কাফেরদের ক্ষেত্রে মুসলমানের বিপরীত অর্থাৎ তারা দুনিয়াতেই আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাসের উপকরণ হতে শুরু করে যা চায় তা অনায়াসেই পেয়ে যায়। আল্লাহ্-কে চেনার আগে শয়তানকে চেনা জরুরী। কারণ, শয়তান আমাদের রগ-রেড়ষায় মিশে থাকে এবং আল্লাহ্ তা‘য়ালা আমাদের অন্তরের অনঃস্থলে থাকেন।
(আল্লাহ্ আমাদেরকে অন্তর্দৃষ্ট চক্ষু দান করুন।)
“শাকিল ওসমান” || ‘জ্বিন জাতির ইতিবৃত্ত’