11/03/2025
হোমিওপ্যাথির বিরুদ্ধে লিখতে গিয়ে,
অবশেষে হোমিওপ্যাথির পক্ষে।
----------------------------হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাকে প্রচন্ড ঘৃণা করতে এসে পরিণত হয়েছেন প্রশংসাকারীতে এলোপ্যাথ ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার
এ লেখাটি হোমিওপ্যাথির সমালোচক ও বিরুদ্ধবাদী তাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হলো। কারণ এরাই এবং এমন ব্যক্তিরাই পরবর্তীতে হোমিওপ্যাথির জোরালো সমর্থক এবং ব্যাখ্যাকারকে পরিণত হয়েছেন।
প্রচন্ড ঘৃণা করতে এসে পরিণত হয়েছেন প্রশংসাকারীতে। Dr. Hearing (Father of Homeopathy in US) এবং Dr. T. F. Allen -এর মধ্যেও আমরা একই ধরনের রূপান্তর দেখতে পাই।
তবে এক্ষেত্রে ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার (M.D, D.L, C.I.E) -এর বিষয়টি উল্লেখ করার মতো এবং তা আমাদের বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করে।
তিনি জন্মেছিলেন 1833 সনে। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী একজন ছাত্র এবং উজ্জ্বল দীপ্তিমান একজন চিকিৎসক। তিনি ব্রিটিশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের বেঙ্গল শাখার নির্বাচিত সেক্রেটারি ছিলেন এবং পরে তিনি এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হন।
তার সমসাময়িক একজনের মতে তিনি ছিলেন আমাদের ভারতীয় এলোপ্যাথিক পেশা জগতের আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ওই সময় চিকিৎসা পেশাজগতের যোগ্য কোন ব্যক্তি হোমিওপ্যাথিকে মোটেই কোন গুরুত্ব দিতেন না। যদি কেউ এর পক্ষে বলতেন তাকে সাথে সাথে সবাই বরকট করত। আসলে হোমিওপ্যাথিকে হাতুড়ে চিকিৎসা ডাকিনীবিদ্যা বা কালো জাদুর সমর্থক বলে মনে করা হতো।
ডাক্তার সরকার নিজেও 1863 সনে ব্রিটিশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনে জ্বালাময়ী ভাষায় হোমিওপ্যাথির নিকুচি করেন।
#এরপর কি ঘটলো তার শ্রেষ্ঠ বর্ণনা শোনা যাক ডাক্তার সরকারের নিজের ভাষাতেই-
ব্রিটিশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের শাখা হিসেবে একটি মেডিকেল সোসাইটি গঠনের জন্য ডাক্তার চক্রবর্তীর বাসায় 27 May 1863 -তে এক প্রস্তুতিমূলক সভায় একটি প্রস্তাব উত্থাপন কালে আমি একটি বক্তৃতা দেই। তাতে আমি অবজ্ঞাভরে হোমিওপ্যাথিকে একটি হাতুড়ে চিকিৎসা বলে ইঙ্গিত করি।
আমি বলেছি, এদের উথান এবং সাময়িক চমক সৃষ্টি করতে পারার কারণ নিম্নরূপ-
যেমন, সব রোগ আরোগ্যযোগ্য নয়। এরকম অনেক রোগ আছে যাতে আমাদের চেষ্টা কোন কাজেই আসেনা। কখনো কখনো এদের একা রাখলে এবং প্রকৃতির উপর ছেড়ে দিলেই বরং ভালো হয়।
হাতুড়ে চিকিৎসক ও প্রতারকরা এসব রোগী যাদের আমরা ত্যাগ করি তাদের ক্ষেত্রে প্রায়ই ভালো ফল দেখায়। যেসব রোগীর ক্ষেত্রে তারা সাফল্য দেখাতে পারে তা সম্ভবত আমাদের অমনোযোগিতার কারণে।
এভাবে আমি আমার সমগোত্রীয় চিকিৎসকদের মতোই হোমিওপ্যাথির প্রতি একজন চরম ঘৃণা ও অবজ্ঞা প্রকাশকরী ছিলাম। আমি সম্ভবত এদের মধ্যে সবার চেয়ে বেশি ক্ষিপ্ত ছিলাম। তবে আর সবার মত আমিও হোমিওপ্যাথি সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতাম না।
যারা একে ব্যঙ্গ করত এবং এর গোঁড়া বিরুদ্ধবাদী ছিল তাদের কাছ থেকে যতটুকু জেনেছিলাম, সেটুকুই ছিল আমার হোমিওপ্যাথি সম্পর্কে জ্ঞান।
সদৃশ নীতি এবং অতিক্ষুদ্র মাত্রার ঔষধ প্রয়োগ সম্পর্কে আপাতদৃষ্টিতে একটা অবাস্তবতা প্রতিভাত হয়, তার সাথে আমি এর যেসব অপব্যাখ্যা পড়েছি সব মিলিয়ে আমার মনে হোমিওপ্যাথি সম্পর্কে একটা বিকৃত ধারণা জন্মে।
সংগত কারনেই আমি হোমিওপ্যাথদের দ্বারা লিখিত হোমিওপ্যাথি সম্পর্কিত কোন লেখা পড়তাম না। যেসব লেখক বাস্তব অনুসন্ধান করে এর যথার্থতা পেয়েছেন এবং এটি যে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত তা উদ্ঘাটন করেছেন, তাদের লেখাও না।
আমার বক্তৃতায় হোমিওপ্যাথি সম্পর্কে যে পরোক্ষ ঘৃণা ফুটে উঠেছিল তার প্রতি প্রয়াত বাবু রাজেন্দ্র দত্তের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়।
যে স্বল্পসংখ্যক অপেশাদার (যাদের চিকিৎসা সংক্রান্ত ডিগ্রী নেই) ব্যক্তি অবজ্ঞা ও নিপীড়নে আক্রান্ত এই পদ্ধতির স্বপক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে সচেষ্ট হন তাদের মধ্যে তিনি সবচাইতে প্রসিদ্ধ ব্যক্তি ছিলেন।
তিনি একজন ধনকুবের, প্রথম জীবনে নিঃস্বার্থভাবে ইউরোপিয়ান এ্যালোপ্যাথিক পদ্ধতির সহায়ক ভূমিকা পালন করেন।
তেমনি নিঃস্বার্থ এক অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তিনি উপলব্ধি করতে পারলেন প্রচলিত পদ্ধতির চাইতে হোমিওপ্যাথির শ্রেষ্ঠতা। তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ দৃঢ়তা ও একাগ্রতা নিয়ে এর সুফল, তার কলকাতার সহকর্মীদের মধ্যে পৌঁছে দিতে ব্রতী হলেন।
তিনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে খুবই কার্যকর আরোগ্য করতে সক্ষম হলেন, যার অনেকগুলোই ভারতীয় হোমিওপ্যাথির ইতিহাসে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
তিনি বেশ কিছু সংখ্যক মেধাবী এবং উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিকে হোমিওপ্যাথিতে টেনে আনতে সক্ষম হন। এদের মধ্যে প্রয়াত পন্ডিত "ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর" ছিলেন অন্যতম।
তবে পেশাদার ডাক্তার (Allopathic) এমন কাউকে তিনি প্রভাবিত করতে পারেননি, বরং তার অধিকাংশ ডাক্তার বন্ধু যাদের উন্নতির পিছনে তার যথেষ্ট অবদান ছিল, তারাই তাকে পাগল বলে আখ্যায়িত করলো।
তারা মনে করল হাতুড়ে চিকিৎসার সবচেয়ে ক্ষতিকর ও উদ্ধত অংশ দ্বারা তিনি বরবাদ হয়ে গেছেন।
তবে তার চিকিৎসক বন্ধুদের এসব আচরণ তার কাজ থেকে তাকে বিরত করতে পারল না।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে হোমিওপ্যাথির সত্যতা সম্পর্কে তার বিশ্বাস এত দৃঢ় ছিল যে, তিনি নিশ্চিত ছিলেন কোন চিকিৎসক যদি তার কথা সামান্যতম শুনে এবং তার কেসগুলো পর্যবেক্ষণ করে তবে তিনিও এই সত্য উপলব্ধি করতে পারবেন।
আমার বক্তৃতা পড়ে তিনি এর মধ্যে কিছু একটা খুঁজে পেলেন।
একথা তিনি আমাকে পরে জানিয়েছিলেন। এই বক্তৃতা পড়ে তিনি মনে করলেন অবশেষে একজনকে পাওয়া গেল যাকে তার দিকে অর্থাৎ সত্যের দিকে নিয়ে আসা যাবে। তবে তা সম্ভব হবে যদি তিনি একটু সময়ের জন্য তার পেশাগত অহংকারকে ত্যাগ করে এগিয়ে আসেন।
বিশেষ একটি ঘটনা না ঘটলে তার এই আশা এবং সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হতো না। আমাকে তার বিশ্বাসে দীক্ষিত করতে রাজেন্দ্র দত্তের প্রচেষ্টা ছিল অক্লান্ত।
কিন্তু আমার মধ্যে চরিত্রগত গভীর পূর্ববিশ্বাসের দ্বারা সৃষ্ট একগুঁয়েমির কারণে আমি তার যুক্তিগুলোকে হটিয়ে দিচ্ছিলাম, তার কেসগুলো পর্যবেক্ষণ করতে অস্বীকার করছিলাম। একজন অপেশাদার (ডিগ্রী বিহীন) লোকের অধীনে রোগী পর্যবেক্ষণ করাকে আমার পেশাগত মর্যাদাহানিকর এবং সময়ের অপচয় বলে মনে হচ্ছিল।
আমাদের মধ্যে যখন এরকম বিবাদ চলছিল, ঠিক এই সময়ে হোমিওপ্যাথির প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণকারী একজন সম্পাদক, আমার এক অপেশাদার বন্ধু তিনি আমাকে একটি হোমিওপ্যাথিক পুস্তিকা দিলেন গ্রন্থ সমালোচনা লেখার জন্য। পত্রিকাটি ছিল মর্গান’স ফিলোসফি অব হোমিওপ্যাথি।
আমি ভাবলাম রাজেন্দ্র বাবুকে ঠান্ডা করার এবং হোমিওপ্যাথিকে পিষে ফেলার এ এক মোক্ষম সুযোগ।
হোমিওপ্যাথির উপর এটা ছিল আমার প্রথম বই যা আমি পড়তে রাজি হলাম। ভাবলাম খুব দ্রুত এর সমালোচনা লিখে ফেলবো।
ভাসাভাসা ভাবে বইটির উপর চোখ বুলানোর পর কি ঘটলো ??
আমি বুঝতে পারলাম, খুব ভালোভাবে আবার না পড়ে এর সঠিক সমালোচনা লেখা সম্ভব নয়।
দ্বিতীয়বার সাবধানে সতর্কতার সাথে বইটি পাঠ করার পর আমার দৃঢ় বিশ্বাস হলো যে পদ্ধতি কতিপয় সত্য ঘটনার উপর প্রতিষ্ঠিত বলে কথিত এবং সব সময় খুব সাহসের সাথে এই সত্যগুলো পরীক্ষা করে দেখার চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে, তার সমালোচনা লিখতে হলে এগুলো পরীক্ষা করে দেখে নেওয়া প্রয়োজন।
কিন্তু কিভাবে এগুলো দেখা যায় ?
কাজেই রাজেন্দ্র বাবুর শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় রইল না। তিনি ছিলেন একমাত্র চিকিৎসক যার কেসগুলো আমি পর্যবেক্ষণ করতে পারি। তিনি একজন ডিগ্রী বিহীন চিকিৎসক হওয়া সত্ত্বেও এবার আমি আমার পেশাগত মর্যাদা বলি দিয়ে তার কেসগুলো পর্যবেক্ষণ করতে দ্বিধা করলাম না। সত্য অনুসন্ধানের তাগিদে পেশা এবং মানবতার বৃহত্তর স্বার্থে আমি আমার মনঃস্থির করলাম।
কাজ শুরুর আগে আমি ডাক্তার রাজেন্দ্র- র সাথে একটি চুক্তি করে নিলাম। আমি তাকে বললাম, যেহেতু আমি বিশ্বাস করি যে তার কাছে রোগীরা যে আরোগ্য পায় তা শুধু খাদ্য ও পথ্য সম্বন্ধে বিধি নিষেধ ও কঠোরভাবে স্বাস্থ্যনীতি পালনের কারণে- এসব সূক্ষ্মমাত্রার ঔষধ, গ্লোবিউলস বা ফোটা এগুলো কিছুই না।
কাজেই আমি কেস গুলো পর্যবেক্ষণ করতে পারি।
তবে রোগীকে একটা সময় পর্যন্ত কোন ঔষধ না দিয়ে শুধু খাদ্য ও পথ্যের বিধি-নিষেধ এবং স্বাস্থ্যবিধি পালনের উপর রাখতে হবে।
ততক্ষণ পর্যন্ত রাখতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না এই ব্যবস্থা রোগীর জন্য ক্ষতিকারক বলে মনে না হয়। ডঃ রাজেন্দ্র বাবু সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলেন।
বলতে অবাক লাগে, গুটিকয়েক রোগী ঔষধ ছাড়া শুধু এই ব্যবস্থাপনায় আরোগ্য পেয়ে গেল।
আমি রাজেন্দ্র বাবুর মধ্যে নিরুৎসাহের ছায়া দেখতে পেলাম। তবে এদিকে আমার এই চমক ও বেশিদিন টিকলো না।
আরো কিছু রোগী ছিল যাদের মধ্যে কোন পরিবর্তন পেলাম না, ফলে আমি তাদের উপর ঔষধ প্রয়োগ করতে দিতে বাধ্য হলাম। এতে অনেক রোগী আরোগ্য পেল এবং অসাধ্য রোগীরা উপকার পেল।
বিষয়টি আমাকে দ্বিধাগ্রস্থ করল, ফলাফল এত সুস্পষ্ট যে, আমি অস্বীকার করতে পারছিলাম না। তাই আমি আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিজেই এর কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে বাধ্য হলাম, যেসব রোগীদের ক্ষেত্রে আরোগ্য বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছিল সে সব রোগীদেরকে এই (হোমিও) ঔষধ প্রয়োগ করা হলো।
এর ফলাফল অলৌকিক না হলেও প্রায় বিস্ময়কর ছিল, যা আমার বিরুদ্ধবাদী উদ্যমকে অবদমিত করে দিল।
এই পরীক্ষা শুরু হয়েছিল 1885 -তে এবং এক বছরের মধ্যে আমার বিশ্বাসের পরিবর্তন হলো। আগে যেমন হোমিওপ্যাথিকে মনে করতাম এটা একটা প্রতারণা এবং হাতুড়ে চিকিৎসা আর এখন এই আস্থা জন্মালো যে, আসলে তা নয়।
তখন এদের সূক্ষ্মমাত্রার দাবি কতটুকু সত্য নিশ্চিত হবার জন্য আমি নিজের হাতে কিছু ঔষধ তৈরি করলাম।
এবং এই পদ্ধতির নীতি অনুসারে তা প্রয়োগ করে এর যে কার্যকারিতা পেলাম তা আগে যেমন বলেছি, তেমনিই বিষ্ময়কর।
এই পদ্ধতির মধ্যে সত্য ছিল, এই সত্যের আর বিরোধিতা না করে বরং এই সত্যের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ গড়ে তুলে, তার বিরোধিতা করাই আমার কাছে শ্রেষ্ঠ বলে মনে হল।
হোমিওপ্যাথি দি সাইন্স অব হিলিং
ডাঃ রাজন শংকরণ
(মূল লেখা থেকে কিছু কিছু স্থানে ভাষাগত কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে।)ডা: ইয়াকুব সরকারের ওয়াল থেকে।